আমরা প্রায় সবাই দাবি করি যে আমরা সমব্যথী। আমরা একে অপরকে বুঝি বা বোঝার চেষ্টা করি। অপরের দুঃখে আমাদের মন কাঁদে। না কাঁদলেও মন খারাপ হয়। আসলেই কি তাই?

আচ্ছা, আমরা যদি সমব্যথী হই তাহলে এত এত হৃদয় ভাঙার গল্প কি করে তৈরী হয় বলতে পারেন? আজকাল প্রচুর মানুষ নিজেকে সমব্যথী দাবি করলেও, আসলে এই সংখ্যাটা অনেক কম। যে সমব্যথী, সে ভয়াবহ স্পর্শকাতর একজন মানুষ। সে মানুষের দুঃখ-কষ্ট এমনভাবে ফিল করে, যেন সেগুলো তার নিজের। সে শুধু মানুষের মনের দুঃখে স্পর্শকাতর না, অন্যের শারীরিক কষ্টও তাকে আহত করে। এবং এই মানুষগুলোই অল্পতে রিঅ্যাক্ট করে, কষ্ট পায় আর খুব অল্প কিছুর জন্যই তারা নিজেকে উজাড় করে দেয়।

আপনি নিজে সমব্যথী কিনা অথবা যে দাবি করছে, আসলেই সে সমব্যথী কিনা, সেটার একটা কুইক চেক আমার এই লেখার মাধ্যমে করে ফেলতে পারেন। নিচে ১০টা সাইন বা আচরণ সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করলাম। মিলিয়ে নিন, আপনার জন্য অথবা আপনার আশেপাশের মানুষের জন্য।

১। মানসিক স্বাস্থ্য- একজন সমব্যথী খুব সম্ভবত অতীত কিংবা বর্তমানে ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি, মুড সুইং কিংবা অন্যান্য মানসিক রোগের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে অথবা গেছে। আপনি একদিনে সমব্যথী হবেন না, এটা লাইফ লং প্র্যাক্টিস। আপনি যখন ক্রমাগত নিজের পা অন্যের জুতায় ঢুকাবেন, তাদের দুঃখ-কষ্ট-বেদনা-যন্ত্রণা আপনাকে স্পর্শ করবে, করতেই থাকবে জীবনভর। তাই জীবনের দীর্ঘ সময় অন্যকে বুঝতে চাওয়া মানুষগুলোর ৯০% সময়ে মানসিক রোগের শিকার খুব সহজেই হয়।

২। খুব অল্পতেই অসুস্থ্য হয়ে পরা- তাদের বাহ্যিক স্বাস্থ্য খুব নাজুক হয়। এর মানে এই নয় তারা চিকনা পটকা টাইপ কিছু। অথবা ক্যান্সার তাদেরকে সবার আগে আঘাত করে। তারা খুব ছোট্ট ব্যথা পেলেও সেটা অনেকদিন বহন করে, ইচ্ছা করে যে করে তা না। তারা যেকোনো ব্যথা থেকে- সেটা মানসিক কিংবা শারীরিক হোক, বের হতে অন্যদের থেকে একটু বেশি সময় নেয়।

৩। প্রকৃতি এবং প্রাণীকুলের প্রতি ভালোবাসা- গাছ, ফুল, পাখি, আকাশ, নদী, সমুদ্র, পাহাড়... কত কিছু আমাদের চারপাশে। এ সবকিছুই তাদের টানে। বৃষ্টি তারা মুগ্ধ হয়ে দেখতে দেখতে একসময় মন খারাপ করে ফেলে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই মানুষগুলো অগ্রাহ্য করতে পারেনা। অবশ্য অনেক মানুষই পারেনা। তবে এই মানুষগুলো সমুদ্রে পা ভেজায়, ঘাসের উপর খালি পায়ে হাটে। বৃষ্টিতে কখনো কখনো ছাতা ফেলে ভিজতে চায়। কুকুর-বিড়াল কিংবা গাছের ছোট্ট পাখিটাকে তাদের বুকে নিয়ে ভালোবাসতে ইচ্ছা করে।

ছবি- লেখক ও তাঁর কন্যা

তাদের মাথায় ঢুকবেনা- মানুষ কীভাবে পশু পাখি পিটিয়ে মেরে ফেলে! তবে কোনো বিষয়ে ট্রমা থাকলে যেমন গাছ থেকে পরে গিয়ে আঘাত পাওয়া অথবা কুকুরের কামড় ইত্যাদি ব্যতিক্রম তৈরী করে।

