যে ভ্রূণ জানেই না কী অপরাধে তাকে ধ্বংস হতে হচ্ছে, এটা কি পরিকল্পিত খুনের চেয়ে ছোট অপরাধ? এবরশনকে খুব হালকা চালে দেখা হলেও এটাকে 'খুন' কেন বলছি, তা বলি...
একবার আমি কবুতর এনেছিলাম বাড়িতে একজোড়া, শখের বশে। অনেকদিন কবুতরগুলো একসাথে, খুব ভাল লাগত দেখে। একদিন আমার খুশির সীমা রইলো না। সেই সকালে কবুতরকে খাবার দিতে গিয়ে আমি দেখলাম একটা ডিম, সাদা রঙ, ছোট্ট কিন্তু কি সুন্দর লাগছিলো তখন! আমি এতটাই খুশি ছিলাম যে বাড়ির সবাইকে ডাকলাম, ডেকে এনে দেখালাম আমার কবুতরের ডিম। কবুতর পোষার ব্যাপারটি আম্মা পছন্দ করতেন না, কেনই বা করবেন! আমাদের ফ্ল্যাট বাড়ির ছোট্ট এক টুকরা বারান্দা। কবুতর রাখার কারণে কাপড় রোদে দিতে সমস্যা হতো। আম্মা সে কারণেই প্রথম দিকে মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন, সেই তিনিও যখন দেখলেন কবুতরের ডিমটা তাকেও খুব আনন্দিতই দেখাচ্ছিল।
সে সময় দাদী বেড়াতে এসেছিলেন, তিনি বললেন একুশ দিনে কবুতরের ডিম ফুঁড়ে বাচ্চা বের হয়৷ আমাকে বললেন, ডিমে হাত না দিতে, বারবার না দেখতে। ওই কটা দিন যেন কাটছিল না কিছুতেই! আমি বেশ অস্থির হয়ে থাকতাম। তখন স্কুলে পড়ি। এসব নিয়ে অস্থিরতা খুব অস্বাভাবিকও না। দিন গুনছিলাম, কখন একুশ দিন হবে। একদিন ঠিকই একুশতম দিবস চলে আসল। কিন্তু সেদিন ডিম ফুটল না। আমি ভাবলাম হতেই পারে দুই একদিন এদিক সেদিক! কিন্তু আরো কয়েকদিন কেটে গেলেও কিছুই হচ্ছিল না। আমার মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। খুব খারাপ লাগল যখন আরো এক সপ্তাহ কেটে যাবার পর দাদী বললেন, ডিমগুলো নষ্ট হয়ে গেছে, আর বাচ্চা হবে না। আমি কেঁদেছিলাম সেদিন।
ডিমগুলো যখন ভাঙলাম, তখন আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। অর্ধ-আকার নেয়া কবুতরের বাচ্চার আদল, মাংস-রক্ত-রসে জটিল আকারের সেই পিণ্ড। মরে আছে। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছিল এই প্রাণটা এভাবে নষ্ট হয়ে গেল। আরেকটু তাপ ঠিকঠাক পেলে, ওম ঠিকঠাক পেলে হয়ত ভ্রুণটা সুস্থ একটি বাচ্চা হয়ে বের হতে পারত। সামান্য কবুতরের বাচ্চার একটি ভ্রুণ নষ্ট হওয়া যদি এমন অনুভূতি দেয় তাহলে গর্ভে থাকা মানবশিশুকে গর্ভপাত ঘটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা কেমন লাগবে?
পত্রিকায় মাঝে মধ্যেই কিছু সংবাদ দেখা যায়, অমুক স্থানে ডাস্টবিনের পাশে নবজাতক শিশুকে পাওয়া গিয়েছে, অভিভাবকদের খোঁজ নেই। এরকম ঘটনা এই সময়ে এসে কিছুটা বেড়ে গিয়েছে। আমাদের বাড়ির ওইদিক থেকে কিছু দূরে জলার মতো জায়গা আছে৷ কিছু দিন আগে সেখানে তিনদিনের মৃত একটা বাচ্চার লাশ পাওয়া গিয়েছিল, কাঁথা মুড়ি দিয়ে কে এই শিশুটিকে রেখে গেছে কেউই জানে না।
এই বাচ্চাদের পৃথিবীতে নিয়ে আসার দায় কাদের? এই ধরনের বাচ্চা যারা দূর্ভাগ্যবশত এই ধরণীতলে এসে পড়ে, তাদের জন্মের আগেই প্রথম চেষ্টা করা হয় মেরে ফেলার। এবরশন, এই মৃত্যুর নাম। আমাদের দেশে এই সময়ে এসে অনেক টিনএজার, তরুণ, তরুণী সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা ইনসিকিউরিটিতে ভুগে। তাদের কারো কারো হয়ত ধারণা শারীরিক সম্পর্ক হওয়াটাই কমিটমেন্ট, তা না হলে এটাকে প্রেম বলেই মনে হবে না। সম্পর্কগুলোই কেমন যেন ‘চাহিদা’ সম্বলিত হয়ে যাচ্ছে।
সবার কথা জানি না, আশেপাশে বন্ধুবান্ধবদের অনেকের জীবনেই এমনটাই ঘটতে দেখেছি৷ দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শারীরিক সম্পর্ক হয়ে যাওয়ার কিছু দিন পর তাদের সম্পর্কগুলো থাকছে না। ঠুনকো কারণে ভেঙ্গে যাচ্ছে। তারচেয়েও ভয়ানক ব্যাপার হলো, এটাকে অনেকে ক্রেডিটের ব্যাপার বলে ভাবে৷ কাউকে কাউকে বলতে শুনেছি, ‘খাইয়া ছাইড়া দিসি’, ‘লং টাইম রিলেশন সম্ভব না’- এ ধরণের কথা! এসবের মধ্যেও দুয়েকজন বিপদে পড়ে যায়। যখন কনসিকুয়েন্স এড়ানো যায় না, মানে যদি কখনো এমন হয় মেয়েটা বুঝতে পারে সে প্রেগন্যান্ট, তাহলেই হলো!
এই বয়সের প্রেমে এরকম সময়ে কী টানাপোড়েন হতে পারে, সামাজিক অবস্থা কী হতে পারে, তা তো আমরা সকলেই জানি। ফলে সব কিছু লুকানোর জন্য প্রথম যে চেষ্টা তা হলো, এবরশন ঘটিয়ে ফেলা। কি ছেলেখেলা! কি পাগলামি! এ যেন হাসতে হাসতে খুন করে ফেলা। ভাবতে পারেন? একটা ভুল সিদ্ধান্ত, সাময়িক ‘কামনা’র বশে করে ফেলা ভুলের মাশুল কত বড়!
১৯৮৪ সালে একটি ডকুফিকশন হয়। ড. বার্নাড নাথানসন সেই ডকুফিকশনে দেখান যে, এবরশন করার আগে ভ্রুণ যে অসম্পূর্ণ অবস্থায় থাকে তারও অনুভূতি আছে, সেও ব্যাথা অনুভব করতে পারে, যখন এবরশন হয়, তখন সে মৃত্যুযন্ত্রণা টের পায়। যদিও এই ডকুফিকশনটি নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ আছে, তবুও একটি মানবসন্তান ভ্রূণের যে অনুভূতি আছে সেটি অনুমেয় নয় কি? আচ্ছা, যে ভ্রূণ জানেই না কী অপরাধে তাকে ধ্বংস হতে হচ্ছে, এই যে না জানা অবস্থায় তাকে ‘এবরশন’ করা হলো, এটা কি পরিকল্পিত খুনের চেয়ে ছোট অপরাধ?
মানবসভ্যতার ইতিহাসেই মানবশিশু হত্যা করার ব্যাপারটি আছে। আরব দেশে একসময় কন্যাশিশুকে মেরে ফেলার খবর তো ছোটবেলা থেকেই সকলে জানে। এছাড়া বিভিন্ন সভ্যতা শিশু হত্যা, ভ্রুণ হত্যা এসব চর্চা করেছে ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে বাঁকে। হয়ত, আজকের দিনে এবরশন নামক নৃশংসতাটি অবলীলায় করে ফেলা সেই অতীত মানবচরিত্রের ধারাবাহিক একটা বিবর্তিত মানসিকতা।
চায়নার কথা বলা যায়। চায়না তাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর অবস্থানে আছে অনেকবছর ধরে। ফলে সেদেশে গর্ভপাতের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বেশি। গর্ভপাত হয়ে যাওয়া ভ্রুণ নিয়ে কথিত আছে যে, এগুলো চায়নাতে খাওয়া হয় স্যুপের সাথে মিশিয়ে, যৌনশক্তিবর্ধক হিসেবে। এটাকে যদিও অস্বীকার করা হয়েছে, তবে যদি গোপনে হয়েও থাকে এরকম কান্ড অবাক হওয়ার কিছু নেই। একই কথা প্রচলিত আছে তাইওয়ানের ব্যাপারেও।
বাংলাদেশে গর্ভপাত/এবরশন বেড়েছে এই কবছরে বেশ আশংকাজনক হারে। বাংলাদেশে আইনত গর্ভপাত একটি অবৈধ কাজ, খুব ক্রিটিক্যাল কিছু ক্ষেত্রে হয়ত আইন শিথিল। তবে আইনের কার্যকারিতা কতটুকু কে জানে! গর্ভপাত ঘটছেই।
এবরশনকে খুব হালকা চালে দেখা হলেও এটা যে খুন তা কেন বলছি, বলি। স্বাভাবিক একটি ভ্রুণ যে বেড়ে উঠছে, কিছুদিন বাদে পৃথিবীর আলো বাতাসে আসবে, তাকে যখন এবরশন করা হয় তা বড়ই নির্মম প্রক্রিয়া। গর্ভে থাকা বাচ্চার বয়স যদি ১৫ সপ্তাহ হয় তখন এবরশন করানোর জন্য এক ধরণের লম্বা নল জরায়ুতে ঢুকিয়ে গর্ভের শিশুটিকে প্রথমে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়। পরে ভ্যাকুয়াম সাকারের মাধ্যমে শিশুটিকে শুষে আনা হয়। এজন্যে স্বাভাবিকের চেয়ে ২৯ গুণ বেশি চাপ প্রয়োগ করতে হয় ভ্যাকুয়াম সাকারে।
যদি বয়স আরো বেড়ে যায় তখন এবরশনের প্রক্রিয়া আরো নৃশংস রুপ নেয়। ১৬-২০ সপ্তাহের সময় গর্ভপাত করানোর ক্ষেত্রে স্যালাইন, ইউরিয়া বা প্রোস্টাগ্ল্যানডিন- এর মিশ্রণ ইনজেকশনের মাধ্যমে ভ্রূণের থলিতে প্রয়োগ করে সময়-পূর্ব প্রসব বেদনা সৃষ্টি করে ভ্রূণকে বের করে দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট জায়গাটা অসাড় করে এই কাজটি করা হয় এবং এক বা দু’দিন হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন হয় কখনো কখনো।
অবস্থা আরো বেশি জটিল হলে ডায়ালেশন এন্ড ইভাকুয়েশন পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়, এটা আরো বেশি জটিল এবং হিংস্র। লম্বা কাঁচির মতো ধারালো একটি যন্ত্র যাকে বলা হয় Sopher Clamp এটি প্রবেশ করিয়ে শিশুটিকে কাটাছেঁড়া করা হয় এবং তারপর বের করা হয়। মাত্র ২০ ভাগ শিশুর স্বাভাবিক গর্ভপাত হয়, বাদ বাকিদের নিজের অজান্তেই এভাবে খুন হতে হয়। তবুও এই নির্মম পরিণতিকে আপনি হত্যা বলবেন না? গুটম্যাকার এর সর্বশেষ জরিপ (২০১৪) বলছে, দেশে বছরে ১১ লাখ ৯৪ হাজার স্বপ্রণোদিত গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ, দৈনিক গড়ে এ ধরনের গর্ভপাতের সংখ্যা ৩ হাজার ২৭১টি।
এবং আপনি জেনে হয়ত ক্ষুব্ধই হবেন যে, আমাদের দেশে বিবাহিতদের চেয়ে অবিবাহিত কিশোরীদের এবরশন করানোর হার পঁয়ত্রিশ ভাগ বেশি। এ বছরই মে মাসে ইত্তেফাকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডাস্টবিন ও রাস্তায় যেসব অজ্ঞাত শিশুর লাশ পাওয়া যাচ্ছে তাদের ৯৯ ভাগই নবজাতক। শুধু মে মাসের ১৫ দিনেই ২৮ নবজাতক পাওয়া গেছে ডাস্টবিনের পাশে। বুঝতেই পারছেন কারা এই শিশুগুলোকে এভাবে রেখে পালিয়ে যায় জন্মের পর পর, অথচ প্রেমের সময়, কমিটমেন্ট আদায়, দেয়া কিংবা রক্ষা করার সময়, স্বপ্ন দেখানোর সময় হুঁশ থাকে না কারোই। এই হলো, আমাদের আধুনিকতা!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন