বাংলার জল হাওয়া এমনিতেও সঙ্গীত বান্ধব, এই মাটি জলে বাউলদের একতারা যেমন কথা বলে, তেমনি কথা বলে আধুনিক গানও। তাই বলতেই পারি, আউল বাউল লালনের দেশে এসেছেন একজন সৈয়দ আব্দুল হাদীও, যিনি আমাদের মানুষ, যিনি আমাদের কিংবদন্তি! 

"সকল কথার মরন হইলে, হৃদয় কথা কয় সেই কথাও চোখের কাছে, নয়রে গোপন নয়..." তিনি গেয়েছিলেন 'চক্ষের নজর এমনি কইরা একদিন খইয়া যাবে'। কিন্তু তিনি যে অদ্ভুত সব কালজয়ী অমর সঙ্গীতের স্রষ্টা; চোখের নজর ক্ষয়ে গেলেও, দৃষ্টিসীমা আবছা হয়ে গেলেও, তার সেসব গান যে হৃদয়ে থেকে যাবে। বাংলার মাটি, বাংলার জল হাওয়া রবে যতদিন, মানুষটার গানগুলো ঠিক ততদিন টিকে থাকবে। বলছি এক কিংবদন্তির গল্প, তিনি সৈয়দ আব্দুল হাদী।

ভারতের আগরতলা, ১৯৪০ সাল

এই বছরটায় একজন নক্ষত্রের জন্ম হলো। তখন অবশ্য কারো হয়ত ধারণাতেও ছিলো না, এই ছেলেটিই একদিন বাংলা সঙ্গীত জগতের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রদের একজন হবেন। তবে কালক্রমেই সঙ্গীতের যে প্রেমবীজ নিজের ভেতর বহন করেছিলেন মানুষটা, সেই বীজ একদিন মহীরুহ হয়েছে, তিনি হয়েছেন বটবৃক্ষের মতো, যতই সময় গড়িয়েছে শাখা প্রশাখার ন্যয় তিনিও ছড়িয়েছেন সঙ্গীতসুধা। 

যদিও আগরতলায় জন্ম নেয়া সৈয়দ আব্দুল হাদীর নিজের বাড়ি বৃহত্তর কুমিল্লা বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায়। লোকে ভাবে এখানটাতেই তিনি জন্মেছেন। সৈয়দ আব্দুল হাদীর নানা আগরতলায় আইন পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। পিতা কর্মসূত্রে ছিলেন কলকাতা শহরে। সৈয়দ আব্দুল হাদীও জন্মের সময় ছিলেন ভারতে, আগরতলার নানাবাড়িতে।

মিঃ হাইজিন: জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি

স্মৃতির শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়

আগরতলা থেকে ফিরেছিলেন বাংলাদেশে। পিতার চাকুরির কারণে সিলেট শহরে থেকেছেন কিছুদিন। ততদিনে নানাও দেশে চলে এসেছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। নানাবাড়িই আবারো তাই সৈয়দ আব্দুল হাদীর ঠিকানা হলো। এখানে অন্নদা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকেই তিনি এসএসসি পাশ করেন।

এই জেলাজুড়ে কত গল্প তার, কৈশোরের সকল শুরুর পদযাত্রা কিংবা প্রাণচাঞ্চল্যের হাতেখড়ি এখানেই। মামাবাড়ি এরশাদ মঞ্জিল এখনো তাকে খুব টানে। কখনো কখনো সময় পেলেই প্রিয় শহরটার কাছে ফিরে যান। এই শহর যে জমা রেখেছে তার হাজারো স্মৃতি, এই শহর যে একজন কিংবদন্তির শৈশবের স্বাক্ষী হয়ে আছে।

সাইকেলের লোভ কিংবা ঢাকা শহরের হাতছানি

পিতা তখন চাকরি করতেন রংপুরে। এসএসসির পর তিনি সৈয়দ আব্দুল হাদীকে বললেন, কারমাইকেল কলেজ দেখতে খুব সুন্দর। তুমি এখানে চলে এসো। সাইকেল কিনে দিবো। তিনি সাইকেল পাবেন এই আনন্দ নিয়ে কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হলেন। কিন্তু ভাল লাগছিলো না। নিঃসঙ্গ লাগছিল খুব।

তাই বাবাকে বললেন, তিনি ঢাকায় যেতে চান। ঢাকায় তখন তার ছোট চাচা থাকেন। তিনি সেখানেই আসলেন। ভর্তি হলেন ঢাকা কলেজে। ১৯৫৮ সালে এই কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে বের হলেন। ঢাকার জীবনকেই তখন আলিঙ্গণ করে ফেলেছেন যেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে তিনি গ্র‍্যাজুয়েট হন।

অথচ তিনি শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন...

কখনো শিল্পী হবেন, গান করবেন, হাজার হাজার ভক্তের হৃদয়ে ঢেউ তুলবেন, সঙ্গীতকেই নিজের পেশা হিসেবে গ্রহণ করবেন, এরকম করে ভাবেননি তিনি। তার ভাবনা খুব সহজ। চেয়েছিলেন শিক্ষক হবেন। সত্যি সত্যি তিনি শিক্ষক হয়েওছিলেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে তিনি শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবনে পদার্পণ করেন।

কিন্তু, সঙ্গীতের যে বীজ তিনি বহন করছিলেন মন ও মগজ জুড়ে, সেটাই তাকে শিল্পী হওয়ার তাড়না জোগাচ্ছিলো। তিনি বুঝতে পারছিলেন শিক্ষকতা করতে গিয়ে অনেক কথা বলতে হয়। গলার উপর চাপ যায়। ফলে কণ্ঠের ক্ষতি পারে এরকম ভাবনা চলে আসায় তিনি শিক্ষকতার চাকুরিটি ছেড়ে দিলেন। তার মনে হলো, গানের প্রতি যে ভালবাসা, যে আত্মীয়তা তিনি অনুভব করেন তাকে ক্ষয়ে যেতে দেয়া যায় না।

যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনে। এখানেও থাকলেন না বেশিদিন। এরপরই একটা চাকুরি পেলেন, যা তার সাথে বেশ ভাল মানিয়ে যায়। পাবলিক লাইব্রেরিতে নিযুক্ত হলেন। এখানে তার সময় কাটতো বেশ চমৎকার। বই পড়তেন। লাইব্রেরিকে এমন ভাবে ঢেলে সাজালেন যেন অনেকেই আনন্দ নিয়ে বইপত্র পড়তে উৎসাহী হয়। লন্ডনের ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়ে আসলেন লাইব্রেরি সাইন্সের উপর ডিগ্রীও। পাবলিক লাইব্রেরিতে কর্মরত থাকাকালেই সারাদেশে গণগ্রন্থাগার করবার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। 

জন্মভূমিতে মাতাল হাওয়ার দিনগুলো

এইদিকে দেশে যুদ্ধ যুদ্ধ আবহ। ঊনসত্তরের সেই উত্তাল দিন, অসহযোগ আন্দোলন, মিছিল, সংগ্রাম। এমনই সময়ে চুপ করে বসে থাকা যায় না। সৈয়দ আব্দুল হাদীও নিশ্চুপ ছিলেন না। তার সবচাইতে বড় যে অস্ত্র, সঙ্গীতের গলা, তাকেই কাজে লাগালেন তিনি। বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ নামে একটা সংগঠন হলো। তিনি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। সারাদেশে তারা ঘুরে ঘুরে গান করতেন। মানুষকে সংগ্রামের প্রতি উদ্ধুদ্ধ করতে সচেষ্ট হন। 

উত্তাল সেই সময়ের একদিন আলতাফ মাহমুদ আসলেন। সৈয়দ আব্দুল হাদীকে জানালেন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য গান রেকর্ড করতে হবে। কিন্তু, নিরাপদ কোনো জায়গা নেই যেখানে গানগুলো রেকর্ড করা সম্ভব। সর্বত্রই শকুনের চোখ। আব্দুল হাদী এক কথায় জানিয়ে দিলেন, চিন্তা নেই, গান হবে, আমার বাড়িতেই হবে। গভীর রাতের নিস্তব্ধতার নির্জনে তারা কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে দিয়ে গানগুলো রেকর্ড করেন।

"গানবাজনা জানো না, গাইতে আসো ক্যান?"

এখন ভাবলে রীতিমতো অবিশ্বাস্য লাগবে হয়ত, কিংবদন্তি সঙ্গীত শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদীকেই এমন কথা শুনতে হয়েছিল। হয়ত এই বাক্যটাই গান সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি পালটে দিয়েছিল। সময়টা কলেজ জীবনের। এর আগে কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোথাও পারফর্মেন্স করেননি তিনি। বন্ধুমহলে গাইতেন, ঘরে গাইতেন গুণগুণ করে। ধমক টমকও খেতে হতে গান গাওয়ার জন্যে।

একবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের এক প্রোগ্রামে বন্ধুরা তাকে অনুপ্রেরণা দিয়ে মঞ্চে পাঠালো। তিনি সেখানে গান গাইলেন, অসাধারণ গলা তার। দর্শকশ্রোতারাও হাত তালি দিয়ে নবীন শিল্পীকে অভিনন্দিত করলো। কিন্তু, তবলা বাদককে খানিক বিরক্ত মনে হলো। তিনি সৈয়দ আব্দুল হাদীকে ডেকে বললেন, কোন তালে গানটা গাইলা? আব্দুল হাদী বিভ্রান্ত হলেন খানিক। গানের আবার তাল কি এমন ভাব।

তবলা বাদক আরো খানিক বিরক্তি নিয়ে বলেই ফেললেন, গানবাজনা জানো না, গাইতে আসো ক্যান? গল্পটা নিজের মুখেই বর্ণনা করছিলেন শিল্পী। লেজেন্ডারি এই শিল্পীকে নিয়ে একটি বায়োগ্রাফি ডকুমেন্টারি চোখে পড়লো ইউটিউবে ঘুরতে ঘুরতে। নিরস ডকুমেন্টারি ঘরানার হলে হয়ত ভিডিওটা দেখতামই না, কিন্তু নির্মাণশৈলী এবং আব্দুল হাদীর কথা বলার ধরণের কারণে হলো, ডকুমেন্টারি নয় জীবনের গল্প দেখছি। 

বাংলাঢোল ইউটিউব চ্যানেলে লেখক ও নির্মাতা সাদাত হোসাইনের নির্মাণে কিংবদন্তির গল্প শুনতে শুনতে এই জায়গায় এসে থমকে গেলাম, যেখানে তাকে বলা হচ্ছে, গানবাজনা জানো না! অবশ্য বুঝতে সমস্যা হলো না, শিল্পী নিজে কথাটাকে বেশ স্পোর্টিংলি নিয়েছিলেন। তবে তার মনে কথাটা দাগ কেটে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন, গান একটি বিদ্যা, এবং এই বিদ্যা অর্জনের একটি প্রক্রিয়া আছে।

সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত যে প্রতিভা তাকে শান দিতে হলে, প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। আব্দুল হাদী তারপর থেকে সঙ্গীত বিদ্যার কলাকৌশলকে আয়ত্ত করতে সচেষ্ট হলেন। তবে তার নিজস্ব পদ্ধতি ছিল। তার গান শেখবার স্কুল যেন বিশ্বজোড়া। যেখানে তিনি যার কাছ থেকে যতটুকু জানা যায়, শেখা যায় তাই শিখেছেন। তারপর নিজের স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করেছেন, আর আমরা পেয়েছি আমাদের সঙ্গীতভুবনের এক অসাধারণ এক গুণী শিল্পীকে।

গোলাপী এখন ট্রেনে

তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলে থাকতেন। এইসময় হলের অডিটোরিয়ামে একটি প্রোগ্রামে এলেন বিখ্যাত শিল্পী তালাত মাহমুদ৷ গান শোনালেন। সেই একই অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সুযোগ হয় সৈয়দ আব্দুল হাদীর। তখনো তিনি প্রফেশনালি সঙ্গীতের জগতে পদার্পণ করেননি। তিনি গান গাইলেন দুরু দুরু বুকে, সেদিন তার সাথে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো।