৪। তীব্র আর অবাধ্য অনুভূতি- চাইলেও ভোলা যায়না, চাইলেও চোখ বন্ধ করে থাকা যায়না। এই মানুষগুলো প্রতি মুহূর্তে এই দ্বন্দ্বের ভেতর থাকে। তারা নিজেরা নিজেরা কষ্ট পায় এটা ভেবে যে মানুষ কী করে এত স্বার্থপর আর নির্বিকার হয়। কেন একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে মেরে ফেলবে! ভালোবাসা এত জটিল হবে কেন? শুধু নিজের স্বার্থ ভেবে কী করে একটা মানুষ তার পুরো জীবন কাটিয়ে দেয়?

তাদের রাগ যেমন ভয়ংকর ধ্বংসাত্মক, তাদের স্যাডনেসকে বলা হয় সৌল ডেস্ট্রাকশন। তারা আপনার আনন্দে সত্যি সত্যি খুশি হবে, কোনো ভণ্ডামি নেই। 'ধুর! জাহান্নামে যাক, আমার কী'- এই কথা বলেও তারা আসলে সেই বিষয় নিয়ে ক্রমাগত চিন্তা করতে থাকে। বিষয়টা প্যানিক লেভেলে চলে যায়।

৫। চারপাশের মানুষগুলো তাদের কাছে খোলা বই- এই একটা সুবিধা কিংবা অসুবিধা তাদের আছে। তারা অন্যকে সহজেই পড়ে ফেলতে পারে। তাদের ইন্টুশন ভয়াবহ লেভেলের। আর সেজন্য তারা বুদ্ধিমান আর বিচক্ষণ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সমস্যা হলো তারা মিথ্যা আর ভণ্ডামি সবার আগে ধরে ফেলে। আপাত দৃষ্টিতে এটা খুব উপকারী মনে হলেও, এই বিষয়গুলো তাদের সবচেয়ে বেশি কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

অপর ব্যক্তির প্রতি প্রাইমারি জাজমেন্ট তৈরী হয়, যা পরবর্তীতে সেই ব্যাক্তির সাথে তার সম্পর্ক কেমন হবে তা নির্ভর করে। মিথ্যুক ভন্ডদের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরী করা যায় না। শেষটাতে তাই তাদের বন্ধু সংখ্যা কম হয়ে যায়, তারা বেশিরভাগ সময় একা থাকে। কারণ ধুলে ভরা এই বিশাল সমাজ তারা সবসময় সাফ করতে পারেনা।

৬। সেনসিটিভ টু প্যারানরমাল- এটা বিতর্কিত, কিন্তু বিষয়টা খুব মজার। তারা যে ভূত-টুত দেখে, এমন না। তবে তারা যেহেতু ইন্টুশনাল, তারা একটা ভাইব পায়। ভালো খারাপ নিয়েই মানুষ। তবুও কিছু মানুষ আসলে বেশি খারাপ, আবার কেউ কেউ বেশিই ভালো। মানুষের মধ্যেই শয়তান আর ফেরেশতা বাস করে। তারা সেটা খুব ভালো করে দেখতে পায়। নিচের এই কথাটা একজন এম্প্যাথ/সমব্যথী বলেছেন, যা হয়তো এই প্যারানরমাল বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করবে।

''Generally speaking, I can figure out within the first couple of minutes upon meeting someone if I like them or not. How is this possible? Some people call it a 'gut instinct', some feel they are a 'good judge of character'. For me, it’s all about the vibes. And from my experience, vibes don’t lie.''

৭। শিশু এবং প্রাণীরা তাদের সহজেই বিশ্বাস করে- আমরা অনেকেই ছোট বাচ্চা খুব পছন্দ করি কিংবা গৃহপালিত পশু পাখি। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখি তারা আমাদের পছন্দ করে কিনা? মানে চিনেন না। জানেন না ধুপ করে একটা বাচ্চা দু হাত মেলে আপনার কাছে কেন আসতে চাইবে? কোথা থেকে এই বিশ্বাস জন্মায়? যারা সমব্যথী, তাদের মধ্যে ছোট শিশুদের আকর্ষণ করার এক অভূতপূর্ব ক্ষমতা থাকে। আর আমরা সবাই একটা জিনিস জানি তা হলো- ছোট শিশুরা বুঝতে পারে ভালো মানুষ কারা।

রাস্তার কুকুরটা কিংবা বিড়ালটা এমনি এমনিই আপনার বন্ধু হয়ে যাবে না। কিন্তু এই মানুষগুলো সহজেই অবহেলিত পশু পাখিদের আকর্ষণ করতে পারে। আর সেজন্যই উপরে বলেছি তারা সেনসিটিভ টু প্যারানরমাল এনার্জি ।

৮। তারা বিবেচক এবং চিন্তাশীল- তাদের মাথায় প্রায় প্রতিটা মুহূর্তে ঘুরতে থাকে যে কাউকে আঘাত করা যাবেনা, কষ্ট দেয়া যাবে না। মূলত মানুষ কী ভাবলো, তার কথায় কষ্ট পেলো কিনা, তার আচরণে আঘাত পেলো নাকি। এগুলো ভাবতে ভাবতেই তারা তাদের জীবন পার করে।

যারা আমার এই লেখাটা এই পর্যন্ত পড়েছেন, তারা অলরেডি বুঝে গিয়েছেন- সত্যিকারের সমব্যথী হওয়া আসলে একটা অভিশাপ, আশীর্বাদ না।

৯। মানুষের ভুল বোঝাবুঝির শিকার- অবশ্যই মানুষ তাদেরকে ভুল বুঝবে। কোনো কারণই নেই মানুষ তাদের এই ওভার ইমোশন ভ্যালিডেট করবে। এত সময় কার আছে? তাদেরকে সবসময় একটা কথাই শুনতে হয়, তা হলো- 'তুমি অনেক ইমোশনাল'। ইমোশনাল লোকজন কেউ ডিল করতে চায় না। এই মানুষগুলো সারাক্ষন ভাবে আমাকে বদলাতে হবে, এত আবেগ ভালো জিনিস না। না, আপনাকে বদলাতে হবে না। আপনারা বদলে গেলে মানবতা অন্য ব্যাখ্যা পাবে। আর সত্যি হলো আপনি বদলাতে পারবেন না। তাই লাভ নাই সেই চেষ্টা করে। বরং নিজের অনুভূতিগুলোকে বুঝেন এবং অপাত্রে মুক্তা দান করা থেকে নিজেকে দূরে রাখেন।

যার সমবেদনা দরকার, তার পাশে দাঁড়ান। কিন্তু যার দরকার নাই, যে বুঝবে না। তাকে নিয়ে ভেবে নিজের এনার্জি নষ্ট করবেন না।

যার সমবেদনা দরকার, তার পাশে দাঁড়ান

১০। গোটা পৃথিবীটা একটা পাঠশালা- যেহেতু অন্যকে 'বোঝার চেষ্টা' আপনার আজীবনের সঙ্গী, তাই আপনি ক্রমাগত শেখেন। সবকিছু থেকে… শিশু থেকে পোষা বিড়ালটাকেও আপনি জানতে চান। এই জানার চেষ্টা, বোঝার চেষ্টা আপনার আজীবনের। তাই এই মানুষগুলো ভালো কাউন্সেলর, থেরাপিস্ট, ক্যারিয়ার কোচ, শিক্ষক ইত্যাদি ধৈর্যশীল পেশায় ভালো করে।

সবশেষে, আবেগ-অনুভূতি সবারই আছে। কাছের মানুষকে বোঝার চেষ্টা আমরা অনেকেই করি। পশুপাখি-গাছপালা নিয়ে অনেকেই জীবন কাটায়। কিংবা সন্তান পালন-লালন করেই কারো কারো হয়তো একটা জীবন কেটে যায়। মানুষের ভুল বোঝাবুঝির শিকার আমরা কে না হই? কিংবা পূর্ব অভিজ্ঞতা দিয়ে খারাপ ভালো মানুষ চিনতে হয়তো আমাদের আর কষ্ট হয়না। তাই বলে কি আমরা সত্যিকারের সমব্যথী?

একজন সমব্যথীর উপরের ১০টা বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ১০টাই থাকতে হবে। এটা কোনো রোগ না যে ৪/৫ টা কমন পড়লে এন্টিবায়োটিক খাওয়া যেতে পারে। সমব্যথী হলো একটা ব্যক্তিত্ব, যা ব্যক্তির সাথে ওতপ্রোতভাবে ২৪ ঘন্টা জড়িয়ে থাকে। সমব্যথী হলো একটা যন্ত্রণা, যা আজীবনের।

সোর্স: সাইকোলজি টুডে, টাইমস ম্যাগাজিন (মেন্টাল হেলথ এডিশন ২০১৯), থট ক্যাটালগ (সোসাইটি ফর বেহেভিওরাল সাইকোলজিস্টস)


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা