টেক দ্য বল, পাস দ্য বল: সর্বজয়ী এক ফুটবল দল ও একটি অসাধারণ ডকুমেন্টরি
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
গার্দিওয়ালার কোচিংয়ের চার বছরে বার্সেলোনা ১৪টি ট্রফি জয় করে- এ তো বাইরের ইতিহাস। কিন্তু কেমন ছিলো পেছনের গল্প? কীভাবে একটি ছন্নছাড়া দল হয়ে উঠলো ইতিহাসের সেরা?
সময়টা ২০০৮। চ্যাম্পিয়নস লীগ আর কোপা ডেল রে থেকে বিদায় নিয়েছে বার্সেলোনা সেমিফাইনাল থেকেই। লীগ হারিয়েছে আরও আগে। লীগে তৃতীয় হলেও রিয়াল মাদ্রিদের সাথে পয়েন্টের ব্যবধান ১৮। কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দিলো রিয়াল মাদ্রিদ নু ক্যাম্পে এসে বার্সাকে ৪-১ গোলে হারিয়ে। মাঠের বাহিরেও ভালো নেই তারা। দলের সেরা তারকা রোনালদিনহো প্রায় দুই বছর ধরে নিজের ছায়া হয়ে আছেন। তার নাইট লাইফের গল্পে পত্রিকার পাতা সরগরম। শোনা যায়, কোচ ফ্রাঙ্ক রাইকার্ডের সাথেও তার সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছে না। সাথে চলছে রাইকার্ডের মেয়ের সাথে রোনালদিনহোর প্রেমের গুঞ্জন। সব মিলিয়ে বার্সেলোনা সভাপতি হুয়ান লাপার্তো ভাবলেন যথেষ্ট হয়েছে। মৌসুম শেষেই রাইকার্ডকে বরখাস্ত করলেন তিনি।
এরপর শুরু হলো কোচের খোঁজ। ইয়োহান ক্রুয়েফের একান্ত ভক্ত লাপার্তো গেলেন তার কাছে পরামর্শ নিতে। ক্রুয়েফ যার নাম নিলেন তিনি ছিলেন লা মেসিয়া একাডেমির তার ফিলোসফির প্রোডাক্ট ও ক্রুয়েফের ড্রিম টিমের মাস্টার মাইন্ড।
কিন্তু তা হলে কী হবে, তার তো বড় কোনও দলের কোচিং এর অভিজ্ঞতা নেই। তিনি কেবল বার্সা বি দলের কোচ, বয়সটাও মাত্র ৩৭। নিজ দলের লিজেন্ডদের কোচ বানানোর যে প্রথা এখন দেখা যায় সেটা তখনও শুরু হয়নি। তবুও ক্রুয়েফের কথায় ভরসা করে লাপার্তো ঝুকিটা নিয়ে নিলেন। সবার চোখ ছানাবড়া করে বার্সা কোচের দায়িত্ব দিলেন জোসেপ গার্দিওয়ালাকে।
তখন কেউ জানতো না চমকের কেবল শুরু। প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই তিনি ঘোষণা করে দিলেন রোনালদিনহো, ডেকো এবং ইতোকে আমার দরকার নেই। শুধু তাই না, বার্সার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে সাইন করার চেষ্টাতেও জল ঢেলে দিলেন এই বলে, তাকে আমি দলে জায়গা দিতে পারবো না। বরং আমার একজন নাম্বার নাইন লাগবে। সবশেষে বললেন, ড্রেসিং রুমের পরিবেশ উন্নত করতে হবে।
মৌসুম শুরুর আগেই বিদায় নিলেন রোনালদিনহো এবং ডেকো। কিন্তু ইতো'ও থেকে গেলেন। গার্দিওয়ালা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে নিয়ে আসলে জেরার্ড পিকে, সেভিয়া থেকে দানি আলভেজ এবং সেইডু কেইতাকে। বি-দল থেকে প্রমোশন দিলেন সার্জিও বুসকেটসকে।
এরপরেও মৌসুম শুরু হলো হার দিয়ে। অজ্ঞাত, অখ্যাত নুমান্সিয়ার কাছে বার্সেলোনা হেরে বসলো ১-০ তে। বাসায় বসে খেলা দেখছিলেন ইয়োহান ক্রুয়েফ এবং তার ছেলে সাবেক বার্সা খেলোয়াড় জর্ডি ক্রুয়েফ। খেলা শেষে হতাশ জর্ডি বললেন, এসব কি করছে গার্দিওয়ালা? ক্রুয়েফ উত্তর দিলেন, অনেকদিন পর ট্যাকটিক্যালি এতো দুর্দান্ত খেলা দেখলাম। জর্ডি বিস্মিত হলেও মেনে নিলেন।
তার বাবা যে ফুটবল জিনিয়াস, যিনি ভবিষ্যৎ দেখতে পান। এরপরের ম্যাচেও যখন রেসিং সানতান্দারের সাথে বার্সা ড্র করলো তখন সবার মাথায় হাত। কিন্তু বার্সার ঘুরে দাঁড়ালো ঠিক এর পর থেকেই। তারপরের ইতিহাস প্রায় সবারই জানা। পেপ গার্দিওয়ালার বার্সা ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে এক মৌসুমে ৬টা ট্রফি জয় করে। তার কোচিং এ চার বছরে বার্সেলোনা ১৪টি ট্রফি জয় করে। এতো বাহিরের ইতিহাস। কিন্তু কেমন ছিলো পেছনের গল্প? কিভাবে একটি ছন্নছাড়া দল, হয়ে উঠলো ইতিহাসের সেরা?
সেই গল্পই বলা হয়েছে, 'টেক দ্য বল, পাস দ্য বল' ডকুমেন্টরিতে। এর নাম নেওয়া হয়েছে গার্দিওয়ালার বিখ্যাত ফিলোসোফি থেকে, যা ডকুমেন্টরির শুরুতেই দেখানো হয়। এটা মূলত সাক্ষাৎকার ভিত্তিক ডকুমেন্টারি। যেখানে কথা বলেছেন সে সময় বার্সা দলে খেলা - মেসি, জাভি, পিকে, ইনিয়েস্তা, পুয়োল, ভিক্টর ভালদেস, দানি আলভেস, বুসকেটস, মাশেরানো, আবিদাল, ইতোও, গুডনজনসন ও থিয়েরে অরি। কথা বলেছেন সে দলের বিপক্ষে খেলা মাইকেল ক্যারিক, কোচ ফাবিও ক্যাপোলা এবং ক্রুয়েফের সন্তান ও সাবেক বার্সা খেলোয়াড় জর্ডি ক্রুয়েফ। তার দলের খেলোয়াড়েরা বলেছেন, কিভাবে গার্দিওয়ালা ট্রেনিং সেশনের পরিবর্তন আনেন। কিভাবে তিনি তার ফিলোসফি মাঠ এবং মাঠের বাহিরে সর্বত্র প্রয়োগ করতেন।
মাঠ এবং ট্রেনিং সেশনের বাহিরেও খেলোয়াড়দের উপরে গার্দিওয়ালার ছিলো তীক্ষ্ণ নজর। খেলার অবস্থা যেমনই হোক তিনি কখনই তার ফুটবল ফিলোসফির বাহিরে যেতেন না। কেউ এমন করলে তাকে সাবস্টিটিউট করে দেওয়ার ঘটনাও মজা করে বলা হয়েছে ডকুমেন্টারিতে।
গার্দিওয়ালার বিভিন্ন ট্যাকটিকস ব্যাখা করে দেখিয়েছেন জাভি, যার মধ্যে বিখ্যাত ফলস নাইন ট্যাকটিকসও আছে। খেলোয়াড়েরা বলেছেন তাদের সাথে কোচের সম্পর্কের কথা, ইতোও কে চলে যেতে বলার পরেও তিনি কিভাবে গার্দিওয়ালার দলে জায়গা করে নিলেন সে কথা। যেকোনও ফুটবল ভক্তই জানে লিওনেল মেসির 'দ্য মেসি' হয়ে ওঠার পেছনে গার্দিওয়ালার ভুমিকা কতখানি। এইখানে সেকথাও উঠেছে স্বয়ং মেসির মুখে। মাইকেল ক্যারিক এবং ক্যাপোলা বলেছেন সেই বার্সেলোনা দলের বিপক্ষে খেলা কতখানি কঠিন ছিলো।
গার্দিওয়ালার চার বছরে বার্সেলোনা দুইবার চ্যাম্পিয়নস লীগ জয় করে। কেমন ছিলো সেই পথ সেটা বার্সালেনোর খেলোয়াড়েরা যেমন বলেছেন, তেমনি তাদের বিপক্ষে ফাইনাল খেলা মাইকেল ক্যারিকও বলেছেন তার দলের অভিজ্ঞতার কথা। মরিনহো রিয়ালের কোচ হয়ে আসার পর এল ক্ল্যাসিকোর চেহারা পরিবর্তন হয়ে অনেক হিংস্র হয়ে যায়। এবং গার্ডিওলা ও তার দলের উপর এর প্রভাব পড়ে ভীষণ। মরিনহোর মিশনই যেনও ছিলো গার্ডিওলাকে মাঠে এবং মাঠের বাহিরে ধ্বংস করে দেওয়া। সে সময়ে মাঠের বাহিরের অনেক টেনশনও উঠেছে খেলোয়াড়দের বর্ণনায়।
ডকুমেন্টারিতে আমরা এও জানতে পারি এত সাফল্যের পরেও কেনও বিদায় নিয়েছিলেন গার্ডিওলা। কোথায় বার্সেলোনার সাথে সুর তাল কেটে গিয়েছিলো তার। এসবের সাথে যুক্ত হয়েছে মাঠ ও মাঠের বাহিরের বিভিন্ন বিষয়ে ছোট ছোট ক্লিপিংস। দুর্দান্ত ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে তৈরি করা হয়েছে সিনেম্যাটিক আবহ। দেখতে দেখতে কিভাবে সময়টুকু কেটে যাবে টেরই পাওয়া যায় না।
যারা বার্সেলোনা ভক্ত, তাদের পুরানো স্মৃতি রোমন্থনের যাত্রাটুকু কাটবে অসাধারণ। যারা ভক্ত নন তারাও উপভোগ করবেন একটি দলের সর্বোজয়ী হয়ে ওঠার পেছনের শ্রম, ত্যাগ এবং মানসিকতাটুকু। ডকুমেন্টরির শেষে রয়েছে ছোট্ট চমক, সেটা নাহয় না বলাই থাক। ডকুমেন্টরিটি পরিচালনা করেছেন ডনকান ম্যাকম্যাথ। এটি ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে মুক্তি পায়। এর আইএমডিবি রেটিং ৮.১।
ডকুমেন্টরিতে কিছু উল্লেখযোগ্য উক্তি:
- পেপ যদি আমাকে বলতো নু ক্যাম্পের তৃতীয় তলা থেকে লাফ দাও, তাহলে আমি তাই দিতাম। কারন, আমি জানতাম এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনও ভালো উদ্দেশ্য আছে - ড্যানি আলভেজস
- আমি ৬-২ (রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে) উপভোগ করেছি। আমি মৃত্যুর আগেও এটা নিয়ে চিন্তা করতে চাই - জাভি
- আপনি জানেন আপনি বিশেষ কিছু করছেন যখন মানুষ দেখতে চাইবে আমি কিভাবে খেলছেন, কিভাবে জয়ী হচ্ছেন সেটা নয় - অরি
- কৌশলগতভাবে পেপ সবার সেরা। তার মতো কেউ ফুটবলে খেলে না - ইতোও
- আমি ভাগ্যবান আমি পেলে ও ক্রুয়েফের বিপক্ষে খেলেছি। ম্যারাডোনাকে খেলতে দেখেছি। তারা তাদের মতো ইতিহাস তৈরি করেছেন কিন্তু মেসির মতো কেউ নেই। সে অসম্ভবকে সম্ভব করে- ফ্যাবিও ক্যাপোলা
- টেলিভিশনে যদি কোনও খেলা হয় এবং সেটাতে যদি বার্সেলোনা খেলে তাহলে আমি সবসময় বার্সেলোনাকেই বেছে নিবো। তারা এতোটাই ভালো - মাইকেল ক্যারিক
সবমিলিয়ে ফুটবল ভক্তদের জন্য এ এক অসাধারণ ডকুমেন্টরি, যা সকল ফুটবল ভক্তদের দেখা উচিত।
*
প্রিয় পাঠক, এই লেখাটি একজন কন্ট্রিবিউটর লিখেছেন। চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন