ধর্ষকের মা যখন ভাত তরকারি নিয়ে জেলখানায় ধর্ষক ছেলেকে দেখতে যায়, তখন আমরা সেই 'মা' কে বয়কট করি না। আমরা বয়কট করি কোথাও হিন্দু-মুসলমান বিয়ে হলে, কিংবা কোনো নারী সেলিব্রিটি তৃতীয় বিয়ে করলে...

১. অনেক বছর আগে আমি সিডনীর একটি ছোটো হাসপাতালে কাজ করতাম। সেখানে এলিজাবেথ নামক এক ষাটোর্ধ্ব অস্ট্রেলিয়ান মহিলার সাথে আমার পরিচয় হয়। এলিজাবেথের সাতটা বিড়াল ছিলো, তাই ও যেকোনো গল্পই কিভাবে কিভাবে যেন বিড়ালে দিয়ে শেষ করে ফেলতে পারতো।

একবার এলিজাবেথ খুব অসুস্থ্য হয়ে পড়লো, সারাক্ষন খুক খুক করে কাশে। সেই অবস্থায়ও কাজে আসতো রেগুলার। স্টাফ রুমে দেখা হলেই আমি ওকে চা বানিয়ে খাওয়াতাম এবং ওর বিড়ালগুলোর গল্প শুনতাম। সেই গল্প শুনতে শুনতেই আমি জানতে পারি ও বিধবা এবং ওর একটা ছেলে আর সাতটা বিড়াল ছাড়া দুনিয়ায় আর তেমন কিছু নেই। 

একদিন অসুস্থতার কারণেই আমি ওকে বললাম- তুমি বাড়ি চলে যাও। তোমার ছেলেকে বলো খাবার কিনে এনে দিয়ে যেতে। আমার কথা শুনে ও বিরক্ত হলো, বললো- খাবারতো রেস্টুরেন্টে ফোন দিলেই দিয়ে যাবে ছেলেকে লাগবে কেন? আর তাছাড়া ওকে আমি ‘ডিসওনড’ করেছি। ওর দেয়া একগ্লাস পানিও আমি খাবো না। 

আমি তখনও ‘ডিসওনড’ কথাটার মানে জানি না, পরে জানতে পেরেছি এর মানে হলো ত্যাজ্য করা। একজন মায়ের তার একমাত্র সন্তানকে ত্যাজ্য করে বিড়াল নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত, কঠিন সিদ্ধান্ত। তার পেছনে গুরুতর কারণ লাগে। আমি যখন এই কারণটি জানতে পারি, তখন আমার জন্য নতুন আরেকটি রঙিন জানালা খুলে যায়। সেই জানালা দিয়ে আমি এলিজাবেথের মতন অসংখ্য মায়ের মুখ খুঁজে বেড়াই। 

২. এলিজাবেথের বিশ বছর বয়সী ছেলে এক পার্টিতে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করেছিলো। তারপর ধর্ষণ মামলায় সেই ছেলের চৌদ্দ বছরের জেল হয়। যেদিন সন্ধ্যায় এলিজাবেথের বাসা থেকে ওর ছেলেকে এরেস্ট করা হয়, সেদিন ও শেষবারের মতন ওর ছেলেকে দেখেছিলো। তারপর আর কোনোদিন এক মুহূর্তের জন্যও ছেলেকে দেখতে ইচ্ছা হয়নি। বিষয়টা নাটকীয় শুনালেও এটাই সত্যি ছিলো, এই গল্পটা ও যখন আমাকে বলছিলো, তখন ওর ছেলের বয়স বিয়াল্লিশ।

বাইশ বছর! একটা মা তার ছেলেকে বাইশ বছর দেখেনি, কথা বলেনি, এক ফোটা ইমোশনাল হয়নি, কিভাবে সম্ভব? কারণ তেরো বছর বয়সী এলিজাবেথ যখন পাশের বাড়ির আঙ্কেলের কাছে দিনের পর দিন মোলেস্টেড/উৎপীড়িত হতো, তখন তার পুরো দুনিয়াকে পাল্টাতে ইচ্ছা করতো, সব পুরুষকে মেরে ফেলতে মন চাইতো। বড় হবার পর সে বুঝতে পেরেছে দুনিয়া পাল্টানো সহজ না, আগে নিজেকে পাল্টাতে হবে, ধর্ষণের/মোলেস্টেশনের প্রতিবাদকে ব্যক্তিগত লেভেলে ধারণ করতে হবে। পৃথিবীর সব পুরুষ মেরে ফেলা সম্ভব না, কিন্তু নিজের চারপাশে থাকা এইসব ঘৃণিত পুরুষদের জিন্দা মেরে ফেলতে হবে, সেইটা নিজের ছেলে হোক কিংবা ভাই হোক। 

বাংলাদেশে বাবা-মা'র অমতে প্রেম করে বিয়ে করলেবাংলাদেশে সন্তান ত্যাজ্য করে শুনেছি, অনার কিলিংও প্রচুর হয়। কিন্তু ছেলে ধর্ষণ মামলায় ধরা খেলে মা টিফিনকারীতে ভাত তরকারি নিয়ে, জেলখানায় ধর্ষক ছেলেকে দেখতে যায়। কেন? কারণ তারা এলিজাবেথের মতন তেরো চৌদ্দ বছর বয়সে পাশের বাসার আঙ্কেলের লালসার শিকার হয়নি এইজন্য? আমার লিস্টে এমন কোনো মেয়ে কি আছেন, যে কোনোদিন একটা দিনের জন্য একটা বারের জন্য বাসে, রাস্তায়, বাসায়, গাউসিয়ায়, বসুন্ধরায়, অফিসে, স্কুলে, কোচিঙে, নিজের বাসায়, পাশের বাসায়, আল্লাহর দুনিয়ার কোনো না কোনো জায়গায় নিষিদ্ধ হাতের ছোঁয়া পান নাই? বলেন আছেন কেউ এমন?

তবুও ধর্ষক ছেলেকে এইভাবে সমাজ থেকে নিগৃহীত হতে দেখি না কেন? শুধুমাত্র যথাযথ আইনের অভাবে? সরকার ব্যবস্থা? নাকি আমরা এমনই? পরের বেলায় লাফাই আর নিজের বেলায় ভাত তরকারি নিয়ে কোর্টকাচারী ঘুরে বেড়াই ধর্ষক ভাই, ধর্ষক বাপ, ধর্ষক ছেলে মুক্তি করার জন্য!

৩. ছবির মহিলাটি এলিজাবেথ না। উনার নাম সুসান ব্রাউনমিলার। উনি একজন নারীবাদী, জার্নালিস্ট এবং লেখিকা। এই পৃথিবীতে সর্বোচ্চ রিভোল্যুশনটা হয় বিংশ শতাব্দীতে। এই একশো বছরে পৃথিবী হাজার বছর এগিয়ে গেছে। এই এগিয়ে নেয়ার পেছনে বই এবং বিশ্ব রাজনৈতিক বিভিন্ন আন্দোলনের ভূমিকা প্রবল। বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবী সেরা যে একশোটা বই আছে, তার মধ্যে চার নাম্বার সেরা বইটি সুসান লিখেছেন। বইটির নাম 'এগেইনস্ট আওয়ার উইল'। 

সুসান ব্রাউনমিলার 

উনি পৃথিবীর প্রথম রেপ সেলিব্রিটি, যে ধর্ষক বা ধর্ষিতা নন। রেইপ সেলিব্রিটি শব্দটা শুনে কপাল কুচঁকানোর কিছু নেই, ষাট সত্তর দশকে আমেরিকায় ধর্ষক বা ধর্ষিতা, যারা মিডিয়াতে আসতো তাদেরকে রেপ সেলিব্রিটি বলতো। পরবর্তীতে এই টার্মটা নিষিদ্ধ করা হয়। 

সুসান এই বইটিতে ধর্ষণ, সর্বোপরি ধর্ষণ কালচার নিয়ে অনবদ্য লিখেছেন। উনার এই বইয়ের সূত্র ধরে, পাবলিক প্রেশারে পরে আমেরিকায় 'ম্যারিটাল রেপ' কে আইনের আওতায় আনা হয়!

উনার চাইতে ভালো করে এখনো পর্যন্ত কেউ এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে পারেনি। কেন হয় ধর্ষণ? কিভাবে বেশি হয়, কম হয়, কে দায়ী- আইন নাকি সমাজ? পরিবার নাকি রাষ্ট্র?

উনার এই বই পড়ে পুরো পৃথিবীতে একটি জিনিস ছড়িয়ে যায়, তা হলো ধর্ষণ কোনো ব্যক্তিগত সমস্যা না। অতএব এই সমস্যা নির্মূলে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আচরণ বা কড়া আইন কোনো সমাধান আনবে না।

উনি বলেছেন, ধর্ষণ একটি সুচিন্তিত আর্থ সামাজিক সংস্কৃতি। পৃথিবী থেকে যেদিন ধর্ষণ উঠে যাবে, সেদিন এই পৃথিবীর ৫০% জনসংখ্যা (নারী) নিশ্চিন্তে, ঘুরে বেড়াতে পারবে। তারা তাদের পাওয়ার এবং অথরিটি পেয়ে যাবে। সমস্যা হলো বর্তমানে বাকি যেই ৫০% (পুরুষ) জনসংখ্যা যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারছে, যেই পাওয়ার প্লে আর অথরিটি খাটাতে পারছে, সেটা অটোমেটিক্যালি নষ্ট হয়ে যাবে। 

ধর্ষণ যদি শুধু আইনে আর প্রতিবাদে কমানো যেতো, কিংবা শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়ার পতনে হতো, তাহলে ধর্ষণ ইন্সিডেন্ট রিপোর্টিংয়ে প্রথম শ্রেণীর দেশ অস্ট্রেলিয়া হতো না! পরিসংখ্যান অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে ২.৭৫ গুন বেশি ধর্ষণ হয়!

কিন্তু রিয়ালিটিতে আমি জানি, আপনিও জানেন, বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে বোধহয় বিশ গুণ বেশি ধর্ষণ হয়। অথচ রিপোর্ট হয় না। কেন হয় না?

ধর্ষকের মা যখন ভাত তরকারি নিয়ে জেলখানায় ধর্ষক দেখতে যায়, সরকারের কাছে ছেলের মুক্তির প্লি করে তখন আমরা আবেগী জাতি সেই 'মা' কে বয়কট করি না। আমরা বয়কট করি কোথাও হিন্দু মুসলমান বিয়ে হলে কিংবা কোনো ডিভোর্সী নারীকে। আর নারী সেলেব্রিটি তৃতীয় বিয়ে করলেতো, সেটা ধর্ষণসম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে যায়। 

অনন্ত জলিল যখন পোশাককে ধর্ষণের কারণ বলে তখন তাকে 'ছাগল' বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়াটা কিংবা মিমিক্রি করে পাবলিসিটি করাটা আরেকটা বোকামী। সে মেনচেস্টার থেকে বিবিএ এমবিএ করেছে সেই জোক এক জিনিস, আর তার মতন প্রান্তিক লেভেল বাংলাদেশিদের সেলিব্রিটির মুখ থেকে এমন ভুল কথা বের হওয়া আর সেটা ছড়ানো আরেক জিনিস।

৪. সুসান তার বইয়ে লিখেছেন, ধর্ষণ খুব সেনসিটিভ বিষয়, সেটা আমরা সবাই জানি। তাই এই বিষয় নিয়ে খুব সাধারণ অথচ ভুল একটা কথা যখন প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছে যায়, তখন অসাধারণ প্রতিবাদও অর্থহীন হয়ে পরে। 

ধর্ষকের মা কিংবা বোন যখন তাদের ধর্ষক ভাইয়ের মুক্তি চায়, তখন তাদের কাছে 'ধর্ষিতার পোশাক দায়ী' এই ধারণাটা খুব কনভিনিয়েন্ট লাগে।

ধর্ষণের ঘটনা পুলিশে রিপোর্ট করার আগে একটি মেয়ে এবং তার পরিবারের কাছে জলীলের মতন তৃতীয় শ্রেণীর নায়কের বয়ান যখন পৌঁছে যায়, তখন আপনার আমার কালো প্রোফাইল পিকচার কোনো কাজে আসে না। 

তবুও এই বিষয়ে যেকোনো প্রতিবাদই জরুরী, কিন্তু সেসকল প্রতিবাদের কোনো গুরুত্বই থাকবে না যখন জলীলকে আমরা বেকুব হিসেবে প্রমোট করি এবং তার মুখের যেকোনো আউল ফাউল কথা বন্ধ না করে, তাকে প্রকাশ্যে বয়কট না করে, বরং সেগুলো নিয়ে হাসাহাসি করে রুট লেভেলে ছড়িয়ে দেই। 

শেষ করি একটা অদ্ভুত পার্সপেক্টিভ দিয়ে। এই পার্সপেক্টিভ দিয়ে সুসান আমেরিকার আইন ব্যবস্থাকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছিলো।

“...একজন ধর্ষক আইনের চোখে ততক্ষন ‘নির্দোষ’, যতক্ষণ পর্যন্ত প্রমাণ না হয় সে একজন ধর্ষক। অন্যদিকে একজন ধর্ষিতা আইনের চোখে ততক্ষন পর্যন্ত ‘মিথ্যাবাদী’ যতক্ষন পর্যন্ত প্রমান না হয় সে একজন ধর্ষিতা...”

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা