ত্রিপুরার সাব্রুম শহরের পর জলেপার কাছাকাছি এক চা দোকান। কাঠফাটা রোদে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত আমরা ক'জন জিরিয়ে নিতে থামলাম একটা ছোট্ট টং টাইপ চা দোকানে।

আমি যেহেতু চা খাইনা, তাই আমি অন্যদের চা-সিগারেট খাওয়া দেখছি। মনে মনে বেশ বিরক্ত, কারণ ঘুরতে বের হয়ে কেউ যখন চা-বিড়ি খাবার অজুহাতে ঘন্টায় ঘন্টায় সময় নষ্ট করতে থাকে তখন আমার বেশ বিরক্ত লাগে। কিন্তু যারা খায় তাদের জন্য এটা প্রয়োজনীয় এবং যেহেতু তাদের দল সবসময়ই ভারী তাই আমার চুপ করে সহ্য করা লাগে। 

একটু আগে দালালের কাছ থেকে রূপী কিনেছি। আলাদা কয়েকজন থেকে অল্প অল্প করে কিনেছি বলে পকেটে পাঁচশো ও একশো রুপীর নোটগুলো দলাই-মলাই করে রাখা। কিছুক্ষণের মধ্যে খরচ করে ফেলবো তাই ভাজ করে মানিব্যাগে রাখিনি। 

বিল দিতে পকেট থেকে পাঁচশো রূপীর প্রায় নতুন অথচ অযতনে পকেটে রাখায় কিঞ্চিত দলাই-মলাই হয়ে যাওয়া নোটখানা দোকানীকে এগিয়ে দিলাম। দোকানী টাকাটা নিয়ে বললেন, 

"দাদা, আপনারা বোধহয় বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, তাই জানেন না। আমাদের এদিকে নোট আমরা খুব যত্ন করে ব্যবহার করি। কলমের কালি তো দূরের কথা। ভাঁজ পড়ে গেলে একশো/পাঁচশো রুপীর নোট আর চলে না। কেউ নিতে চায় না। আপনারা জানেন না দেখে আপনাদেরটা নিচ্ছি। টাকা সরকারের, আমরা বাহক মাত্র। টাকা যত্ন করে ব্যবহার করুন দাদা!" 

উনার কথাতে আমি লজ্জিত হয়ে উনাকে সরি বললাম। উনি নিজের ক্যাশ খুলে দেখালেন। কোনো জীর্ণ টাকাই চোখে পড়লো না। এরপর থেকে দেশে বা দেশের বাইরে টাকা ব্যবহারে আমি খুব সাবধানী ও যত্নবান হয়ে গেছি৷ 

অথচ আমাদের দেশে টাকার বান্ডিলে প্রথমেই সেলাই মারে ব্যাংকগুলো। টাকা জমা নেয়ার সময় স্টাপলার মারে। কলম দিয়ে বান্ডিলের নোট সংখ্যা লিখে ব্যাংকের ক্যাশিয়ার। তারপর আমাদের হাতে আসলে আমরা টাকায় নিজের নাম ঠিকানা লিখি, মনের অব্যক্ত কথা-প্রেমের আহবান, ফোন নাম্বার- কিচ্ছু বাদ দেই না। 

নোয়াখালী বিভাগ চাই, খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই, বঙ্গবন্ধুর চশমাকে কালো কালি দিয়ে সানগ্লাস বানাই, গালে তিল আঁকি, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়িও বানায় কেউ কেউ! আজ তো দেখলাম এক অতি-উৎসাহী ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি রীতিমত টাকার উপর রাবার স্ট্যাম্প দিয়ে সিল মেরে দিয়েছেন- "জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ:) ভিন্ন আর কেউ নয়"। 

এই অনাচার কমাতে সরকার একবার দেশে দশ টাকার পলিমার নোট বের করেছিল। কিন্তু কিসের কী! কয়দিনের মধ্যেই জনগণ আবিস্কার করে ফেললো পলিমার নোটে একটু ব্লেড ছুইয়ে দিলেই কাম খাল্লাস! ছ্যাড়ছ্যাড় করে বাকিটা ছিড়ে যায়! সেই পলিমার নোটও বেশিদিন টিকলো না। এ দেশে কাপড় দিয়ে টাকা বানালেও মা-বোনরা সুই-সুতা দিয়ে সেলাই করে লিখবে "যাও পাখি বল তাঁরে", আর আমরা বাপ-ভাইরা রুমাল হিসেবে টাকা দিয়ে নাকের সর্দি মুছবো!

এত থাগ আর সোয়াগ কেন আমরা? কীভাবে পারি এত কিছু? 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা