'আমার ঘর; আমার বাড়ি, গর্বের ধন টাঙ্গাইল শাড়ি'

জ্বী, গর্বের ধন টাঙ্গাইল শাড়ি। আমরা, যাদের জন্মই হয়েছে তাঁতের খটখট শব্দ শুনে, তারা কয়জন জানি কী প্রাচীন, কী সমৃদ্ধ আমাদের এই তাঁত শিল্প ও তাঁত শিল্পের ইতিহাস! কিন্তু বেশীর ভাগই জানি না, অথচ তাঁত আছে আমাদের প্রায় প্রত্যেকের বাড়িতে। কোন না কোনভাবে আমরা তাঁত নির্ভর বা টাঙ্গাইল শাড়ি নির্ভর জীবিকার উপর নির্ভরশীল।

'তোমায় জন্ম দেওয়ার ব্যথা না পাইলে
তোমার জন্ম শব্দ পাব না
তোমার কথা শুনতে পাব না'

তাঁতের সুমধুর, হ্যাঁ ঠিকই পড়েছেন, তাঁতের সুমধুর, সুললিত খটখট শব্দকে আমি জন্মশব্দই বলি। ভুমিষ্ঠ হওয়ার আগেই প্রায় দশমাস এই সংগীত শুনেই তো বড় হই। আসুন রুটি-রুজির এই আঁতুরঘর, আমাদের জন্মশব্দ সম্পর্কে একটুখানি জানার চেষ্টা করি।

শাড়ির কথা আসলে নারীর কথা কি না এসে পারে! বাঙালি নারীর প্রধান পরিধেয় বস্ত্র কী, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না নিশ্চয়ই। শাড়ীই নারীর প্রধান পরিধেয় এবং তা সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই।

শাড়ি ঠিক কতটা প্রাচীন?

খ্রীস্ট পূর্ব দ্বিতীয় থেকে প্রথম শতকে চন্দ্রকেতুগড় থেকে পাওয়া একাধিক পোড়ামাটির ফলকে শাড়ির সবচেয়ে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। শাড়ি ব্যবহারের নিদর্শন মিলে অষ্টম শতকের পাহাড়পুরের পোড়ামাটির ফলকেও। তবে তখনকার শাড়ি পরার ধরন যে এখনকার মতো ছিল না, তা সহজেই অনুমেয়।

চলছে শাড়ি বুননের কাজ

বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার নাম আমরা সবাই শুনেছি। তাঁর এবং হিউয়েন সাঙ এর ভ্রমণ কাহিনীতেও স্থান পেয়েছে আমাদের টাঙ্গাইলের এই বস্ত্র, তথা তাঁত শিল্প।

শাড়ি নিয়ে কথা হলে অবধারিতভাবে আসবে মসলিন শাড়ীর নাম। শোনা যায়- এই জগৎ বিখ্যাত মসলিন শাড়ী বুনতো এক সময় টাঙ্গাইলের তাঁতীরা। এ সবই এখন হারানো ঐতিহ্য। তবে মসলিন শাড়ী কালের প্রভাবে বা বিদেশী বণিকদের কূটচক্রান্তে কালের গর্ভে বিলীন হলেও সেই কালেরই সাক্ষী বা উত্তরাধিকার হিসেবে টিকে আছে টাংগাইলের জামদানী, বেনারসী ও তাঁতের শাড়ী।

টাঙ্গাইলে তাঁতীদের আগমন কেন বা কীভাবে?

টাঙ্গাইল তাঁতশিল্প কিন্তু দেশের সর্ববৃহৎ কুটির শিল্প বা লোকশিল্প। টাঙ্গাইলে তাঁতশিল্প প্রসার প্রায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে। ইতিহাস থেকে জানা যায়- বসাক সম্প্রদায়ের লোকেরাই টাঙ্গাইলের আদি তাঁতী। মূলত হিন্দু তাঁতীদের মৌলিক উপাধি হলো বসাক। এরা আসলে দেশান্তরী তাঁতী। ঢাকা ও ধামরাই ছিল যাদের আদি নিবাস।

মূলত ঊনিশ শতকে মসলিনের দুর্দিন শুরু হলে বা আবহাওয়াগতভাবে আরও ভালো জায়গার খোঁজে এরা বসতি স্থাপন করে টাঙ্গাইলে। পরবর্তীতে এ শিল্পের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পরে বসাক ছাড়াও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা এবং তাঁরা বসাক তাঁতীদের মতোই দক্ষ হয়ে ওঠেন। মুসলমান তাঁতীদের বলা হয় জোলা বা কারিগর।

তাঁতের রকমফের

তাঁত শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত 'তন্তু' থেকে। লাখো মানুষের জীবিকা নির্বাহের হাতিয়ার তাঁতেরও রয়েছে রকমফের। যেমন- পিট লুম বা গর্ত তাঁত বা খটখটি তাঁত, চিত্তরঞ্জন বা মিহি বা জাপানী তাঁত, ফ্রেম লুম, কোমর তাঁত।

ভারতীয় উপমহাদেশের পুরাতন তাঁতযন্ত্র এই পিটলুম বা গর্ত তাঁত। বিখ্যাত মসলিন শাড়ী তৈরি করা হতো এই পিটলুমেই। এখন তৈরি হয় ঐতিহ্যবাহী জামদানীসহ অন্যান্য শাড়ি।

তাঁতে বোনা হচ্ছে শাড়ি

এই তাঁতের সাথে পরবর্তীতে যোগ করা হয় ফ্লাই শাটল, যা তাঁতপল্লীতে মাকু নামে পরিচিত। এই মাকু দিয়ে একটির পর একটি সূতা গেঁথেই তৈরি হয় টাংগাইলবাসীর স্বপ্ন, জন্ম হয় টাঙ্গাইল শাড়ীর। মাকু যখন দ্রুত গতিতে দুই পাশে বাড়ি খায়, তখন সৃষ্টি হয় খটখট শব্দের। সব সৃষ্টিই একই সাথে কষ্টের, বেদনার এবং আনন্দের। খটখট শব্দের জন্যেই এই তাঁতের এমন নাম- খটখটি তাঁত।

গর্তে বসানো লাগে না এমন খটখটি তাঁত শুধুমাত্র তাঁত নামেই পরিচিত। এটার আঞ্চলিক আপডেট ভার্সন হ্যান্ডলুম নামে পরিচিত। মর্টার বসিয়ে করা হয় সেমি অটোমেটিক টাইপ। চলে বিদ্যুতের সাহায্যে, ফলে এর উৎপাদন ক্ষমতাও বেশী। আবার সম্পূর্ণ অটোমেটিক তাঁত, পাওয়ার লুম নামে যেটি পরিচিত, সেটি চব্বিশ ঘন্টাই উৎপাদনে সক্ষম।

শাড়িতে বিভিন্ন বাহারি নকশা করার জন্য পরবর্তীতে যুক্ত হয়েছে ডবি ও জ্যাকার্ড মেশিন। সহজ-সরল তাঁতীদের কাছে এই জ্যাকার্ড মেশিনই জ্যাকেট বা মালা। দিন দিন নকশা করার কাজে প্রযুক্তি তথা কম্পিউটারের ব্যবহারও বাড়ছে।

শাড়ি বিক্রি হয় যেখানে

তাঁতের তৈরি শাড়িগুলো বর্তমানে কোথায় বিক্রি হয়, তার সহজ উত্তর- অনলাইন বা ফেসবুকভিত্তিক বিভিন্ন পেইজ বা হাল আমলের লাইভগুলোতে।

যদি ফিরে যাই ইন্টারনেট যুগের আগে, তবে বলতে হয় দেশ ভাগের পূর্বে মহানগরী কলকাতায় বসতো টাঙ্গাইল শাড়ির বাজার। স্টীমার বা জাহাজে চড়ে কলকাতায় যেতেন তাঁতীরা। কলকাতা তথা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ীরা কিনতেন এই সব সুন্দর সুন্দর ডিজাইনের তাঁতের শাড়ী। বর্তমানে টাঙ্গাইলের বাজিতপুর ও করোটিয়াতে বসে টাঙ্গাইল শাড়ীর বড় বাজার।

শেষ করছি দুই লাইনের লোক প্রবাদ দিয়ে..  

'চমচম টমটম ও শাড়ি
এই তিনে টাঙ্গাইল বাড়ি'

হ্যাঁ, আমার বাড়ি টাঙ্গাইল এবং আমি একজন গর্বিত জোলা।

*

প্রিয় পাঠক, এই লেখাটি একজন কন্ট্রিবিউটর লিখেছেন। চাইলে 'এগিয়ে চলো'তে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

সিটিজেন জার্নালিজমের চর্চা করতে যোগ দিন এগিয়ে চলো বাংলাদেশ ফেসবুক গ্রুপে

আরও পড়ুন-


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা