প্রশংসা কিংবা গালি- আত্মহত্যার প্রতিক্রিয়ায় দুটোই অপ্রয়োজনীয়
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
গতকাল যে তরুণ আত্মহত্যা করেছে সেটাও এক অর্থে প্রেমের কারণে সুইসাইড। পার্থক্য কেবল এখানে প্রেমটা প্রেমিকার সাথে না, পিতার সাথে। পিতার শোকে কেউ আত্মহত্যা করতে পারে এটা আপনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়?
আত্মহত্যা বিষয়ক যে কোনো খবর বা পোস্টের নিচে সবচেয়ে জনপ্রিয় কমেন্ট যেটা হয় "ছেলেটা/মেয়েটা তার বাবা-মায়ের কথা একবারও ভাবল না!" এই লাইনের আগে পরে কেউ গালি বসায়, কেউ আফসোস বাক্য।
গতকাল একেবারে রিভার্স একটা ঘটনা ঘটে গেছে। পিতার মৃত্যুর শোক সইতে না পেরে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক তরুণ আত্মহত্যা করে বসেছে! একদম ভিন্ন রকম একটা কেস স্ট্যাডি।
প্রথম আলোর খবরে প্রকাশ, বাবার মৃত্যুর পর ছেলেটি ফেসবুকে একটা পোস্ট লিখে যেখানে পিতাকে উদ্দেশ্য করে বলা ছিল, "আমার আব্বা আমার দুনিয়া, আমার সব। অবশ্যই আমি তার সঙ্গী হবো। আব্বাকে আমি একা ছাড়ব না।"
এই পোস্ট লেখার এক ঘন্টা পর গলায় মাফলার পেঁচানো অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করা হয়।
আত্মহত্যাকে যারা খুব সরলীকরণ করেন, যারা প্রতিটা আত্মহত্যার পর "কাপুরুষ" "বাবার কথা ভাবল না" "পরিবারের কথা ভাবল না"- ধরণের বাক্য ব্যবহার করেন তারা এবার কী বলবেন?
আমি বহুদিন ধরে একটা কথা বলি, আত্মহত্যা কোনো নির্দিষ্ট মোটিভে হয় না। স্রেফ প্রেম ভেঙে যাওয়ার শোকে কেউ জীবন শেষ করতে পারে না৷ আত্মহত্যার কারণ হিসেবে যে ফ্যাক্টরগুলো জনপ্রিয় তার কোনোটাই আত্মহত্যার মূল কারণ নয়। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে আত্মহত্যা একটা চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে।
মানুষ স্ট্রোক করে। হঠাৎ করেই দেখা যায় একটা লোক পড়ে গেছে, তারপর মারা গেল। আপনার কী মনে হয়, এই স্ট্রোকের প্রক্রিয়াটা ঠিক সেই মুহুর্তেই ঘটছিল? মোটেও না। এই লোকটি দীর্ঘদিন ধরে প্রেশারে ভুগছিল। প্রেশারও এক দিনে বাড়ে না। এখানেও সময় লেগেছে। এখানেও কিছু জিনিস প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।
একটা সময় পরে পরিণতি প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছে। সব কারণ মিলে তৈরি করে নিয়েছে মঞ্চ, অপেক্ষা করেছে নির্দিষ্ট মুহুর্তের। সেই নির্দিষ্ট মুহুর্তটা হয়তো এসেছে অন্য কারো হাত ধরে। রোগী লোকটা কোনো কারণে মেজাজ দেখিয়েছে, ব্যাস ঘটে গেছে ঘটনা। স্ট্রোক করে ঢলে পড়েছে।
এখন আপনি কী বলবেন, স্ট্রোকের কারণ উত্তেজনা? খালি চোখে যেহেতু উত্তেজিত হওয়াটাই দেখা গেছে, তাই এটাকেই একমাত্র কারণ হিসেবে দেখবেন? নিশ্চয়ই না।
আত্মহত্যার ব্যাপারটাও তাই৷ মানুষ তার নিজের অজান্তেই মানসিক প্রতিরোধের দেয়াল ক্ষয় করে ফেলে। কারো কারো দেয়াল আবার জন্ম থেকেই দুর্বল ও অসম্পূর্ণ থাকে। একেকটা ছোটো বড়ো আঘাত আসে, দেয়াল ক্রমশ দুর্বল হয়। সর্বশেষ আঘাতে যখন দেয়াল ভাঙে, মানুষ আত্মহত্যা করে বসে; আমরা কেবল সেটাকেই দেখি। ধরে নিই পুরো দেয়াল ভাঙার কারণ বোধহয় এই একটা আঘাত।
এই একটা পয়েন্টে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।
গতকাল যে তরুণ আত্মহত্যা করেছে সেটাও এক অর্থে প্রেমের কারণে সুইসাইড। পার্থক্য কেবল এখানে প্রেমটা প্রেমিকার সাথে না, পিতার সাথে। পিতার শোকে কেউ আত্মহত্যা করতে পারে এটা আপনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়?
বাবাকে কে না ভালোবাসে? আমি ভালোবাসি, আপনিও ভালোবাসেন। আমারও প্রায়ই মনে হয় বাবাবিহীন দুনিয়াতে আমি কীভাবে থাকব? কেবল বাবা না, পরিবারের যে কারো মৃত্যু আমি ভাবতেও পারি না। বুক ধড়ফড় করে। একই অনুভূতি সম্ভবত সবারই হয়। কিন্তু তাই বলে আত্মহত্যা!
এই ছেলেটার হয়তো ইমোশনাল ডিজঅর্ডার ছিল। হয়তোবা একাকিত্ব ছিল, নইলে ছিল অন্য কোনো মানসিক টানাপোড়েন। বাবার মৃত্যু তার চিন্তা- যুক্তি, বিশ্বাস-বাস্তবতাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। সে বেছে নিয়েছে সবচেয়ে কঠিনতম পথ।
খবরের লিংকের কমেন্ট বক্সে দেখলাম সবাই পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবেই ছেলেটার পিতৃপ্রেমের প্রশংসা করছে। উহু আহা করছে। এসবের দরকার ছিল না। কেউ আত্মহত্যা করলে প্রশংসা বা গ্লোরিফিকেশনের দরকার নেই। দরকার নেই গালি দেবারও।
কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতিটা আত্মহত্যাকারী মানসিক রোগী। সম্ভব হলে নিজের পরিবার-আত্মীয় বা বন্ধুদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি কেয়ারিং হোন। তার আগে কেয়ার করুন নিজেকে। আগামীকাল আপনার জীবন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, আপনার মনের অবস্থা কী হবে- এর নিশ্চয়তা আপনি দিতে পারবেন?
গত কিছুদিন আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল তার পছন্দের ছেলেকে প্রত্যাখান করে ফ্যামেলি আরেকজনের সাথে বিয়ে দিতে চাইছিল।
অবাক করা ব্যাপার হলো, চার বছর সময়ে তার কোনো ক্লাসমেট মেয়েটার মুখ দেখেনি। হিজাব ও পর্দার প্রতি মেয়েটা এতটাই সিরিয়াস ছিল যে একদিনের জন্যেও সেখানে ছাড় দেয়নি। এমন ধার্মিক মেয়েকেও মরতে হয়েছে তথাকথিত "প্রেমের কারণ" নামক বিশ্রি অপবাদ মাথায় নিয়ে।
আত্মহত্যা বাড়ছে, আত্মহত্যা আরো বাড়বে বলেই আশংকা। বিচিত্র সব কারণ ও সিচুয়েশনে মানুষ আত্মহত্যা করছে, করবে। আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন যেমন জটিল হচ্ছে চ্যালেঞ্জিং হচ্ছে তাতে এই দানবকে প্রত্যেকেরই ভয় পাওয়া উচিত৷ ভয়ের পাশাপাশি গুরুত্ব ও যত্ন দেয়া উচিত এমন রোগের রোগীদের।
সবার দিন ভালো কাটুক।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন