তামিল নায়কদের কেইবা না চিনে? তাদের এক কিল-এ দশ ঘাঁ দেখতে তো অভ্যস্ত সকলেই। কিন্তু বাস্তব এক তামিল নায়কের বিশ্বজয়ের চমৎকার গল্পটা কি আমরা জানি?

২০০৪ সালের এপ্রিলের প্রথম দিন গুগলে ছিল তাঁর ইন্টারভিউ। তারিখ শুনে প্রথমে ভেবেছিলেন, আবার 'এপ্রিল ফুল' হয় কিনা! যদিও গুগল তখনো অতটা বড় কিছু হয়ে যায়নি, আর তিনিও 'ম্যাকেন্সি এন্ড কোম্পানি'-তে ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করছিলেন। অবশ্য ইন্টারভিউ দিতে গিয়েই সেই হাস্যকর সন্দেহ দূর হলো, আর তিনিও ইন্টারভিউ চমৎকারভাবে উতরে গেলেন। গুগলের সহ প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেইজ সেই ইন্টারভিউতে উপস্থিত ছিলেন না, তাহলে নির্ঘাত চাকরিটা আর হতো না- ব্যাপারটাকে এখন এভাবেই মজাচ্ছলে দেখেন গুগলের সিইও পিচাই সুন্দরঞ্জন!

ভারতের দক্ষিণী রাজ্য তামিলনাড়ুর মাদুরাই গ্রামে তাঁর জন্মটা খুব সাদামাটা মধ্যবিত্ত পরিবারেই। বড় হয়েছে আশোক নগরের দু-রুমের কামরার একটি বাসায়। বাবা ছিলেন ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার, আর মা শ্রুতি লেখক। তাও আশির দশকে পরিবারের সময়টা ভালো যাচ্ছিলো না। আর্থিক সচ্ছলতার অভাবে বাসায় নেই কোন রেফ্রিজারেটর, এমনকি একটা স্কুটারের টাকা জোগাড় করতেই বাবা রঘুনাথ পিচাইয়ের তিন বছর লেগে গেল! 

এদিকে দুই সন্তানের জন্মের পর মা নিজের কাজ ছেড়ে দিলেন। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারে যেকোনো সন্তান কোল আলো করে আসার পরে, মা বাবা তাদের দ্বারা ভবিষ্যতে পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন পিচাই পরিবারও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তাছাড়া ছোটবেলা থেকেই বড় ছেলে সুন্দরের মেধায় বাবা মায়ের মুগ্ধতার সাথে পাল্লা দিয়ে আকাঙ্ক্ষাও যেন বাড়তে লাগলো। তারা খেয়ালো করলো, ছেলে টেলিফোন বুকের সব নাম্বার মুখস্থ করে ফেলেছে। যে বই সামনে পাচ্ছে, আগ্রহ নিয়ে পড়ছে। বিন্দুমাত্র বিরক্তি বা অভিযোগ নেই।

প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখাতেও সেই ছাপ রাখলেন সুন্দর। অবশেষে কঠিন ভর্তি পরীক্ষায় পার হয়ে ভারতের সর্বোচ্চ এবং অন্যতম বিশ্বসেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আইআইটি খড়গপুরের ধাতুবিদ্যা প্রকৌশলী ডিপার্টমেন্টে সুযোগ পেলেন। যদিও একজন দক্ষিণ ভারতীয় ছেলে হিসেবে সেই পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে তার বরাবরই কষ্ট হচ্ছিল। প্রথম কয়েকদিন সবার মুখে 'আবে সালে (আরে শালা)' শুনতে শুনতে অভ্যস্ত সুন্দর ভেবেছিলেন, এভাবেই বোধহয় কাউকে সম্বোধন করতে হয়। আর তাতেই বোকামি করে বসলেন তিনি, এক সিনিয়রকে ডাকলেন 'আবে সালে' বলে। এরপর কি গন্ডোগলটাই না লেগে গিয়েছিলো পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে! 

সুন্দর পিচাই

পরীক্ষায় ফলাফলও সবসময় ভালো হলো না, প্রথম বছরের সিজিপিএ ছিল খুব খারাপ। কোনো এক পেপারে সি গ্রেড-ও পেয়েছিলেন। তবে একটি চমৎকার জীবনের সূত্রপাত হয়েছিলো তা বলায় যায়। সময়ের পরিক্রমায় বান্ধবী অঞ্জলির সাথে প্রেম (পরে যিনি সুন্দরের স্ত্রী হয়েছেন) সেই খড়গপুরের ক্যাম্পাসেই গড়ে উঠেছিলো। এরপরেই তিনি স্কলারশিপ পেয়ে যান আমেরিকার বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠান স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে সেখানে তিনি ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স ও সেমিকন্ডাক্টর ফিজিক্সের ওপর মাস্টার্স এবং পিএইচডি করেন। ২০০২ সালে পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেন। এভাবে একে একে তিনটি বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠান পাড়ি দেন প্রচন্ড মেধার ছাপ রেখে। 

এ প্রসঙ্গে প্রফেসর সনৎ কুমার রায় বলেছিলেন, 'সুন্দর ছেলেটা ম্যাটেরিয়াল পড়ালেখার পাশাপাশি, ইলেকট্রনিক ক্ষেত্রেও প্রচুর সময় ব্যয় করতো। অথচ ইলেকট্রনিক নিয়ে আমাদের ডিপার্টমেন্টের ক্যারিকুলামে আলাদা কোনো বিষয়ও ছিল না। শুরু থেকেই ম্যাটেরিয়াল এবং ইলেকট্রনিক, দুটো বিষয়তেই তাঁর উদ্যমী মনোভাব আমরা খেয়াল করেছি।'

২০০৪ সালে গুগলে যোগ দেয়ার পরেই, একটি ছোট টিমের দায়িত্ব পান। তাঁর কাজের ক্ষেত্র হয় গুগুলের সার্চ ইঞ্জিন ও গুগল ম্যাপের ডেভেলপমেন্ট নিয়ে৷ পাশাপাশি তিনি কাজ করেছেন গুগল গিয়ার, গ্যাজেট এর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রোডাক্টেও যা অবশ্য এখন আর নেই। ২০০৬ সালে মাইক্রোসফট 'ডুমস ডে' সার্চ ইঞ্জিন চালু করলে, গুগলের পথচলা খানিকটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়৷ তবে সুন্দর খানিকটা ম্যাজিক দেখায় এক্ষেত্রে। তিনি যেভাবেই হোক কম্পিউটার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে গুগলের লক্ষ্য তুলে ধরে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হন। পাশাপাশি ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার ও ফায়ার ফক্সের মধ্যে গুগল ইঞ্জিন যুক্ত হতে তিনি ও তাঁর দল উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন, এভাবেই সময়ের পরিক্রমায় গুগল হয়ে উঠে আমাদের নিত্যসঙ্গী।

এরপরের সময়টা শুধু অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণের। তিনি কোম্পানিতে গুগলের নিজস্ব ব্রাউজার তৈরি ও ডেভেলপ করার আইডিয়া নিয়ে হাজির হন। আর এটি নিজেদের সফলতার শিখরে নিয়ে যাবে এই দূরদর্শিতাও নিজের প্রেজেন্টেশনে উল্লেখ করেন। প্রথমে তাঁর আইডিয়া কেউ ততটা আমলে নিতে না চাইলেও, অবশেষে প্রতিষ্ঠাতারা ঐক্যমতে পৌঁছায়। ২০০৮ সালে 'গুগল ক্রোম' নামে নিজেদের ব্রাউজার চালু করেন। বলা হয়ে থাকে, এটিই ছিল মূলত সুন্দর পিচাইয়ের জীবনে সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট! আজ গুগল ক্রোম পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যবহৃত ওয়েব ব্রাউজার। এভাবে গুগলের সাথে সুন্দরের জুটিটা আরো সমৃদ্ধ হয়। 

সুন্দর পিচাই

২০১০ সালে যখন গুগল প্রথম বাজেট ফোন হিসেবে বাজারে এন্ড্রয়েড আনে, সেটিও একপ্রকার সুন্দরেরই অবদান। আজকের পৃথিবীতে এন্ড্রয়েডের দামামার কথা কে না জানে! পরবর্তীতে একে একে গুগল+, গুগল ম্যাপ, গুগল এপস সবকিছুই তাঁর দায়িত্বে চলে আসে। ২০১৫ সালে তিনি গুগলের সিইও নির্বাচিত হন। এরপরে গুগলের প্যারেন্ট কোম্পানি আলফাব্যাট এর সিইও হন তিনি। মাঝে একবার টুইটার থেকে বড় প্রস্তাব পেলেও তিনি গুগলেই থেকে যান, যা আজকে সঠিক সিদ্ধান্ত হিসেবেই গণ্য হয়।

বলা হয়, স্বপ্ন কখনো কখনো মানুষের চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৪ সালে সুন্দর পিচাই দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বলেছিলেন, আমি টেকনোলজি নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি, আমি স্বপ্ন দেখতাম সিলিকন ভ্যালি নিয়ে।' দার্শনিক রালফ ওয়ালডো এমারসন বলেছিলেন, 'পথে যেদিকে নিয়ে যায় সেদিকে যেও না। যেদিকে কোনো পথ নেই সেদিকে হাঁটো এবং নিজের চিহ্ন রেখে যাও।' আসলেই তাই! আজকে এত বছর পর জীবনের সর্বোচ্চ অধ্যায়ে দাঁড়িয়ে পুরোনো স্মৃতি কথা রোমন্থন করেন সুন্দর পিচাই। তিনি বলেন-

"আমি সবসময় চেয়েছি আমরা যা তৈরি করছি তা যেন ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রতিটা কম্পিউটারের সাথে যুক্ত হতে পারে। যার ফলে শুধু হাভার্ড বা স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কেন, বরং কোনো অজপাড়াগাঁয়ের ছেলেরও যাতে সেই বিষয়টিতে অভিগমন সহজলভ্য হয় এবং উপকৃত হয়। এভাবেই আমরা গুগল সার্চবারকে প্রযুক্তির আধারে সাজাতে চেয়েছি, যাতে পৃথিবীর প্রতিটা মানুষের কাছে আমরা পৌঁছাতে পারি।"

ভেবে দেখুন, আমেরিকার কার্লিফোনিয়ায় দাঁড়িয়ে এক ছেলে যখন একটি প্রতিষ্ঠানকে দাঁড় করানোর জন্য নিজের সর্বোচ্চ মেধা ও শ্রম দিয়ে চলেছেন, তখনো তিনি ভাবছেন প্রত্যন্ত কোন গ্রামের ছেলের জীবনের বাস্তবতার কথা। ভাবছেন কিভাবে সেই জীবনকে প্রযুক্তির আধারে সহজতর করা যেতে পারে। এটাই সুন্দর পিচাই, তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে থেকে উঠা আসা একজন বাস্তব তামিল নায়কের গল্প এটা! সেই গল্পে তিনি সফল, তিনি মহানায়ক। স্বপ্ন ও এর মহৎ উদ্দেশ্যই তাঁকে আজকে সেই অবস্থানে নিয়ে গেছেন, যেখানে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাটাও অনেক কঠিন হয়তোবা।

তামিলনাড়ু থেকে খড়গপুর, সেখান থেকে স্টানফোর্ড ও পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ম্যাকেন্সির চাকুরি। অতঃপর গুগলের চাকুরিতে প্রবেশের পর একটি ছোট্ট দলের দায়িত্ব পাওয়া। ততটুকু অবধি তাও ঠিক আছে, বরং একটি ছোট দলের সদস্য থেকে তিনি কিভাবে গুগলের সিইও হয়ে উঠলেন এই পথচলাটাই সকলের বিষ্ময় এবং অনুপ্রেরণা। আজ তিনি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। প্রকৌশলীরা তাঁকে ভালোবাসেন, প্রযুক্তিবিদরা তাঁকে ভালোবাসেন, ব্যবসায়ীরা তাঁকে ভালোবাসে। 

রোজ এক কাপ চা- অমলেট ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাথে দিন শুরু করা পিচাইয়ের জীবনটাই এরকম। ভারত, বাংলাদেশ বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিটা ছেলে মেয়ে যারা প্রযুক্তিকে ভালোবাসে, তারা স্বপ্ন দেখে একদিন সুন্দর পিচাই হয়ে উঠার। কদিন আগেই বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজনের চাকুরি হলো গুগলে। অভিনন্দনের জোয়ার হয়েছে তো বটেই, পাশাপাশি তা নিয়েই স্বপ্নের দানা বাঁধতে শুরু করেছি আমরাও। কোভিড মহামারীর অচল অবস্থায়, নতুন দ্বার উন্মোচনে ভারতে ৭৫ হাজার কোটি রুপির বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছেন সুন্দর পিচাই ও গুগল। আশা করি বাংলাদেশেও সুন্দর পিচাইয়ের আগমন খুব শীঘ্রই ঘটবে...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা