স্বাভাবিক হাসি হাসি মুখে ঘুরতে থাকা স্বামীটিকে দেখে মনে হচ্ছিলো, এক প্রকার প্রচ্ছন্ন অহংবোধ কাজ করছে যেন তার মধ্যে, এমন সেক্স করেছে সে, যে একেবারে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে, কতো বড় মর্দ সে!
এক
২০১৭ সালে পাশ করবার পর পর, আমার ইন্টার্নশিপ শুরু হয় গাইনী এন্ড অবস দিয়ে। আমি তখন সদ্য গোঁফ আসা কিশোরের মতো, সদ্য পাশ করা নবীন চিকিৎসক। যে রোগীই দেখি, অপার বিস্ময় নিয়ে ছুটে যাই সিনিয়র আপুদের কাছে, আপু এইটা কী, আপু এ ক্ষেত্রে কী করতে হবে। কী অসম্ভব ধৈর্য্যশক্তি নিয়ে আমাদের সিনিয়র আপুরা আমাদের শেখাতেন, এখন ভাবলে মনে পরে।
তো, তখন ঈদের সময়, রোজার ঈদ। আমাদের গ্রুপের এক মেয়ে ইন্টার্ন বিবাহিত, বিয়ের পরে প্রথম ঈদ শ্বশুরবাড়িতে করতে হবে, তার ছুটি দরকার। আরেক মেয়ে ইন্টার্ন, সেও গ্রামে ঈদ করবে বলে ছুটি নিলো। সচারচর দেখা যায়, গাইনী এন্ড অবস এ ছেলেরা ফাকিবাজি করে, মেয়েদের তুলনায়। ইতিহাসকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, আমি আর রহমান ঈদের আগে পরে মিলিয়ে, সেবার টানা ৫দিন ঈদের রোস্টার ডিউটি করলাম। ঈদের দিনের ঘটনা বলছি এখন একটা।
পড়ন্ত বিকেলের দিকে খুব জরুরী এক রোগী আসলো। অসম্ভব রুপবতী এক কম বয়েসী মেয়ে, দারুণ সুন্দর সাজগোজ করা, কিন্তু অজ্ঞান! পুরো মুখ, শরীর একদম কাগজের মতো শাদা হয়ে আছে, পরণের পায়জামা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মেয়েটির সাথে এসেছে তার স্বামী, শাশুড়ি আর শ্বশুরগৃহের আরও দুই-একজন। মেডিকেলে ডায়াগনোসিস এর জন্য হিস্ট্রি নেয়ার কোন বিকল্প নেই। হিস্ট্রি নিতে গিয়ে জানা গেলো- ছেলে ও মেয়েটি সদ্য বিবাহিত। ঈদে তারা দুইজন গিয়েছিলো গাজীপুরে এক রিসোর্টে। সেখানে তার স্বামীটি তার সাথে যৌন মিলনে অংশ নিলে, মেয়েটির যোনীপথ ছিড়ে যায়, যাকে আমরা বলি পোস্ট কয়টাল টিয়ার, এবং সেখান থেকে তুমুল রক্তপাত হতে থাকে। বাধ্য হয়ে তারা মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে।
আপুদের দেখলাম হুরোহুরি করে কাজে নেমে গেলো। আমাদের মতো পিচ্চিদেরকে বললো, তাড়াতাড়ি রক্ত ম্যানেজ করতে। আমরা রোগীর লোককে জানালাম, চতুর্থ শ্রেণির যারা ওয়ার্ডে কাজ করেন, আমরা তাদের দাদু বলে ডাকি, দাদুদেরকেও জানালাম, যতো দ্রুত সম্ভব রক্ত ম্যানেজ করতে। রোগীর লোককে জানাতে গিয়ে শুনলাম, শাশুড়ি তার সাথের আরেকজনকে বলছে, ‘যত্তোসব ঢং! আমাগো যেনো বিয়া হয় নাই কোনদিন!’
আমার মনে হলো, আমি বা আমরা কেন বেঁচে আছি? কীসের মানুষ, কীসের বিবাহ, কীসের পরিবার? এইসব মেকি, এইসব বানোয়াট। এগুলো শুধু লোক দেখানো আচার-বিচার। স্বাভাবিক হাসি হাসি মুখে ঘুরতে থাকা স্বামীটিকে দেখে মনে হচ্ছিলো, এক প্রকার প্রচ্ছন্ন অহংবোধ কাজ করছে যেন তার মধ্যে, এমন সেক্স করেছে সে, যে একেবারে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে, কতো বড় মর্দ সে! বাবারে বাবা!
আমার পায়ের নিচে মাটি সরে যায় ভাবলে, এটাকে আমরা বলি সিভিলাইজেশন? একটা ১৭-১৮ বছরের একটি মেয়ে, কতো স্বপ্ন, সম্ভাবনা চোখে নিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থাকা একটি মেয়ে, মেয়েটার এখন কলেজে চোখ মুখ বন্ধ করে পড়াশুনা করবার কথা, তুমুল প্রতিযোগীতা করে ভালো ইউনিভার্সিটিতে পড়বার কথা, আড্ডা দেবার কথা, হেড়ে গলায় গাইবার কথা, বন্ধুবান্ধবীদের সাথে বর্ষায় সিলেট শ্রীমঙ্গল, শীতে বান্দরবান ঘুরতে যাবার কথা, আরেকটু বড় হলে ভারত, নেপাল, আরেকটু বড় হলে আরও দূরে। সে কি না হাসপাতালে পরে আছে, স্বামীর মর্দে জোয়ানগিরির শিকার হয়ে? তার কে আছে? স্বামী? শাশুড়ি? কে তার আপন? এ দেশে বাবা-মাও কি বিয়ের পরে মেয়ের জীবন এ কোন বড় পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে আর? এই যদি হয় বিয়ে, এই যদি হয় পরিবার, এই যদি হয় সংসার, তবে আমার সন্দেহ প্রকটতর হয়, সহস্রাব্দি ধরে চলে এই প্রাচীন পন্থার কোথাও খুব বড় কোন ভুল রয়ে গেছে।
আমার তৎকালীন সিএ’র হাতের কাজ বেশ ভালো হলেও, খুব একটা লোক ভালো ছিলো না। তাকে এসে এসব জানাবার পরে তিনি শাশুড়িকে ডেকে যা শোনালেন দু চার কথা, আমার কান গরম হয়ে গেলেও অন্তর শান্তি পেয়েছিলো। তবে পরবর্তীতে জেনেছিলাম, চিকিৎসককে হতে হয় র্যাশনাল, নন-জাজমেন্টাল। পেশেন্ট আমাদের কাছে মুখ্য, আর কিছুই নয়, এসব দেখভাল করবে সোশাল ওয়েলফেয়ার টাইপ সংস্থা, আইন শৃংখলা বাহিনী, চিকিৎসকের কাজ শুধুই চিকিৎসা করা, আর প্রয়োজনীয় কাউন্সেলিং করা।
দুই
টাঙ্গাইলের বাসাইল এ, কিছুদিন আগে ১৪বছর বয়েসী এক মেয়ে নিহত হয়েছে। মৃত্যুর কারণ ছিলো, এই পোস্ট কয়টাল টিয়ার। ১৪বছর বয়েসী নুরনাহার নামের মেয়েটির বিয়ে হয়েছিলো ৩৪ বছর বয়স্ক প্রবাসী রাজিব খান নামের এক লোকের সাথে। ১৪ সংখ্যাটিকে দুই দিয়ে গুন করলে পাওয়া যায়, আটাশ, যেটি ৩৪থেকে ৬ কম। অর্থাৎ, নুরনাহারের দ্বিগুন বয়সের থেকেও ছয় বছর বেশী লোকটি, বিবাহের রাতেই পাশবিকভাবে ঝাপিয়ে পরেছিলো নুরনাহারের উপর।
রক্তাক্ত করেও সে থেমে থাকেনি। যে রক্তাক্ত পথ দিয়ে একদিন সে পৃথিবীর মুখ দেখেছিলো, সেই রক্তাক্ত পথকে সে রেহাই দেয়নি, সে জোরপুর্বক সঙ্গম চালিয়ে গিয়েছে। সেদিনের পরেও আরও ৩৪টা দিন নুরনাহার বেঁচে ছিলো। কিন্তু তার কোন চিকিৎসা করানো হয়নি। শ্বশুরগৃহ বাদ দিলাম, তার আপন মা-বাবাও এগিয়ে এসেছিলো বলে জানা যায়নি।
একবার নিজের ১৪ বছর বয়সের কথা চিন্তা করুন, ক্লাস এইট কি নাইন এ পড়েন আপনি তখন। স্কুলের স্মৃতি, স্কুল পালানোর স্মৃতি, চুরি করে গাছের ফল পারবার স্মৃতি, বন্ধু বান্ধবী-ভাইবোনদের সাথে খুনসুটির স্মৃতি, সর্বোপরি বয়সন্ধির প্রথম প্রচণ্ড ধাক্কায় প্রথম কাউকে ভালো লাগবার স্মৃতি। নুরনাহার ঠিক সে বয়সটায় খুব কষ্ট পেয়ে, ৩৪টা দিন ভুগতে ভুগতে মারা গিয়েছে। সে সাথে করে নিয়ে গিয়েছে, বিকট অস্ত্ররুপী পুং লিংগের স্মৃতি, অমানবিক খুনী একটা শ্বশুরগৃহের স্মৃতি, অসহযোগী বাবা-মায়ের স্মৃতি। কী নিষ্ঠুর স্মৃতি নিয়ে মেয়েটা চলে গিয়েছে, চিন্তা করতে পারেন? আপনার কন্যা, আপনার বোন এর দিকে তাকান তো, নুরনাহারের জায়গায় বসাবার সাহস হয়?
তিন
তবে আমাদের সমাজে কিছু সাহসী মানুষ আছে। তাদের নিজেদের কন্যাকে, বোনকে নুরনাহারের জায়গায় বসাবার মতো সাহস প্রচণ্ড। শুধু যে প্রচণ্ড তাই না, তারা হাজার হাজার, লাখো মানুষের সমাবেশে রীতিমতো তর্জন-গর্জন করে যে নিজেদের কন্যাদেরকে নুরনাহার হতে দিতেই হবে, নাহলে তারা দেখে নেবে! বিশ্বাস হয় না?
আপনি ইউটিউবে খালি ‘বাল্যবিবাহ ওয়াজ’ এতোটুকু সার্চ করুন, দেখুন কতো ‘শ ভিডিও আসে। আল্লামা তারেক মনোয়ার, মাওলানা মাহমুদুল হাসান গুনবী এদের লক্ষ কোটি ভিউ সমৃদ্ধ ওয়াজ দেখুন, দেখবেন মাওলানা গুনবী গর্জন করছেন যে, বাল্যবিবাহ আইন ইসলাম বিরোধী। আল্লামা তারেক মনোয়ারের ওয়াজ দেখেন, তিনি বলছেন যে, নয়-দশ বছর বয়সেই একটা মেয়ে এডাল্ট হয়ে যায়। যে শব্দটা বয়ঃসন্ধি, সেটাকে তিনি ইংরেজিতে বলছেন এডাল্টনেস অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক।
কী করার আছে আপনার-আমার? সরকার বাল্যবিবাহ রোধে আইন করবে, আপনার আমার ট্যাক্সের টাকা খরচ করে সে আইন বাস্তবায়ন করবে, বিভিন্ন গণমাধ্যমে পয়সা খরচ করে বিজ্ঞাপন দেয়াবে আর এই সব আয়োজন এক ওয়াজের ফুঁৎকারে উড়ে যাবে।
প্রশ্ন আপনার কাছে, সমাধানও আপনার কাছে। আপনি কি নিজের ঘরে, নিজের সন্তানকে নুরনাহারের স্থলাভিষিক্ত করতে চান কি না। যদি না চান, তবে যারা চায়, আপনি তাদের পক্ষে কি না। আপনি তাদের পক্ষে না হলে, তাদের ঠেকানোর জন্য আপনি কী করছেন?
আরও পড়ুন- ম্যারিটাল রেইপ: সমাজের পোশাকি ভদ্রতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক ভয়াবহ ব্যাধির নাম
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন