মিডিয়া সহ চারপাশ থেকে কয়দিন যাবত বেশ প্রশ্ন উঠছিলো, সবাই এগিয়ে আসছেন কিন্তু পৃথিবীর অন্যতম ধনী অভিনেতা হিসেবে যার সুনাম আছে সেই বলিউডের কিং খান খ্যাত শাহরুখ কোথায়?
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ভয়াবহ ব্যপ্তি থেকে নিজেদের রক্ষার্থে সমগ্র ভারত তথা ১৩০ কোটি ভারতবাসী ২১ দিনের লকডাউনের সময় পার করছে। খুব সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসেই সর্ব প্রথম একযোগে এতো মানুষ লকডাউন হলো। তবে মোদী সরকারের এমন হার্ডলাইনে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর সুবিশাল নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তা নতুনভাবে বলার অপেক্ষা রাখে না।
ভারতের জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অংশ এখনো দারিদ্র্য সীমার নীচে অবস্থান করছে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই বেশি ভুক্তভোগী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে নিন্ম আয়ের মানুষের। যার বেশ কিছু উদাহরণ আমরা ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করেছি। আয় রোজগার, খাদ্যের উৎস হারিয়ে নিজ গ্রামের উদ্দেশ্যে খালি পায়ে হেঁটেই শত শত কিলোমিটার পাড়ি দিচ্ছেন ভারতীয় দিনমজুরেরা। ইতিমধ্যেই লকডাউনের মধ্যে বাড়ি যেতে ৫০০ কিলোমিটার পথ হাঁটতে গিয়ে মৃত্যু হলো ভারতের এক শ্রমিকের। যে ঘটনা নাড়া দিয়েছে অসংখ্য বিবেকবান মানুষদের।
এমতাবস্থায় এমন কঠিন পরিস্থিতিতে এগিয়ে এসেছে ভারতীয় বিত্তবানেরা। টাটা, আম্বানি, আদানিরা দেশবাসীর পাশে এসে দাঁড়িছেন। ভারত সরকার ও রাজ্য সরকারগুলোর ত্রাণ তহবিলে বড় অঙ্কের টাকা ডোনেটসহ বিভিন্ন দায়িত্ব গ্রহণের ঘোষণা দিয়ে প্রতিদিনই নিউজের হটটপিক হয়ে উঠছেন অনেকেই। পিছিয়ে নেই মুম্বাইয়ের বলিউড পাড়াও। অক্ষয় কুমার, সালমান খান, অজয় দেবগণ সহ হাল আমলের তরুণ অভিনেতা ভিকি কৌশল, সারা আলী খানরাও এগিয়ে এসেছেন, সামর্থ্য অনুযায়ী পাশে দাঁড়িয়েছেন।
কিন্তু মিডিয়া সহ চারপাশ থেকে কয়দিন যাবত বেশ প্রশ্ন উঠছিলো, সবাই এগিয়ে আসছেন কিন্তু পৃথিবীর অন্যতম ধনী অভিনেতা হিসেবে যার সুনাম আছে সেই বলিউডের কিং খান খ্যাত শাহরুখ কোথায়? শাহরুখ খান নিজে অনেক দাতব্য সংস্থার সাথে যুক্ত ছিলেন বা আছেন, সামাজিক দায়িত্ববোধের অবস্থান থেকে তিনি চিরকালই সম্মুখে থেকেছেন কিন্তু দেশের এমন প্রয়োজনে তিনি চুপ আছেন কেন! হঠাৎ করেই তিনি যেন কোথাও নেই। এতে যেমন তার ভক্তকুলদের মধ্যেও ব্যাপক হতাশা প্রকাশ পেয়েছে, আবার সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সমালোচকরাও তাঁকে একহাত নিতে ছাড়েননি৷
এভাবে গুটিকয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পর জবাবটা অবশেষে এলো। আর তা এমনভাবে শাহরুখ খান দিলেন ফলে মুখে কুলুপ এঁটে নিতে বাধ্য হয়েছে সবাই! এযেন দুঃখী, কর্মহীন মানুষের পাশে সত্যিকার অর্থেই এক মানবিক রাজার প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। শুধুমাত্র ভারত সরকার ও রাজ্য সরকারের ত্রাণ তহবিলে অর্থ দিয়ে তিনি ক্ষান্ত হননি বরং কর্মহীন দিনমুজুরসহ নিন্ম আয়ের পরিবারের মুখে মাসব্যাপী খাবার তুলে দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। যা হতবাক ও প্রফুল্ল, দুটোই করেছে অনেককে। এক নজরে দেখে নেয়া যাক করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের পাশে শাহরুখের ভূমিকা:
- আইপিএল এ তাঁর মালিকানাধীন দল কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অর্থ প্রদান। মালিকানাধীন রেড চিলিজ এন্টারটেইনমেন্ট এর হয়ে মহারাষ্ট্রের ত্রাণ তহবিলে অর্থ প্রদান।
- মালিকানাধীন কলকাতা নাইট রাইডার্স ও মীর ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে মহারাষ্ট্র ও পশ্চিমবঙ্গের জন্য ৫০,০০০ পিপিই প্রদান এবং ভবিষ্যতে এই দুই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দুই রাজ্যের সরকারের সাথে একযোগে কাজ করার ঘোষণা। এছাড়া ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গ ও মহারাষ্ট্রের হাসপাতালগুলোতে যেন ভেন্টিলেটরের অভাব না হয় এজন্য আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করেছেন।
- এক সাথ ফাউন্ডেশনের সাথে যৌথ উদ্যোগে মুম্বাইয়ে সাড়ে পাঁচ হাজার পরিবারকে কমপক্ষে একমাসের খাবার সামগ্রী প্রদান এবং বিভিন্ন হাসপাতাল ও জরুরি পরিষেবায় এক মাস যাবত প্রতিদিন দুই হাজার প্লেট খাবার পৌঁছে দেয়া হবে।
- পাশাপাশি রুটি ফাউন্ডেশন, মুম্বাই পুলিশের সাথে যৌথ উদ্যোগে তাঁর সংস্থা ভিক্ষুক, দুঃস্থ মানুষদের জন্য পুরো মহারাষ্ট্রে প্রতিদিন দশ হাজার করে মাসব্যাপী তিন লক্ষ মিল বিলি করবে।
- এতোকিছুর ভিড়ে দিল্লীকে ভুলেননি শাহরুখ খান। নিজের প্রিয় দিল্লীর দায়িত্বও তিনি নিয়েছেন সামর্থ্য অনুযায়ী। আগামী একমাসের জন্য দিল্লীর ২৫০০ দিনমুজুরকে বিনামূল্যে রেশন দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, যা তাঁর সংস্থা মীর ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে করা হবে।
- দিল্লী, উত্তরপ্রদেশ, কলকাতা, বিহার ও উত্তরাখন্ডে এসিড হামলার শিকার হয়েছেন এরকম ১০০ জনেরও বেশি মানুষের প্রয়োজনীয় ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছেন।
এ যেন দুহাত উজাড় করে দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ালেন বলিউড বাদশা। মহত্ত্বের পরিচয়ও দিয়েছেন আরো দারুণভাবে, নিজের দেয়া বিবৃতিতে কত অর্থ তিনি দান করেছেন ত্রাণ তহবিলগুলোতে তা উল্লেখ করেননি। অহমিকার প্রকাশ নয় বরং এই কাজগুলো তাঁর কাছে কেবলই সামাজিক দায়িত্ববোধ ও তাঁর কাছ থেকে মানুষের প্রাপ্য এটাই যেন তিনি প্রমাণ করলেন। তিনি সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
শাহরুখ খানের জন্য নতুন কোনো পরিচয়, বিশেষণ কিংবা মুকুটের প্রয়োজন নেই। নিজের দারিদ্র্যতাকে জয় করেই তিনি শাহরুখ হয়েছেন। তাই সেই ব্যাথার অনুভূতি তাঁর আছে খুব ভালোমতোই। সমালোচক কিংবা আলোচক যে যায় বয়ান দিক, দেশের এমন পরিস্থিতিতে মানুষের পাশে শাহরুখ যেন দাঁড়ালেন নিজের মতো করেই। শাহরুখের করোনায় সাহায্য সংক্রান্ত বিবৃতিতে তাঁর দেয়া কথাটা শেষ কথা হতে পারে,
'Raat ke bad naye din ki shahar ayegi,
Din nahi badlega, tareeq badal jayegi.'
অর্থ্যাৎ রাতের পরে ফের নতুন ভোরের শহর আসবে। তারিখ হয়তো বদলাবে কিন্তু দিন পাল্টাবে না। একসাথেই আমরা সবাই ফিরবো।
ভবিষ্যৎ দুর্যোগেও মানুষ শাহরুখ খানের মানবিকতাকে দীর্ঘদিন মনে রাখবে এবং তা থেকে অনুপ্রেরণা পাবে, আমরা সকলে তাই কাম্য করি। শাহরুখ নিজেও হয়তো তাই প্রত্যাশা করে।