''চারপাশে তথাকথিত শিক্ষিত অথর্ব মেয়েদের কীর্তি দেখে আজ তাহমিনার গল্পটা শেয়ার করলাম। আমার দেখা সাহসী, বুদ্ধিমতী, আত্মবিশ্বাসী, অধিকারসচেতন আর আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন একটা মেয়ে।''
এই যে দেখছেন মেয়েটিকে, ওর নাম তাহমিনা। ঢাকায় আমার বাসায় প্রায় চার বছর কাজ করেছে। আমি নেপালে আসার সময় পুরা বাসা গুছিয়ে দিয়েছে এবং আমি চলে আসার পর বাসার সব জিনিস গুছিয়ে তুলে রেখেছে সযত্নে। আমি নিজেও জানি না, কোথায় কী রেখেছে। ঢাকায় গেলে ওকে ফোন দিই, ও বলে দেয় কোথায় কী আছে!
তো আজ তাহমিনার গল্পটা বলি। তাহমিনা যখন আমার বাসায় কাজে এলো তখন তার গলা বেশ ফোলা। সে আমাকে বলল, তার গলগণ্ড হয়েছে। অপারেশন করতে হবে। টাকা দরকার। এজন্য সে কাজ নিয়েছে। কিছুদিন পর সে আমার সাথে আগারগাঁওয়ের নাক কান গলা ক্যান্সার হাসপাতালে গেল এবং জানা গেল তার রক্তে হিমোগ্লোবিন অতিরিক্ত কম। ডাক্তার বললেন, আগে হিমোগ্লোবিন বাড়াও।
তো হিমোগ্লোবিন বাড়বে কীভাবে? সে যা খাবার রান্ধে, তার রিকশাওয়ালা স্বামী একাই তার অর্ধেকের বেশি খেয়ে নেয়। এমনকি আমি তাকে একটা হরলিক্স কিনে দিলেও সেই লোক দুই দিনে পুরা ৫০০ এমএল সাইজের হরলিক্স শেষ করে ফেলল, একা। (ওই লোকের কিন্তু বেশ আয় রোজগার ভাল। সে নিজেই আমাকে বলত।)
আমি তাহমিনাকে বললাম, ‘এভাবে তো চলতে পারে না। তোমাকে খেতে হবে।’ প্রচুর রাগারাগিও করলাম। তাহমিনা তখন ঘুরে দাঁড়াইলো। স্বামীকে স্পষ্ট করে বলল, আমার হিমোগ্লবিন ১২তে আনতে হবে, যেভাবেই হোক। তুমি আমারে রোজ দুধ ডিম আর কলা এনে দেবা। আর আপার বাসা থেকে যা আনব, সেটা আমাকে খেতে দেবা।
তো দুই মাসে হিমোগ্লোবিন ঠিক হল। এরপর ধানমন্ডিতে একটা ল্যাবে ক্যান্সার টেস্ট দিলেন ডক্টর। যেদিন টেস্ট রেজাল্ট হাতে পেলাম, সেই দিনটা আমার মনে থাকবে। লেখা আছে, ক্যান্সার। থাইরয়েড ক্যান্সার। আমার মাথা ঘুরতে লাগল। কী করি! ওর ডক্টরের ফোন নাম্বার খুঁজে বের করলাম, ফেবুতে যোগাযোগ করে। এরপর বিরাট ইতিহাস।
‘ও নেগেটিভ’ ব্লাড তাহমিনার, বিরাট হুজ্জত করে রক্ত যোগার হল। ক্রিটিক্যাল অপারেশন সফলভাবে শেষ করলেন ড. আলী ইমাম আহসান। প্রায় চার পাঁচ ঘণ্টা ধরে অপারেশন চলল। এরপর কয়েকদিন হাসপাতাল বাস। এইসময় হাসপাতালে যতবার খাবার দিতাম, ওর জামাইকে থ্রেট দিতে হত, যেন খাবারটা পুরাটাই তাহমিনাকে খাওয়ানো হয়।
এরপর কেমো পর্ব। প্রায় এক বছর পর বেশ সুস্থ হয়ে গেল তাহমিনা। নতুন জীবন। আমার এখনো ওকে দেখলে অবাক লাগে। তো তাহমিনার জামাই এদিকে আরেক বউ পালে। এই নিয়ে অশান্তির শুরু। তাহমিনা মেনে নেবে না। ঝগড়ার এক পর্যায়ে গায়ে হাত দিতে এলেন বীরপুঙ্গব স্বামী।
সাথে সাথে একটা কাঠের টুল দিয়ে উল্টা মাইর দিল তাহমিনা। চ্যাঁচায়ে লোক জরো করল বস্তিতে। এবং সবাইকে নিয়ে সালিশ বসায়ে স্বামীকে বাধ্য করল সবার সামনে কথা দিতে যে আর কোনদিন সে বউকে মারবে না এবং ঠিকমত খেতে দেবে। আর কথা না শুনলে আমাকে জানাবে, আমি পুলিশ দিয়ে ওরে হাজতে পাঠাবো।
এই অভিযান শেষে হাসিমুখে আমার বাসায় এসে এই গল্প করে হাসতে হাসতে গড়ায়ে পড়ছিল তাহমিনা। আমি মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম। এরপর তাহমিনা আমার সাথে আলোচনায় বসল। ‘আপা, তুমি চলে গেলে আমি আর থাকবো না ঢাকায়। ও তো ওর ওই বউ ছাড়বে না। আমি কেন তাহলে ওর সাথে থাকবো? তুমি আমাকে একটা ব্যবস্থা করে দেবা যেন দেশে গিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ায়ে চলতে পারি।’
তো নেপাল চলে আসার আগে সাধ্যমত যা পারি দিলাম। দুই বউওয়ালা জামাইরে ছেড়ে সেই টাকা নিয়ে চলে গেল গাইবান্ধায়, এরপর সেখানে হাঁস মুরগীর ছোট একটা খামার দিয়েছে আর একটা জমি ছিল সেটাতে অনেক গাছ নাকি লাগানো হয়েছে।
খুব ভাল আছে তাহমিনা। কথা হয় ফোনে। আমার দেখা সাহসী, বুদ্ধিমতী, আত্মবিশ্বাসী, অধিকারসচেতন আর আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন একটা মেয়ে। চারপাশে তথাকথিত শিক্ষিত অথর্ব মেয়েদের কীর্তি দেখে আজ তাহমিনার গল্পটা শেয়ার করলাম।
ওকেও অনেক বকা দিতাম, রাগ হতাম যদি মেরুদণ্ড সোজা করতে না পারতো। ও সত্যিকার মানুষ ছিল বলে সেই বকা থেকে সারসত্যটা উদ্ধার করতে পেরেছে আর কাজে লাগিয়েছে। জয় হোক তাহমিনা তোমার। অনেক ভালবাসি।