প্রোগ্রামে সুরকার করিম শাহাবুদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। তিনি এসে সৈয়দ আব্দুল হাদীকে সিনেমায় প্লে ব্যাক করার প্রস্তাব দেন। আব্দুল হাদী ভীষণ চমকে যান। এরকম একটি প্রস্তাব এতোটাই আচমকা আসবে আশা করেননি তিনি। কিন্তু, রাজি হলেন। সেই প্রথম সিনেমায় গান গাওয়া তার, শুরুটা হয়েছিল এক উর্দু সিনেমায় কিন্তু পরের কয়েক দশক তিনি বাজিমাত করেছেন বাংলা গান দিয়েই।

১৯৭৮ সালে 'গোলাপী এখন ট্রেনে' সিনেমায় তার গাওয়া প্রতিটি গান শ্রোতাদের মুখে মুখে এখনো ফেরে। 'একবার যদি কেউ ভালবাসতো' কিংবা 'আছেন আমার মোক্তার, আছেন আমার ব্যারিস্টার' এই জনপ্রিয় গানগুলো সেই ১৯৭৮ সালের সৃষ্টি, অথচ এখনো শ্রোতার কানে বাজে মধুর মতোন। কারণ, গানের মধ্যে নিজস্ব গায়কী দিয়ে ওই ম্যাজিক্যাল এক মাধুর্য তিনি মিশিয়ে দিয়েছেন, যা নেশার মতো মাদকতা তৈরি করে।

আউল বাউল লালনের দেশে মাইকেল জ্যাকসন এলো রে..

এই অদ্ভুত গানটিও তার গাওয়া, দারুণ ব্যাপার হলো এই গানের জন্যে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছিলেন। পুরস্কারের পেছনে তাকে ছুটতে হয়নি কোনোদিন৷ পুরস্কার তার পেছনে ছুটেছে, তাকে সম্মানিত করতে পেরে মূল্যবান হয়েছে। আউল বাউল লালনের দেশে মাইকেল জ্যাকসন এসে সবার মাথা খাওয়ার ব্যাপারটা প্রতীকী।

নিজস্ব সংস্কৃতিকে অবহেলা করে না বুঝেই অনেকে পাশ্চাত্যকে ধারণ করতে যায়। একতারার সুরকে অনুধাবনের আগেই তারা ভাবে অন্ধ অনুকরণে মাথা ঝাঁকালেই বুঝি স্মার্টনেস। সেই আগ্রাসী তারুণ্যকেও মাটির কাছে ফিরতে হয়, নকল ভাবটা ছুঁড়ে ফেললে নিজের কাছে ফিরতে হয়। তখন দরকার নিজের গান, নিজের মনোজগৎ উঠে আসে যে গান সেই গানকে দরকার হয় সঙ্গী হিসেবে। 

এমনই গান গেয়েছিলেন সৈয়দ আব্দুল হাদী, বিচ্ছেদ কিংবা ভালবাসা, প্রিয়তম'র প্রতি ব্যাকুলতা অথবা জন্মভূমির প্রতি প্রগাড় বন্ধন, তার গানে ঘুরে ফিরে এসেছে কত রকমের অনুভূতি। বাংলার জল হাওয়া এমনিতেও সঙ্গীত বান্ধব, এই মাটি জলে বাউলদের একতারা যেমন কথা বলে, তেমনি কথা বলে সৈয়দ আব্দুল হাদীর গানও। কথা কিংবা সুরে ভিন্নতা, কিন্তু এই গানও আমাদেরই গান, যে গান আমাদেরই কথা বলে। তাই বলতেই পারি, আউল বাউল লালনের দেশে এসেছেন একজন সৈয়দ আব্দুল হাদীও, যিনি আমাদের মানুষ, যিনি আমাদের কিংবদন্তি! 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা