যাত্রার একদম শুরু থেকেই আমরা পাঠকদের এগিয়ে চলার গল্প শুনিয়েছি, যে গল্পের বাঁকে বাঁকে মিশে আছে ত্যাগ, বিসর্জন আর সংগ্রামের স্রোত। নারায়ণগঞ্জের মেথরপট্টি থেকে গ্র‍্যাজুয়েট হওয়া সনু রানীর এই গল্পটি গত চার বছরে এগিয়ে চলো-তে প্রকাশিত হওয়া সেরা অনুপ্রেরণামূলক লেখাগুলোর একটি...

দলিত সম্প্রদায়ের জীবন তিনি প্রার্থনা করে চেয়ে পেয়েছিলেন এমন তো নয়। যে জীবন এত অপমানের, অবহেলার, অসহায়ত্বের- সেই জীবন কেউ নিশ্চয়ই কল্পনায় সাজায় না। অবশ্য, কল্পনার সাথে বাস্তব খুব কম মানুষেরই মেলে। কিন্তু, কারো কারো ক্ষেত্রে বাস্তবতাটা একটু বেশিই নিষ্ঠুর।

সনু রানী দাসের জীবনটাই যেমন। তিনি জন্মেছিলেন নারায়ণগঞ্জের টানবাজার সুইপার কলোনির এক ঘরে। সেখানে যারা বাস করে, তারা এমনিতেই যেন বাইরের লোকেদের কাছে অছ্যুৎ। এখানে জীবন যেন মাথা নিচু করে থাকার, কারণ দলিত সম্প্রদায়কে সবাই নিচু জাতের লোক হিসেবেই দেখে। এখানে মৌলিক জীবনের উপাদান খুঁজে পাওয়া মেলা ভার। বিশেষ করে শিক্ষায় এই সম্প্রদায় বেশ পিছিয়ে থাকে। এর পেছনে প্রধানতম কারণ অবশ্য ভাষা। তাদের সংস্কৃতি অনুযায়ী তারা হিন্দিতেই কথা বলেন। বাংলাটা খুব ভাল জানে এমন লোক কম এখানে। আর মেয়েদের বেলায় অবস্থা আরো করুণ। মেথরের মেয়ে, নিচু বর্ণের মেয়ে হয়ে পড়ালেখা করবে মেয়ে এটা তাদের নিজেদের সম্প্রদায়ের লোকরাও ভাবতে পারেন না৷

সনু রানী দাস অবশ্য ব্যতিক্রম। তিনি প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হলেন। ১৫০ পরিবারের এই সুইপার কলোনিতে মেথরপট্টি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ১৯৬৪ সাল থেকে। তবে প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকে পড়ার সাহস খুব কম লোকেই করে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত এমন অবস্থা ছিল, এই কলোনির কেউ মাধ্যমিকের স্তর পেরিয়ে সামনে এগুতে পারেনি। কিন্তু, সনু এবং তার দুই বান্ধবী প্রথম তাদের সম্প্রদায় থেকে এসএসসি পাশ করেন।

এইটুকু অর্জন করতেও কম কষ্ট হয়নি৷ কারণ, মাধ্যমিকে পড়তে হলে কলোনির বাইরে যেতে হয়। ওই বাইরের জগতে লোকে তো তাদের মানুষ বলেই ভাবতে পারে না। কাছে এলেই যেন জাত যাবে এমন একটা দূরত্ব সবাই বজায় রাখে। তার ওপর অনেক স্কুল স্রেফ সে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ বলে তাকে ভর্তিই করাতে চায়নি। আর ক্লাসে কাউকে সুইপার কলোনি থেকে এসেছি এই পরিচয় দিলে আর রক্ষে নেই। ক্লাসের মধ্যে একঘরে হয়ে যাওয়ার অবস্থা তৈরি হতো। অনেকেই কথা বলতে অনীহা দেখাতো।

সনু রানী দাস, সুইপার কলোনির প্রথম গ্র‍্যাজুয়েট 

মাধ্যমিক স্কুলের কেউ যেন তাকে দেখে না ফেলে যে, তার বাড়ি সুইপার কলোনিতে তার জন্যে সনু রানী কলোনির পেছনের রাস্তা দিয়ে বের হয়ে ঘুরপথে স্কুলে যেত। কারণ, কেউ দেখে ফেললেই হয়েছে। মেথরের বাচ্চা বলে গালি একটাও মাটিতে পড়ে না। এতকিছু সয়ে সনু রানী এসএসসি পাস করলেন। এখন তার ইচ্ছে আরো পড়ালেখা করা। কিন্তু বাধা এলো পরিবার থেকেই। সনু রানীর মা বললেন, মেয়েকে এত পড়িয়ে কি হবে? শেষে তো চুলাই ঠেলা লাগবে। রান্নাঘরেই যেতে হবে। আত্নীয়রাও নেতিবাচক কথা বলত। তারা মনে করেছে, এসএসসি দিয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে। এর বেশি দরকার নেই। বিয়ে করালে মেয়েদের ঘরের কাজ করা ছাড়া আর কি কাজ থাকে...

স্কুলের শিক্ষকরা ততদিনে সনু রানীর লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহের ব্যাপারে জেনে গেছে। তারা এসে সনু রানী দাসের বাবা মাকে বুঝিয়েছে যেন মেয়েকে কলেজে পাঠানো হয়। মা বুঝতে না চাইলেও, সনু রানীর বাবা ঠিকই বুঝতে পেরেছেন। তাই মেয়েকে ভর্তি করান কলেজে। নারায়ণগঞ্জ কলেজ থেকে সনু রানী দাস এইচএসসি পাশ করেন। কিন্তু, এখানেও তিনি থেমে থাকেননি। তার সম্প্রদায়ের লোকেদের কাছে ডিগ্রী, অনার্স এই শব্দগুলো অপরিচিত। তারা পড়ালেখাটাকে কখনো সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। কিন্তু, সনু রানী জেনে গেছেন তাকে কি করতে হবে। তিনি ভর্তি হলেন সরকারি তোলারাম কলেজে। এখান থেকেই তিনি ইতিহাস গড়লেন। নারায়ণগঞ্জ সুইপার কলোনির দলিত সম্প্রদায়ের প্রথম মানুষ হিসেবে তিনি এখান থেকে স্নাতক পাশ করেন। সুইপার কলোনির প্রথম গ্রাজুয়েট হয়ে তিনি সকল বাধা, অপমান, অবহেলাকে যেন তুচ্ছ করে তুমুল ইচ্ছেশক্তির প্রমাণ দিলেন। 

সনু রানী হার মানেননি...

সনু রানী দাস, যার কখনো হয়ত সুইপার কলোনি ছেড়ে বের হওয়ার কথা ছিল প্রচলিত ধারায় চিন্তা করলে- সেই তিনি শুধু কলোনি ছেড়েই বের হলেন না, সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করতে একসময় দেশের বাইরেও গেলেন। প্রথম স্কটল্যান্ডে যান তিন মাসের জন্য গ্লোবাল এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে। তারপর জেনেভায় গিয়ে হিউম্যান রাইটসের সম্মেলনে গিয়ে সাত মিনিটের বক্তব্য রাখেন। সেখানে বাংলাদেশে দলিত সম্প্রদায়ের নারীদের অবস্থা সম্পর্কে কথা বলেন। এরপর জাতিসংঘের আয়োজনে ব্রাজিলে তিনি বাংলাদেশ এবং দলিত সম্প্রদায়কে প্রতিনিধিত্ব করেন।

ইচ্ছে, স্বপ্ন, উদ্যম, সাহস, মনোবল মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তার উজ্জ্বলতম উদাহরণ সনু রানী দাস। এখন কলোনিতে অনেকেই তাকে দেখে অনুপ্রাণিত। অনেকেই পড়ালেখা করতে চায়। তিনি এখন শিক্ষকের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। কাউকে বিনা পয়সায়, কাউকে নামমাত্র অর্থে পড়ান। এখন আর কোনো জড়তা নেই তার মধ্যে, নেই কোনো হীনমন্যতা। বরং, এখন নিজেকে মেথরের সন্তান বলতে একটুও লজ্জা হয় না তার। লজ্জা কেন তার হবে? লজ্জা তাদের হওয়া উচিত যারা স্রেফ অবস্থানগত কারণে দিনের পর দিন সনু রানীদের অপমান করেছে, মেথরের বাচ্চা বলে গালি দিয়ে গেছে। সনুও উচিত জবাব খুঁজে পেয়েছেন, এখন তিনি পালটা জবাব দেন- সুইপাররা যদি কাজ না করে, দেশ পরিষ্কার রাখার কাজটি কে করবে? দেশ পরিষ্কার থাকুক, পরিষ্কার হোক মানুষের মনও..

আরও পড়ুন-


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা