তানিয়ার নোটবুক: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক করুণ দুঃখগাঁথা!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
মা মারা গেছেন, ১৯৪২ সালের ১৩ই মে, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। ঝেনিয়া, দাদী, আঙ্কেল ভাসিয়া, আঙ্কেল লেশা- সবাই মারা গেছে। বেঁচে আছে শুধু ছোট্ট তানিয়া, একদম একা!
আর্কটিক সাগর আর ইলমেন লেকের মাঝখানের শহর লেলিনগ্রাদ; শান্ত, নিরিবিলি, ছোট্ট নদীর মতো বহমান এখানকার মানুষজনের জীবনও। এই শহরেই বাস সেবিচভদের। পরিবারের কর্তা নিকোলাই পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন বছর ছয়েক আগে, স্ত্রী মারিয়ার আশ্রয়ে রেখে গিয়েছিলেন তিন কন্যা আর দুই ছেলেকে। বাড়ীতে স্বচ্ছলতা নেই ততটা, আছে মায়ার খনি। একান্নবর্তী পরিবারের সবটুকু ভালোবাসা আর মনোযোগ নিজের ওপর টেনে রাখে বারো বছরের তানিয়া সাবিচেভা, সবার ছোট; সবার বড্ড আদরের।
একদিন দমকা হাওয়ার মতো সেবিচভদের এই শান্তির নীড়েও লাগলো আগুন, পুড়লো গোটা শহরটাই, হিংসা আর লোভের দাবানলে ভষ্মীভূত হলো গোটা দুনিয়ার দুই-তৃতীয়াংশ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল তখন জোরেশোরে বাজছে। যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে দিকে দিকে, পরাশক্তিরা দলে দলে যোগ দিচ্ছে দুই পক্ষে। কান পাতলে শোনা যায় গুলির আওয়াজ, আকাশে চোখ মেললেই বোমারু বিমানের যাতায়াত; আর নাকে এসে ধাক্কা দেয় পোড়া বারুদের গন্ধ, কখনও মৃত লাশের তীব্র দুর্গন্ধে বন্ধ হয়ে আসে শ্বাসনালী।
১৯৪১ সালের মাঝামাঝি সময়, রাশিয়ায় দখলদার জার্মান বাহিনী তখন অপারেশন বার্বারোসা পরিচালনা করছে। ৬ আগস্ট হিটলারের পক্ষ থেকে নির্দেশ এলো- প্রথমে লেলিনগ্রাদ (বর্তমান সেন্ট পিটসবুর্গ), তারপর দনেৎস্কবেসিন (বর্তমান ইউক্রেন), সবশেষে মস্কো আক্রমণের। নির্দেশ পালন হলো, নাজীবাহিনী আক্রমণ করলো লেলিনগ্রাদ। আগস্ট মাস জুড়ে পুরো লেলিনগ্রাদকে রাশিয়ার বাকী সব অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করার কাজ চললো, দফায় দফায় শহরের সীমানা প্রাচীরের বাইরে থেকে নিক্ষেপ করা হলো কামানের গোলা, মর্টার শেলগুলো আছড়ে পড়তে থাকলো শহরের স্থাপনাজুড়ে।
লেলিনগ্রাদ দখলের কোন ইচ্ছাই ছিলো না জান্তা হিটলারের, তার আদেশ ছিল পুরো এলাকাটাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়ার। সেই মতো কাজ করতে থাকে জার্মান সেনারা, শহরে না ঢুকে প্রতিটি দালান ধসিয়ে দেয়ার মিশনে নামে তারা। ৭ অক্টোবর নির্দেশ এলো- রাশানদের কোনপ্রকারের আত্মসমর্পনের চেষ্টা যেন মেনে না নেয় জার্মানবাহিনী। ১৯৪১ এর আগস্ট থেকে ১৯৪৪ এর জানুয়ারী পর্যন্ত প্রায় সাড়ে আটশো দিনের বেশী সময় নাজী বাহিনী অবরুদ্ধ করে রাখে পুরো লেলিনগ্রাদকে। শহর থেকে কেউ বেরুতে পারতো না, পারতো না ঢুকতেও; সেই চেষ্টা করতে গেলেই ওৎ পেতে থাকা জার্মান বুলেটে খুঁজে নিতে হতো মৃত্যুর শীতল আশ্রয়।
সে বছর সেপ্টেম্বরে কামানের গোলা দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয় শহরের সবচেয়ে বড় খাদ্যগুদাম, হাসপাতাল-কলকারখানা-স্কুল সব কিছুই তখন বিধ্বস্ত। তিন হাজার টন আটা, কয়েক হাজার টন মাংস, মাখন আর চকলেটসহ ধ্বংস হয়ে গেলো ‘বাদায়েভ’ এলাকায় থাকা হিমাগারটি; সে রাতে পুরো এলাকার রাস্তাঘাট ভেসে গিয়েছিল গলিত পোড়া মাখন-মাংস-চকোলেটে। রাস্তার পিচের উপর জমাট বেঁধেছিল চিনির স্তুপ। শহরজুড়ে তীব্র দুর্ভিক্ষ, কোথাও খাবার নেই, যার যার সংগ্রহের শেষ সম্বলটুকু পেটে দিয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টায়রত শহরবাসী, একসময় তাও শেষ হয়ে এলো, প্রাণ বাঁচানোর জন্যে শুধু বরফের গোলা খেয়েও তখন লড়ে যাচ্ছে মানুষ। এর মধ্যে শুরু হলো নতুন উপদ্রব, একদল শুরু করলো মৃতদের মাংস খেয়ে উদরপুর্তি, শহরের আইনপ্রয়োগকারি সংস্থা এবার কঠোর হলো, খুঁজে ধরে বের করা শুরু হলো মানুষখেকোদের।
এদের আবার দুটো দল ছিল- একপক্ষ মৃতদেহ খেয়ে ক্ষুধা মেটাতো, আরেক দল জীবিত মানুষ মেরেই করতো মাংসের ব্যবস্থা। প্রথম দলকে জেলে পাঠানো হতো, আর দ্বিতীয় দলের কাউকে গ্রেফতার করা মাত্রই ‘শ্যুট এট সাইট’ অর্ডার ছিল রাশিয়ান পুলিশের উপর।
শুধু ১৯৪২ সালের এপ্রিলেই চুয়াল্লিশজনকে এভাবে গুলি করে মারা হয়। প্রতি মাসে দশ হাজারের বেশী মানুষ মারা যাচ্ছিল শুধুমাত্র ক্ষুধার তাড়নায়; ১৯৪৪ সালে লেলিনগ্রাদ যখন মুক্ত হয়, তত দিনে মাদার রাশিয়ার প্রায় দুই লক্ষ মানুষ বরণ করে নিয়েছে তীব্র যন্ত্রণাকর মৃত্যুকে। তবে লেলিনগ্রাদ অবরোধের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক গল্পটা আমাদের ছোট্ট তানিয়ার দখলে।
১৯৩০ সালের তেইশে জুন জন্ম নেয়া তানিয়া সাবিচেভা লেলিনগ্রাদে অবরোধ শুরুর সময়টায় ছিলো এগারো বছরের শিশু, ছয় বছর বয়সেই বাবাকে হারানো মেয়েটা বেড়ে উঠেছিলো মা, দাদী আর বড় ভাইবোনদের অপত্য স্নেহে। অবরোধ শুরুর সাথে সাথেই পরিবারের সবাই বাধ্যতামূলকভাবে যোগ দেয় শহর প্রতিরক্ষার কাজে। মা মারিয়া কাজ করতেন সেনাবাহিনীর ব্যারাকে, বড়োভাই লেকা কাজ পেয়েছিলো অ্যাডমিরালিটি প্লান্টে, প্ল্যান্ট অপারেটর হিসেবে। দুই চাচা আঙ্কেল লেশা এবং আঙ্কেল ভাসিয়া সেনাবাহিনীর এন্টি-এয়ারক্রাফট ডিফেন্সে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতেন, তানিয়া যাকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসতো, সেই বড় বোন ঝেনিয়া কাজ করতো বারুদের ফ্যাক্টরীতে, আরেক বড় ভাই মিখাইল অবরোধ শুরুর সময়টায় শহরের বাইরে ছিল, তাই প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলো এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে।
ঝেনিয়ার ছোট নিনা কাজ করতো আর্মির কন্সট্রাকশন সাইটে, তাকে বদলী করা হয়েছিলো লেক লাডোগায়, তার খবর কেউ পায়নি পরিবারে; সবাই ভেবেছিলো নিনা মারা গেছে। তানিয়াও বেকার বসে থাকেনি সেই প্রতিকূল সময়টায়, ছোট ছোট দুটো হাতে কোদাল ধরে ট্রেঞ্চ খোঁড়ার কাজে সবাইকে সাহায্য করতো সে, এতটুকু পরমুখাপেক্ষিতা ছিলো না ওর মধ্যে। খুব ডায়েরী লেখার অভ্যাস ছিলো বাদামী চোখের ছোট্ট মেয়েটার, আর গান গাইতে পারতো দারুণ। যুদ্ধের আগে ছুটির বিকেলগুলোয় তানিয়ার গাওয়া গানের সাথে গিটার বাজাতো ওর বড় দুই ভাই। বাকীরা মেলাতো গলা। জন্মদিনে মা উপহার হিসেবে দিয়েছিলো লাল মলাটে বাঁধানো ছোট একটা নোটবুক। তানিয়ার আগেও একটা ডায়েরী ছিলো, কিন্ত নোটবুকটা পাবার পর সেটাই হয়ে গেলো তার দিনরাতের সঙ্গী।
বড় বোন ঝেনিয়ার কথাই লেখা ছিলো বেশী; বছর বিশেকের মেয়েটা কীভাবে মাইন ফ্যাক্টরীতে দুই শিফটে কাজ করে পরিবারের সবার জন্যে প্রতিদিন রুটি আর তানিয়ার জন্যে চকোলেট নিয়ে আসতো তার বর্ণনা। টাকার দরকারে মাঝেমাঝে রক্তও বিক্রি করতো ঝেনিয়া। একদিন কাজ করতে করতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো ঝেনিয়া, সেই জ্ঞান আর ফিরে আসেনি। তানিয়ার ছোট্ট নোটবুকে মৃত্যুর তালিকার শুরুটা এখান থেকেই।
নোটবুকের পরের বিবরণগুলো খুব সংক্ষিপ্ত; একেকটা পাতায় একটা করে লাইন, কিংবা বলা চলে মৃত্যুনামা-
* দাদী মারা গেছেন বিকেল তিনটায়। আজ ২৫শে জানুয়ারী, ১৯৪২।
* লেকা মারা গেছে, ১৯৪২ সালের ১৭ই মার্চ বিকেল তিনটায়।
* আঙ্কেল ভাসিয়া আজ মারা গেছেন, ১৯৪২ সালের ১৩ এপ্রিল, রাত দুটোর পরে।
* বিকেল চারটায় আঙ্কেল লেশা মারা গেছেন, আজকের তারিখ ১০ই মে, ১৯৪২।
* মা মারা গেছেন, ১৯৪২ সালের ১৩ই মে, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। সাবিচেভেরা মারা গেছে। সবাই মারা গেছে। বেঁচে আছে শুধু ছোট্ট তানিয়া, একাকী! মৃত্যুমুখী পোড়া শহরের ধ্বংসস্তপের বুকে একা বেঁচে ছিল মেয়েটা- খাবার নেই, আগুন নেই, পানি নেই- এই অবস্থার মধ্যেও টিকে ছিলো তানিয়া।
১৯৪১ সালের ডিসেম্বরের তীব্র শীতল এক সন্ধ্যায় প্রচণ্ড তুষারপাতের মধ্যে ঘরে বসেছিলো সাবিচেভ পরিবারের জীবিত সদস্যেরা, আগুন জ্বালানোর মতো কিছুই ছিল না, সেই সন্ধ্যায় তানিয়া তার পুরোনো ডায়েরীটা জ্বালিয়ে দিয়েছিল খানিকটা উষ্ণতার আশায়, কিন্ত হাতছাড়া করেনি মায়ের দেয়া নোটবুকটা। বারো বছরের মেয়েটা সেদিন জানতো না, ইতিহাসের এক অমূল্য দলিল একটু একটু করে লেখা হচ্ছে ওর হাতে, এই ছোট্ট নোটবুকটায়। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা কিছু কষ্টের উপাখ্যান- যেগুলো পরে ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে নাজী অফিসারদের বিচারের সময় সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
১৯৪২ সালের আগস্টে অবরুদ্ধ লেলিনগ্রাদ থেকে ১৪০ জন শিশুকে উদ্ধার করা হয়, তাদের একজন ছিল তানিয়া। লেলিনগ্রাদ থেকে দূরে ‘শ্যাটকি’ নামের এক গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয় ওদের, গ্রামবাসীরা সাধ্যমত সেবাশুশ্রূষা দিয়ে তাদের সারিয়ে তোলে। কিন্ত তানিয়াকে সারিয়ে তোলা যায়নি; টিউবারকিউলোসিসে আক্রান্ত তানিয়ার হাত-পায়ের পেশী ক্রমেই শুকিয়ে আসছিলো, প্রতি রাতে তীব্র মাথাব্যথায় চিৎকার করে কাঁদতো মেয়েটা। লেলিনগ্রাদ থেকে উদ্ধার হবার বছর দুয়েক পর, ১৯৪৪ সালের পহেলা জুলাই সকল যন্ত্রণার উর্ধ্বে চলে গেল তানিয়া, এই পৃথিবী আর তার বুকে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর প্রতি অব্যক্ত এক বুক অভিমান নিয়ে।
গোরখোভাস্কার সেই গ্রামের কবরস্থানেই তাকে চিরনিদ্রায় সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর আগে অভাগী মেয়েটা জেনেও যেতে পারেনি যে সাবিচেভদের সবাই মারা যায়নি; তানিয়ার বড় বোন নিনা যুদ্ধ শেষে ফিরে এসেছিল, যুদ্ধে আহত হয়ে ঘরে ফিরেছিল মিখাইলও। নিনা-ই পরে খুঁজে পেয়েছিল তানিয়ার সেই লাল মলাটের নোটবুক- যে নোটবুকের আটটি পাতা এখন সংরক্ষিত আছে লেলিনগ্রাদের ইতিহাস জাদুঘরে; যে লেখাগুলো আজো কাঁদায় রাশানদের।
আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরীর কথা অনেকেই জানেন, কিন্ত জানেন না হয়তো তানিয়া সাবিচেভার নোটবুকের কথা; একটা বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার অল্প কিছু নমুনা আটটা পাতায় স্থান পেয়েছিল যার হাতের লেখায়। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে, হিটলার মরেছেন কি বেঁচেছেন সেটা নিয়েও দ্বন্দ্ব আছে, বিশ্বনেতারা আবার নেমে পড়েছেন মাংসের টুকরোর লড়াইতে- শুধু তানিয়ারা ফিরে আসেনি, কখনও ফিরে আসে না। ওরাই যে যুদ্ধের মূল ভুক্তভোগী!
তথ্যসূত্র-
- 1. https://en.wikipedia.org/wiki/Tanya_Savicheva
- 2. http://www.pravmir.com/article_238.html
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন