আত্মহত্যা নিয়ে মুখরোচক আলোচনা কবে বন্ধ করব আমরা?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

কেউ মারা গেছে এবং সে জাহান্নামে যাবে; তাতে আপনার ক্ষতি কী? আপনি কেন তাকে কাপুরুষ আখ্যা দিতে যাবেন? কেন জাহান্নামে পাঠিয়ে দেবেন? কেন ঘৃণা করার উদাত্ত আহবান জানাবেন? এই অধিকারটা আপনাকে কে দিয়েছে? আপনি সিম্প্যাথি জানালেই বা তার কি আসে যায়?
এক
কেউ যদি আত্মহত্যা করে থাকে, সেই মৃত্যুর প্রভাবক হিসেবে প্রত্যক্ষভাবে কোনো ক্রিমিনাল বা সোশ্যাল ফ্যাক্ট কাজ না করে এবং ব্যক্তিগত জীবনে সে আপনার পরিচিত বা ঘনিষ্ঠ না হয়, তার প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে পোস্ট দেয়া থেকে বিরত থাকুন। বিশেষত তার নাম-পরিচয় এবং অতীত জীবনের কাহিনী-ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট ছড়াবেন না।
কেন এটা করবেন না?
কারণ আত্মহত্যা কেবলই একটা ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা। আপনি ভিক্টিমের পরিচিত নন, ভিক্টিম জীবিত থাকা অবস্থায় আপনার থেকে সিম্প্যাথি আশা করেনি। মৃত্যুর পরেও আপনার সিম্প্যাথি তার জন্য কোনো কাজে আসছে না।
বরং ক্ষতি যা হচ্ছে, এত আলোচনা ডিপ্রেশনের টার্মিনাল পয়েন্টে থাকা মানুষগুলোর জন্য ট্রিগার পয়েন্ট হিসেবে কাজ করবে। উন্নত দুনিয়ার কিছু দেশ সুইসাইডের ক্ষেত্রে কপি ক্যাট ইফেক্টের ভয়ে পত্রিকায় পর্যন্ত খবর ছাপাতে দেয় না। আমাদের দেশের পত্রিকাওয়ালাদের অবশ্য টিআরপি দরকার। তারা ডিরেক্ট খবর ছাপায় অসভ্য শিরোনাম দিয়ে "প্রেমিকার জন্য আত্মহত্যা করলেন অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।" মানে একটা মৃত্যুর কারণকে কত সহজে সরলীকরণ করা হয়ে গেল।
আপনি যদি মনে করেন এই আত্মহত্যা আপনাকে নাড়া দিয়েছে, তাহলে প্রথমে নিজের প্রতি যত্নশীল হোন। নিজেকে মোটিভেট করুন। তারপর আপনার একদম কাছে যারা আছে, যেমন পরিবার-আত্মীয় ও বন্ধুদের মাঝে কে ডিপ্রেশনে থাকতে পারে তাকে শনাক্ত করার চেষ্টা করুন৷ সেই মানুষটিকে সাপোর্ট দিয়ে যান।
বেহুদা অপরিচিত একটা মানুষের সারা বছরের পোস্টের স্ক্রিনশট ছড়িয়ে দিয়ে আপনার নিজের বন্ধুটিকে কপি ক্যাটের ফাঁদে ফেলতে সাহায্য করবেন না।
তবে আগেই বলেছি, যদি কোনো ক্রিমিনাল অফেন্স থাকে বা ম্যাসিভ সোশ্যাল ফ্যাক্টর কাজ করে সেটা ভিন্ন কথা। একটা ছেলে রেসিজমের শিকার হয়ে সুইসাইড করেছিল, এটা নিয়ে আলোচনা জরুরি। ধর্ষণের পর বিচার না পেয়ে অপমানে আত্মহত্যা খুব কমন ঘটনা আমাদের দেশে, এসব নিয়ে কথা বলা দরকার।
তবে সেখানেও যেন "আত্মহত্যা" ড্রাইভিং সিটে না বসে। সেখানে আলোচনার মূল পয়েন্ট থাকবে রেসিজম বা ধর্ষণ এবং এর প্রেক্ষিতে একটা খুন।
ভিক্টিমের পরিচিত বা ঘনিষ্ঠদের জন্য বলার কিছু নেই। তারা ফেসবুকে পোস্ট দেবেন নাকি দেবেন না সেই বিবেচনা তাদের কাছে।

দুই
আরেকবার বলি, আত্মহত্যা একটা ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা। কেউ আত্মহত্যা করার পর সিম্প্যাথি দেখানোর পাশাপাশি আরেক পক্ষ দাঁড়িয়ে যান ঘৃণা আর বুলিং এর ডাস্টবিন হাতে নিয়ে।
কেউ মারা গেছে এবং সে জাহান্নামে যাবে; তাতে আপনার ক্ষতি কী ভাই? আপনি কেন তাকে কাপুরুষ আখ্যা দিতে যাবেন? কেন জাহান্নামে পাঠিয়ে দেবেন? কেন ঘৃণা করার উদাত্ত আহবান জানাবেন? এই অধিকারটা আপনাকে কে দিয়েছে?
আপনার যুক্তি আমি জানি। সেই লজিক নিয়েই এক নাম্বার পয়েন্টে কথা বলেছি। আপনি বলছেন আত্মহত্যাকারীর প্রতি সিম্প্যাথি দেখালে আরো মানুষ মোটিভেট হয়ে যাবে আত্মহত্যা করার জন্য- আমি একমত।
কিন্তু আপনি যেই উদ্দেশ্য ঘৃণার কথা বলছেন, আপনার নিজের কথাই সে উদ্দেশ্য ব্যহত করে দিচ্ছে। আপনার ঘৃণাবাদ প্রথমত মৃত্যুকে আরেকবার আলোচনায় নিয়ে এসেছে। এটা ভালো না। এরপর আপনি যে সুইসাইড করল এবং যারা পটেনশিয়াল সুইসাইডাল তাদেরকে কথা দিয়ে যেভাবে আঘাত করলেন তাতে পটেনশিয়ালদের জীবন ব্যাপারে আরো বেশি ক্ষোভ তৈরি হবে না?
ধরুন সিগারেট খেলে ক্যান্সার হতে পারে, সবাই জানে। আপনি পোস্ট দিলেন "যারা সিগারেট খায় এদেরকে ঘৃণা করুন"। এই কথাগুলোর ইফেক্ট কী হবে ভাবুন। স্মোকারদের ক্ষুদ্র একটা অংশ আপনাকে সচেতন মানুষ মনে করে আপনার কথাকে পজেটিভভাবে নিতে পারে। কিন্তু বড়ো অংশই বিক্ষুদ্ধ হবে কিনা? তারা যদি বিক্ষুদ্ধ হয় তাহলে সিগারেট খাওয়া বাড়াবে নাকি কমাবে?
আর প্লিজ, কেউ মারা যাবার পর "জাহান্নামে গেল" "বাপ মায়ের কথা ভাবল না" এসব ন্যাকা বাক্য ছুঁড়বেন না। আপনি জান্নাতে যাবেন এই কনফার্মেশন কোথায় পেলেন? আপনার পরিবার-আত্মীয় স্বজন সবাই জান্নাতে যাবে? যদি সন্দেহ থাকে তবে নিজের বা নিজেদের জান্নাত আগে কনফার্ম করার চেষ্টা করুন। আরেকজনকে জান্নাতে নেয়ার ব্যাপারে আপনার এত গরজ কেন ভাই?
মা-বাবার কথা ভাবে কী ভাবেনি, বা আদৌ তার বাবা মা জীবিত আছেন কিনা তাও তো আপনি জানেন না। আপনি নিজেই বাবা মায়ের কথা কেমন ভাবেন? নিজে জিন্দা থাকলেই বাবা মায়ের কথা খুব ভাবা হয়ে যায়?
যে মারা গেছে তার বাবা মায়ের কাছে তারচেয়ে আপনি বেশি প্রিয় না। মারা যাওয়া ছেলে মেয়ের প্রতি তাদের রাগ বা ক্ষোভ থাকতেই পারে। কিন্তু আপনি অপরিচিত একটা লোক "মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি" দেখিয়ে তাদের মৃত ছেলে মেয়েকে গালি দিয়েছেন জানলে তারা আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে নাকি আপনাকেই ঘৃণা করবে সেটা নিজেই ভেবে নেন।
তিন
উপরের দুইটা পয়েন্টের সারমর্ম, যেই সুইসাইড একান্ত ব্যক্তিগত, জাস্ট লেট ইট গো। এটা নিয়ে কিছুই বলা উচিত না। যত কম কথা বলবেন ততই ভালো।
"কিন্তু ভাই, আপনিও তো একটা লেখা ফেঁদে দিলেন!"
হ্যাঁ দিলাম। তবে এখানে ভিক্টিমের কোনো নাম পরিচয় রাখিনি। ইভেন যেখানে সম্ভব হয়েছে "সুইসাইড" শব্দকে রিপ্লেস করে "মৃত্যু" লিখেছি। মনে হচ্ছিল এই ব্যাপারটা ভিন্ন এংগেল থেকে দেখা উচিত।
আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সুইসাইড রেট আরও বাড়বে, এটা অনুমিত। আপনি নিজের ও পরিবারের প্রতি যত্নশীল হোন। এই দেশেরই এমন অনেকে সুইসাইড করেছে তারা অতীতে তীব্র আত্মহত্যা বিরোধী পোস্ট দিয়েছে। কার জীবন কখন কোন মোড়ে গিয়ে দাঁড়াবে কেউ জানে না।
জীবনে বেঁচে থাকার মতো আনন্দ খুঁজে বের করুন। হতাশা বা বিষণ্ণতাকে যতটা পারেন দূরে রাখেন। বিষণ্ণতা একটা ক্লিনিকাল অবস্থা, সেটা ক্লিনিকাল এপ্রোচ ছাড়া কতটা সারানো সম্ভব জানি না। তবে হতাশাকে চাইলে বিট করা যায়। আপনি যদি ভাবেন নামাজ পড়ে হতাশা দূর করা সম্ভব, তাহলে নামাজ পড়ুন। যদি ডাক্তার প্রেফার করেন তবে ডাক্তার দেখান।
যত যাই করেন, জীবনে আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকার পথ বের করেন। আর হ্যাঁ, আপনি অন্যের জীবন ধারণ করেন না...অযাচিতভাবে কাউকে জাজ করতে যাবেন না প্লিজ৷ ভালো থাকবেন।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন