এক রাতে বিরিয়ানী খাওয়ার পর যে ছেলের পকেটে পর দিন সকালে নাস্তা করার পয়সা ছিলো না, মুম্বাইতে কাজ করতে এসে যে ছেলেটা আরেকজনের বাসার বারান্দায় রাত কাটাতো- সেই শাহরুখ খান গত কয়েক বছর ধরেই বিশ্বের সবচেয়ে ধনী অভিনেতাদের একজন!
বছর তেইশ চব্বিশের এক তরুণ, দিল্লির বাত্রা হাসপাতালের সামনের পার্কিং লটে বসে আছে প্রার্থনার ভঙ্গিতে। তার মা এই হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি। শেষ সময় সমাগত, ডাক্তার তাকে আইসিইউতে ঢোকার অনুমতি দিয়েছেন, কিন্ত প্রার্থনা ছেড়ে ওঠার নামগন্ধ নেই তার। তরুণের বদ্ধমূল ধারণা, যতক্ষন দোয়া চলতে থাকবে, ততক্ষন স্রষ্টা তার প্রার্থনা শুনতে ব্যস্ত থাকবেন, আর তার মাও জীবিত থাকবেন।
পরে জোরাজুরি করে তাকে নেয়া হলো রোগীর বেডের কাছে। সেখানে গিয়ে আরেক নাটক! ছেলেটা বিশ্বাস করে, মানুষ তখনই শেষযাত্রায় শামিল হয়, যখন তার সকল চাহিদা পূরণ হয়ে যায়, সকল আফসোস পরিতৃপ্তিতে রূপান্তরিত হয়। আমাদের এই তরুণ তার মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের কানের কাছে গিয়ে অভিযোগনামা পেশ করা শুরু করলেন- "দেখো, তুমি যদি চলে যাও তাহলে আমি পড়ালেখা ছেড়ে দেবো, কাজ করবো না, বোনের খেয়াল রাখবো না.....সে এক লম্বা লিস্ট!"
কিন্ত স্রষ্টার ইচ্ছেটা বোধহয় অন্যরকম ছিল। হয়তো স্রষ্টা এই তরুণের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে নিজের কাছে টেনে নিয়েই তার সন্তানের সাফল্যের পর্বতে আরোহন করতে দেখাতে চাইছিলেন। মাকে ঠেকানো গেল না। এই তরুণের নাম আবদুর রেহমান। যদিও এই নামের স্থায়িত্ব বেশীদিন ছিল না, সেই কথায় পরে আসছি।
আবদুর রেহমানের বাবা ছিলেন ভারতের সক্রিয় স্বাধীনতাকামীদের মধ্যে কনিষ্ঠতম একজন। সৎ আর নির্লোভ মানুষ ছিলেন, আর তাই জীবনের প্রতি পদে ধাক্কা খেয়েছেন। আমাদের এই আবদুর রেহমান প্রায়ই বলে থাকেন, "My father was the most successful failure in the world." দিল্লীর ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামায় ছোট ক্যান্টিন ছিল তার।
সেন্ট কলম্বাস স্কুলের ছাত্র ছিলেন রেহমান, দুপুর একটায় নিজের স্কুল ছুটি হয়ে গেলেই তার গন্তব্যস্থল হয়ে যেতো বাবার কর্মস্থল, শত অসাধারণ অভিনেতার জন্মদাতা এই এনএসডিতে। সেখানে তখন তারাদের আনাগোনা। রোহিনী হাতঙখড়ি, সুলেখা সিক্রি, রাজেশ বিবেক, রাজ বাবর, রঘুবীর যাদবের মতো অভিনেতারা রেহমানের সঙ্গী হয়ে উঠলেন, তাস খেলার সাথী, তাদের রিহার্সেলের বিচারক। কখনও অভিনয় করবেন, বা অভিনয়কে পেশা হিসেবে বেছে নেবেন- তা ভাবনাতেও ছিল না। কিন্ত বীজটা সেখানেই বপন হয়ে গিয়েছিলো, সেটা রেহমান বুঝতে পারেননি তখনও।
আচ্ছা এই নামটা বাদ দেই, আসল নামে আসি। ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামায় মঞ্চের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা বড় নাকওয়ালা ছেলেটার নাম শাহরুখ, শাহরুখ খান। বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক পারিশ্রমিক প্রাপ্ত অভিনেতা, যিনি মজা করে বলেন, শেষ দুটো ছবির প্রযোজক পুরো টাকাটা দিয়ে দিলে তিনিই এক নাম্বারে থাকতেন। নাম বদলানোটা জরুরীই ছিলো, এখন অন্তত মনে হয়। ডন স্টার্টিং ইন এন্ড এজ আবদুর রেহমান, শুনতেই কেমন যেন লাগতো না? ডনের চরিত্রে শাহরুখ নামটাই যেন সবচেয়ে মানানসই!
অন্তর্জালের কল্যানে সেলিব্রেটিদের জীবনের গলিঘুপচি এখন আমাদের জানা। শাহরুখের উত্থান থেকে শুরু করে বর্তমান অবস্থান নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই, যাই বলা হবে, সেটাই চর্বিত চর্বন মনে হবে। মায়ের মৃত্যুর পর বোম্বে এসেছিলেন সিনেমায় কাজ করতে। এর আগেই ফৌজি নামের এক সিরিয়ালে অভিনয় করে খানিকটা পরিচিতি জুটিয়েছিলেন।
কিন্ত দিল্লি থেকে আসা ছাব্বিশ বছরের এক যুবকের জন্যে বোম্বে শহরটা কুয়া থেকে সাগরে এসে পড়ার মতোই ছিলো। হাতে কাজ নেই, পকেটে পয়সা নেই, পেটে খাবারও নেই মাঝে মধ্যে, রাতটা পরিচিত কারো বাসার বারান্দায় কাটিয়ে দিচ্ছেন, এমন করেই শুরুর দিনগুলো পার করেছেন বলিউডের এই বাদশাহ। ভাগ্য একসময় খানিকটা মুখ তুলে তাকালো, "দিওয়ানা" দিয়ে যাত্রা শুরু, তারপর ডর, আনজাম, বাজীগর। সবগুলোতেই নেগেটিভ রোল। নায়কেরা সবসময় ভালো মানুষ হবেন- এই প্রচলিত ধারণা ভেঙ্গে দিয়ে খল চরিত্রে বাজীমাত করলেন শাহরুখ।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে যে ছবিগুলো করেছেন, তার সিংহভাগই অন্যদের ছেড়ে দেয়া কাজ; কাউকে না পেয়ে মন্দের ভালো শাহরুখ খানকেই বেছে নিয়েছিলেন নির্মাতারা, তেমন কোন আশাও ছিল না বোধকরি। সেখানেই শূন্যের উপর সাফল্যের অট্টালিকা গড়ার শুরুটা হলো। ‘দিওয়ানা’ সিনেমাটাও তেমনই। পরিচালকের প্রথম পছন্দ শাহরুখ ছিলেন না, ছিলেন আরমান কোহলী নামের একজন। শিডিউল জটিলতায় আরমান সরে গেলে আগমন ঘটে শাহরুখের। এই সিনেমায় মূখ্য চরিত্রেও ছিলেন না খান সাহেব, ঋষি কাপুর আর দিব্য ভারতীর সঙ্গে স্ক্রীন শেয়ার করেছিলেন শাহরুখ, তাঁর আগমনই ঘটেছিল সিনেমার মধ্যবিরতির পর।
দিব্য এবং শাহরুখ দুজনেই সে বছর ফিল্মফেয়ারে সেরা নবাগত অভিনেতা/অভিনেত্রীর পুরষ্কার জিতেছিলেন ‘দিওয়ানা’র জন্যে। এই সিনেমার ‘কোয়ি না কোয়ি চাহিয়ে’ গানটা দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল তরুণদের মধ্যে। অথচ এই সিনেমাটাই এখনও দেখা হয়নি শাহরুখের, কখনও হবেও না। কিং খান ঠিক করে রেখেছেন, নিজের প্রথম আর শেষ সিনেমা তিনি কখনোই দেখবেন না!
সোয়াশো কোটি লোকের দেশ ভারতের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তর্কসাপেক্ষে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি কিং খান, গত বেশ কিছু বছর ধরেই। যেখানেই হাত দিয়েছেন, সোনা ফলেছে, শেষ কয়েকটা সিনেমা বাদ দিলে। বিশাল জনসংখ্যার দেশে নিজের মার্কেটটা খুব ভালোভাবে ধরে রাখতে পেরেছেন তিনি। ভারতের সবচাইতে বেশী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পণ্যের দূত তিনি। এশিয়ার বিনোদন জগতে সবচাইতে বেশী আয় করা মানুষও। অভিনয়টা দারুণ করেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে তার চাইতেও ভালো বোঝেন বোধহয় ব্যবসাটা।
নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান খুলেছেন বেশ আগেই, আইপিএলে দল কিনেছেন, প্রথম দুই মওসুমে খেলায় ফল না থাকলেও, তাঁর মালিকানাধীন কেকেআর বাণিজ্যের বাজারে লক্ষী ঠিকই ঘরে তুলে নিয়েছে। ক্রিকেটে ব্যবসার সাফল্যে ভারতের সীমা ছাড়িয়ে পাড়ি জমিয়েছেন সুদূর ক্যারিবিয়ানে। অসম্ভব আত্নপ্রত্যয়ী, বিনয়ী এবং পরিশ্রমী এই ভদ্রলোকের জীবনে একটাই ভয়, কেউ তাঁর হাত দুটো না কেটে দেয়; আর তাই তিনি সব সিনেমাতেই তাঁর ট্রেডমার্ক পোজ দুই হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে যান।
স্বয়ং আমেরিকান প্রেসিডেন্ট শাহরুখের দুই হাত ছড়ানোর ভঙ্গি নকল করে দেখান, তার সিনেমার ডায়লগ উচ্চারণ করেন নিজেদের ভাষণে! নিজেকে যে অনন্য উচ্চতায় তিনি নিয়ে গিয়েছেন, সেখানে পৌঁছানোর কথা মানুষ কেবল ভাবতেই পারে, কল্পনার আশ্রয় নিয়ে। অনুপম খের এক টক শো-তে খান সাহেবকে প্রশ্ন করেছিলেন, রোজ মুম্বাই শহরে ৫০০/৬০০ লোক ফিল্মস্টার হবার স্বপ্ন নিয়ে আসে, তাদের অনেকেই ভীষণ পরিশ্রমী। তারা কেন তবে শাহরুখ হতে পারেন না?
শাহরুখের জবাবটা ছিল দারুণ- "স্টার হওয়ার আগে পরিশ্রম অনেকেই করে, কিন্ত একটা লেভেলে পৌঁছে যাওয়ার পর অনেকেই বিরতি দিয়ে দেয়; কিন্ত আমি দাবী করতে পারবো যে এখনও ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালে আমি সেই প্রথম দিনের মতোই উত্তেজনা বোধ করি, একটা শট দশবার বিশবার দিতেও আমার আপত্তি থাকে না। যে কোন ডিরেক্টর, নতুন হোক কিংবা পুরাতন, সে যেন বলতে পারে যে এই কাজটা শাহরুখের চাইতে ভালোভাবে কেউ করতে পারবে না। এজন্যেই আমি এখনও শাহরুখ খান।"
স্ত্রী আর তিন সন্তানকে নিয়ে সুখের সংসার। পঁচিশ বছরের বেশী সময় মিডিয়াতে কাটিয়ে ফেলেছেন, অসাধারণ সুন্দরী সব নায়িকার সাথে রোমান্স করেছেন রঙিন পর্দায়, কিন্ত ব্যাক্তিজীবনে দাগ লাগতে দেননি কখনও। এটাকেই বোধহয় আসল স্টারডম বলে। সন্তানদের নিয়েই তাঁর দুনিয়া, মেয়েকে বানাতে চান অভিনেত্রী। বইও লিখছেন মেয়ের জন্যে, তাঁর চোখে দেখা এই ইন্ডাস্ট্রির খুঁটিনাটি নিয়ে। অবসর সময় ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলেন লনে। স্ত্রী গৌরীকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন চলচ্চিত্রের ক্যারিয়ারের শুরুতেই। সিনেমা যেমন তাঁকে দুহাত ভরে দিয়েছে খ্যাতি আর ঐশ্বর্য্য, তেমনি ইন্টেরিয়র ডিজাইনার গৌরীও তাঁকে দিয়েছেন স্থিতিশীল দাম্পত্য জীবন আর ভালোবাসা। অসম্ভব রসিক ব্যক্তিত্ব শাহরুখ খান তাই শুধু স্টার নন, তিনি আইকন, আইডল, অনুকরণীয় আদর্শ।
৫৫ বছর আগের এই দিনে দিল্লিতে জন্মেছিলেন তিনি, যদিও বয়স তার কাছে একটা সংখ্যাই শুধু। এখনও তিনি দিনে চৌদ্দ-পনেরো ঘন্টা কাজ করেন, ঘুমান মাত্র চার-পাঁচ ঘন্টা। প্রযোজক যাতে ঝামেলায় না পড়েন, সেজন্যে ভাঙা পা নিয়েও চালিয়ে যান শুটিং। বোম্বের বান্দ্রায় এক রাতে লাকী বিরিয়ানী খাওয়ার পর যে ছেলের পকেটে পর দিন সকালে নাস্তা করার পয়সা ছিলো না, রাস্তায় দাঁড়িয়ে যে শাহরুখ সেদিন নিজের মনেই বলেছিলেন, এই শহর আমাকে ভীষণ জ্বালাচ্ছে, একদম পথে নামিয়ে দিয়েছে, একদিন শহরটাকে আমি জয় করবো। ইন্ডাস্ট্রিতে কাটানো আটাশটা বছর সাক্ষী, সাক্ষী সময়ের রথ; সেদিনের সেই শাহরুখ খান শুধু মুম্বাই শহর নয়, পুরো ভারত নয়, বিশ্বটাই জয় করে ফেলেছেন...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
আরও পড়ুন-