সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: বাংলা সাহিত্যের এক 'বাউণ্ডুলে' নক্ষত্র!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
পেটের খিদে মেটাতেই লিখতে শুরু করেছিলেন সুনীল। সেই লেখা মিটিয়েছে অজস্র মানুষের মনের খিদে। জীবনকে নিয়ে প্রশ্ন না তুলে যে দুরন্তপনার জীবন কাটিয়েছেন তিনি, সে জীবন অনেকেরই স্বপ্ন...
দেশভাগ নিয়ে আমাদের অনেকেরই তীব্র আক্ষেপ আছে। আক্ষেপ হওয়াটা স্বাভাবিকও। দেশভাগের সূত্র ধরে এই দেশের জলবায়ুতে বেড়ে ওঠা অনেক সন্তান চলে গিয়েছে ওপারে। হয়ে গিয়েছেন কাছে থেকেও আগন্তুক। সম্পর্কসেতু'তে যুক্ত হয়েছে পাসপোর্ট আর কাঁটাতার। আমার আক্ষেপ এরকম গুনী মানুষদের নিয়ে, যারা হতে পারতেন আমাদের। কিন্তু হননি। দীর্ঘশ্বাসের জন্ম সেখানটিতেই। এরকম এক আক্ষেপের মানুষ নীললোহিত। অথবা সনাতন পাঠক। অথবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
মানুষটির জন্ম বাংলাদেশের মাদারীপুরে। মাত্র চার বছর বয়সে কলকাতায় চলে আসতে হয় তাদের। বাবা ছিলেন স্কুলের শিক্ষক। টাকাপয়সা কোনোকালেই বেশি ছিলো না ঘরে। কায়ক্লেশে সংসার চালানো যাকে বলে, সেটা ছিলো প্রবল। সুনীল অবশ্য এসবের হেলদোল করতো না। পড়াশোনা করতো। মাঝেমধ্যে করতো না। বাবার পকেট কেটে প্রিয় বন্ধুকে নিয়ে ট্রেনের বিনা টিকেটে চেপে চলে যেতো উত্তরবঙ্গের কোনো জঙ্গলে। সেখানে সারাদিন থেকে রাতের বেলা স্টেশনের দোকান থেকে পরোটা আর কষা মাংস খেয়ে আবার ফিরতি বাড়ির ট্রেন। ওদিকে তখন হয়তো বাড়িতে হুল্লোড় উঠেছে। ছেলে কই? ছেলে কই? তা নিয়ে।
বাবা শাস্তিস্বরূপ দুপুরে ঘুমোতে দিতেন না৷ টেনিসনের কবিতা অনুবাদ করতে দিতেন। বন্ধুরা খেলার জন্যে, সিনেমা দেখতে যাওয়ার জন্যে নানা প্রলোভন দেখাতো, ইশারা করতো, সংকেত দিতো... সুনীলের বার হওয়া হতো না। দুপুরে ভাত খাওয়ার পর এমনিতেই ভাতঘুমের একটা তন্দ্রাভাব আসে৷ সেই ঢুলু ঢুলু চোখে কোন দূর-দেশের এক কবির কবিতার বাংলাকরণের কাজ করতে হতো তাকে। এভাবেই একসময়ে এসে 'অনুবাদ' করার কাজটি বেশ পছন্দ হয়ে যায় তাঁর। এক বান্ধবীকে উৎসর্গ করে একটি কবিতা লিখে পাঠিয়ে দিলেন বিখ্যাত 'দেশ' পত্রিকায়। কবিতার নাম 'একটি চিঠি'। কবিতাটি ছাপাও হলো 'দেশ' পত্রিকায়। জীবনে প্রথমবারের মতন নিজের নামটিকে ছাপা অক্ষরে দেখলেন জীবদ্দশায় প্রায় চারশো বই লিখে ফেলা এ তুমুল শক্তিমান লেখক!
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে একদিন ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরিবারে তখন তীব্র অনটন৷ পড়াশোনার পাশাপাশি ক্লান্তিহীনভাবে টিউশনি করে যাচ্ছেন তিনি। দুয়েকটা পত্রিকার সাথেও যুক্ত হলেন। টাকা দরকার, প্রচুর টাকার দরকার। পড়াশোনা শেষ করে একটা ছোটখাটো অফিসেও ঢুকলেন। সেখানের বেতনে কুলাচ্ছিলো না। চাকরীর পাশাপাশি লেখালেখি করতেন। পেপারে ফিচার, অনুবাদ, গল্প, কবিতা... সবই লিখতেন। লেখার সূত্রেই একদিন পরিচয় হয় আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধাণ মি. পলেনের সাথে। যিনি কলকাতায় একটি কাজে এসেছিলেন। তিনি সুনীলকে প্রস্তাব দেন আমেরিকায় যাওয়ার।উপমহাদেশের মানুষদের একটি বদ্ধমূল ধারণা তো রয়েছেই, বিদেশে গেলে অনেক টাকা কামানো যায়। সে ধারণা বোধকরি সুনীলেরও ছিলো। এক বিকেলে বাংলার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে আমেরিকার প্লেনে উঠলেন তিনি।
মার্কিন মুলুকে গিয়ে প্রথম কিছুদিন তিনি আগ্রহভরে পাশ্চাত্যের মানুষের জীবনযাপন, প্রাত্যহিক কাজকর্ম লক্ষ্য করেন। প্রবাসের দিনগুলির গল্প আমরা উঠে আসতে দেখি 'পায়ের তলায় সর্ষে' বইয়ের বিভিন্ন অংশে। অনুবাদের কাজও শুরু করেন তিনি এখানে এসে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ইংরেজীতে অনুবাদ করতে হবে। সেই কাজ করতে গিয়ে একটা শব্দে আটকে যান। 'শ্মশান' শব্দের ইংরেজি করতে গিয়ে তিনি আর ভালো ইংরেজি খুঁজে পান না। 'graveyard' কথাটা কেমন যেন বিলিতি বিলিতি। তাছাড়া 'শ্মশান' শব্দের মধ্যে যেমন বাঙ্গাল একটা আমেজ, গা ছমছমে অনুভূতি আর ধুপধুনো-আগুনের মিশ্র দ্যোতনা, সেটি কোনো ইংরেজি শব্দতেই আর আসেনা। সুনীল হতাশ হয়ে পড়লেন। ভাবলেন, এভাবে কবিগুরুকে পাশ্চাত্যের সাথে পরিচিত তিনি করতে পারবেন না৷ এখানেই আমরা প্রথমবারের মত লক্ষ্য করি এক মহৎশিল্পীকে। যিনি ভাবেন, তাঁর কাজের মাধ্যমে কবিগুরুর সুনাম যেন নষ্ট না হয়। টাকাপয়সার মায়া না করে তিনি অনুবাদের চাকরী ছেড়ে দেন। তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে আসেন ট্রাম, বাস, কফি হাউজের শহরে আবার৷
কলকাতায় ফিরে 'দেশ' পত্রিকায় যুক্ত হলেন। নিয়মিত প্রবন্ধ, ফিচার, কবিতা লেখেন। 'নীললোহিত' নামে লেখেন। নিজের নামেও লেখেন। 'কৃত্তিবাস' নামেও একটা পত্রিকা খুললেন। কবিতা আর গদ্যপ্রবন্ধের পত্রিকা। সেটা নিয়েও ব্যস্ততা। এরমধ্যে একদিন 'দেশ' পত্রিকার সম্পাদক 'সাগরময় ঘোষ' ডাকলেন তাকে। একটা উপন্যাস লিখতে বললেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়'কে, পূজাসংখ্যার জন্যে। সময় দিলেন তিন মাস। এতদিন কবিতা লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, গল্পও লিখেছেন কালেভদ্র। কিন্তু কোনোদিন তো উপন্যাস লেখেননি। এ কোন বিপদে পড়া গেলো! তাও সম্পাদকের আদেশ, ফেরানোরও উপায় নেই। কয়েক দিস্তা কাগজ কিনে বাড়ি ফিরলেন। লিখতে শুরু করলেন। কিন্তু এক পৃষ্ঠাও লেখা হলো না। কী লিখবেন? মাথা তো গড়ের মাঠ হয়ে স্থবির! প্রত্যেকদিন সকালে উঠে কাগজ কলম আর চায়ের কাপ নিয়ে বসে থাকেন। কিন্তু কলম আর এগোয় না। এমন সময় একদিন বাড়ি আসেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ছোট ভাই। এসে সুনীল'কে বলেন-
কি শুরু করেছেন আপনারা? দাদা (শক্তি) গতকাল বাড়ি ফেরেনি।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ডানহাত। 'কৃত্তিবাস' পত্রিকার জন্যে এরা উদয়াস্ত খাটতেন, বোহেমিয়ান জীবনযাপন করতেন। খাবার, থাকার, ঘুমোবার ঠিক ছিলো না মোটেও। একরকম ভবঘুরে জীবনযাপনেই অভ্যস্ত ছিলেন তারা। সেরকমই এক অভিযোগ নিয়ে যখন শক্তি'র ছোট ভাই আসেন তাঁর কাছে, তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যেন হুট করেই পেয়ে যান উপন্যাসের প্লট। তার বোহেমিয়ান জীবনকে নিয়ে লিখে ফেলেন 'আত্মপ্রকাশ'। এরপর লেখার পাণ্ডুলিপি সাগরময় ঘোষের অফিসে রেখে লাপাত্তা হয়ে যান একেবারে। সুনীল ভেবেছিলেন, এ উপন্যাস কিছুই হয়নি। তাই পালিয়েই চলে গেলেন সবকিছু থেকে। যাতে কারো কথা শুনতে না হয়। ফিরলেন পূজাসংখ্যা বের হওয়ার পর। ভয়ে ভয়ে গেলেন 'দেশ' এর অফিসে। দেখা হলো আরেক বিখ্যাত লেখক রমাপদ চৌধুরীর সাথে। তিনি তখন বেরোচ্ছিলেন। সুনীলকে দেখেই বললেন-
তোমার উপন্যাস পড়া শুরু করেছি। শেষটা ভালো না হলে খুন করে ফেলবো!
ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছেড়ে যায় সুনীলের। যাক! উপন্যাস ছাপা হলো তাহলে। এই উপন্যাস 'দেশ' এ প্রকাশ হবার পর পছন্দ হয়ে যায় অজস্র মানুষের। বাংলা বরাবরই ছিলো কুলীনদের ভাষা। সেখান থেকে একেবারে সাধারণ মানুষদের ভাষায় এ উপন্যাস লেখা, বাক্যে খুব বেশি অলঙ্কার না প্রয়োগ না করে ঝরঝরে এই লেখা বাংলাসাহিত্যে অন্যরকম ধারারই সৃষ্টি করে। দ্বিতীয় উপন্যাস- অরণ্যের দিনরাত্রি। সেটি হয়ে যায় আরো জনপ্রিয়। সত্যজিৎ রায় সেটি নিয়ে সিনেমাও করেন। সুনীল তখন ক্রমশ 'সুনীল' হয়ে উঠছেন। কলকাতাবাসীর 'অবশ্যপাঠ্য বই' এর তালিকায় ক্রমশ ঢুকে যাচ্ছে তাঁর লেখা বই।
নিয়ম করে প্রতিদিন লিখতেন। তবে দুপুরের আগেই লেখা শেষ করতেন। স্নান করে 'দেশ' এর অফিসে, সেখানে কিছু কাজবাজ শেষ করে সন্ধ্যায় আড্ডা, পানাহার এ মগ্ন থাকতেন। যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন, বুকের ভেতরে সযত্নে লালিত শিশুটিকে কোনোদিনও একা থাকতে দেননি তিনি।গৎবাঁধা লেখা খুব বেশি লিখতেন না। এক্সপেরিমেন্টাল ওয়ার্কও করতেন অনেক। ইতিহাস-কেন্দ্রিক উপন্যাস লেখারও পরিকল্পনা করলেন একসময়ে এসে। অজস্র বই পড়ে লিখলেন 'সেই সময়' 'পূর্ব-পশ্চিম' 'প্রথম আলো'... যেগুলো হয়ে গেলো বাংলা সাহিত্যেরই বড়সড় সম্পদ। অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই লেখাগুলো লিখেছিলেন তিনি। বিভিন্ন সময়ে দেয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তা উল্লেখও করেছেন তিনি। উপমহাদেশের ইতিহাসের অনেকটাই যেন সহজ ভাষায় নিয়ে এসেছেন পাঠকের সামনে। উপন্যাস লিখছেন, সে সাথে গল্পও লিখেছেন সমানতালে। কবিতা তো আছেই। যদিও কেউ কেউ তাঁর কবিতা নিয়ে কটাক্ষ করেছেন৷ গায়ে মাখেননি তিনি। নিজের মত করেই কবিতার কাজ করে গিয়েছেন। ছোটদের জন্যে নিয়ে এসেছেন 'কাকাবাবু'। ক্রাচে ভর দেয়া যে কাকাবাবু'তে বুঁদ হয়ে আছে অজস্র ছেলেমেয়েরা, আজও। কিশোর উপন্যাসও লিখেছেন অগুনতি।
বাংলাদেশে আসতেন মাঝেমধ্যেই। হুমায়ূন আহমেদের সাথে খুব ভালো সখ্যতা ছিলো। ঢাকায় এলেই হুমায়ূনের ফ্ল্যাটে অথবা 'নুহাশপল্লী'তে চলে যেতেন তিনি। সুনীল, হুমায়ূন দুইজনেই খাওয়াদাওয়া পছন্দ করতেন। দুইজনেই লিখতেন একেবারে সাধারণ মানুষের ভাষায়। দুইজনেই গদ্যরীতিকে অনেক বেশি স্বাভাবিক করেছেন। দুইজনেই বলতেন, মৃত্যুর পরে জনপ্রিয় হয়ে লাভ নেই। জনপ্রিয়তা দরকার মৃত্যুর আগেই। এবং দুইজনেই মৃত্যুর আগেই পেয়েছেন প্রবল জনপ্রিয়তা। এবং মৃত্যুর পরেও তাঁরা আজও প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশে এলে মাঝেমধ্যে মাদারীপুরের সেই মাইজপাড়া গ্রামেও যেতেন, যেখানে জন্ম। বাপের ভিটেয় গিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন। হয়তো দেশভাগ, সীমান্ত, বিদেশ... শব্দগুলো মাথায় ঘুরপাক খেতো। কে জানে! তবে বাংলাদেশ নিয়ে আগ্রহটা রয়ে গিয়েছিলো চিরকালীনভাবেই। বিয়েও করেছিলেন বাংলাদেশের রংপুরের মেয়ে স্বাতী কে।
এত অসাধারণ সব লেখা লিখেছেন, এত অজস্র সব সম্মান পেয়েছেন, এত অগুনতি তাঁর ভক্ত, তবু মানুষটি ছিলেন বরাবরই সাদাসিধে ভালো মানু্ষ। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস পড়ে তাঁর ভালো না লাগায় সরাসরি লিখে দিয়েছেন, উনি সাম্প্রদায়িক। এছাড়াও মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন প্রসঙ্গে হয়েছেন সরব। রাখঢাক না করেই বলে ফেলেছেন সব। আত্মজীবনীও লিখেছেন একটা; অর্ধেক জীবন। নাম অর্ধেক জীবন কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে উত্তর দিয়েছেন-
জীবনের সব কথা তো বলা যায় না। বলতে পারি না।
এই মানুষটি, যার পায়ের তলায় আক্ষরিক অর্থেই ছিলো সর্ষে, যার রঙিন ঢোলা শার্ট- ভারী ফ্রেমের চশমা আর জুলপির কাছে সাদা পাকের ট্রেডমার্ক স্টাইল গোটা বাঙ্গালী পাঠকসমাজের কাছেই হয়ে উঠেছিলো এক প্রিয় বস্তু, যিনি জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আয়োজনে মুগ্ধ হতেন নিয়মিতই, সেই সুনীল, সেই নীললোহিত অথবা সেই সনাতন পাঠক এর জন্মদিন গেলো গত পরশু।
তাঁর জন্মদিনে তাঁর প্রতি আমাদের রইলো বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন