ধর্মান্ধতার কাছে যখন হেরে যায় অসাম্প্রদায়িকতা...
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
আটচল্লিশ সেকেন্ডের একটা বিজ্ঞাপন মোটামুটি হইচই ফেলে দিয়েছে গোটা ভারতজুড়ে, লাভ জিহাদের ধুয়ো তুলে ব্র্যান্ডকে বয়কটের ডাক দিয়েছে উগ্রপন্থীরা, রাজনৈতিক নেতারাও শামিল হয়েছেন এই মিছিলে, শেষমেশ বিজ্ঞাপনটাই প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। কি ছিল সেই বিজ্ঞাপনে?
ভালোবাসা আর সাম্প্রদায়িক ঐক্যকে এক বিন্দুতে এনে একটা বিজ্ঞাপন বানানো হয়েছিল ভারতে, বিখ্যাত গয়নার ব্র্যান্ড তানিস্কের জন্য বানানো হয়েছিল বিজ্ঞাপনটি। কিন্ত সেই বিজ্ঞপন পুড়েছে সাম্প্রদায়িকতার ঘৃণ্য আগুনে, কট্টিরপন্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব হয়েছে আটচল্লিশ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপনটির বিরুদ্ধে, দিয়েছে তানিস্ক নামের সেই ব্র্যান্ডকে বয়কটের ডাক। দলবদ্ধ এই আক্রমণের মুখে কর্পোরেট সংস্থা টিকতে পারবে না, টিকতে চাইবেও না- এটাই স্বাভাবিক। আর তাই প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে বিজ্ঞাপনটি, সাম্প্রদায়িক ঘৃণার কাছে হার মেনেছে ভালোবাসা ও মানবতা।
তানিস্কের সেই বিজ্ঞাপনটি বানানো হয়েছিল বেবি শাওয়ার নিয়ে। একটা পরিবারের গল্প উঠে এসেছে সেই বিজ্ঞাপনে, যেখানে হিন্দু এক তরুণী ভালোবেসে বিয়ে করেছে এক মুসলিম যুবককে। ধর্মের পার্থক্য তাদের আলাদা করতে পারেনি। শ্বশুরবাড়ির লোকজনও মেয়েটাকে ভালোবেসে গ্রহণ করেছে। সেই তরুণী যখন গর্ভবতী হলেন, তখন বাড়িতে আয়োজন করা হলো বেবি শাওয়ারের।
দক্ষিণ ভারতীয় রীতিতে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানটিকে ডাকা হয় সীমান্তম বা ভালাইকপ্পু নামে। প্রথম মা হতে চলা মহিলাকে সোনার গহনা, খাবার দেওয়া হয়। কখনও কখনও তার হাতে, মুখে লেপে দেওয়া হয় চন্দন। তার জীবন যাতে সুখে, সমৃদ্ধিতে ভরে ওঠে, তিনি সুস্থ শরীরে সন্তানের জন্ম দিতে পারেন, সেই আশীর্বাদ করা হয় তাকে। অন্ধপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কর্নাটক, তেলঙ্গানায় প্রচলিত আছে এই রীতির। তবে মুসলমানরা এই রীতি পালন করে না, হিন্দু পরিবারগুলোই বছরের পর বছর ধরে এই প্রথা পালন করে আসছে।
বিজ্ঞাপনে ফিরে যাই। উৎসবের দিনে গোটা বাড়ি সেজে উঠেছে গর্ভবতী সেই মায়ের জন্য। সকালে বাড়ির সবাইকে এভাবে ভালোবাসায় মেতে উঠে দেখছে মেয়েটি, এই আয়োজনের মধ্যমণি কেবলই সে। তরুণী বেশ অবাক হয়েই তার শাশুড়িকে প্রশ্ন করছে- 'মা এই রীতি তো আপনাদের (ধর্মে) নেই?' তখন শাশুড়ি পুত্রবধুর মাথায় হাত বুলিয়ে জবাব দিচ্ছেন, 'সেটা নেই, কিন্তু মেয়েকে খুশি করার রীতি তো সব জায়গায় আছে, তাই না?' এর পরই আনন্দে মেতে উঠছে গোটা পরিবার। তানিস্কের গয়নায় সাজানো হচ্ছে পুত্রবধূকে।
এই বিজ্ঞাপন পুরোটা সময় জুড়েই ভালোবাসার গল্প বলে গেছে, সাম্প্রদায়িক হানাহানির এই সময়ে এসে অসম্ভব সুন্দর বার্তা বহন করেছে। কিন্ত এই ভালোবাসাটাও অনেকের কাছে ভালো লাগেনি। বিজ্ঞাপন প্রকাশের পরপরই কট্টরপন্থী হিন্দুদের একটা অংশ এর বিরোধিতায় নেমেছে। তাদের ভাষ্য- বিজ্ঞাপনে 'সেকুলারিজমের' আড়ালে তানিস্ক আসলে 'লাভ জিহাদ'কে প্রমোট করছে। এই লাভ জিহাদ ব্যাপারটা সম্পর্কে যারা জানেন না, তাদের জন্য বলে রাখি- ভারতের উগ্রবাদী হিন্দুদের মতে, কোন হিন্দু নারী যদি মুসলমান কোন পুরুষকে বিয়ে করে, সেটা লাভ জিহাদ বলে গণ্য হবে, এই লাভ জিহাদের ঘোর বিরোধী তারা। তবে হিন্দু পুরুষ যদি মুসলমান নারীকে বিয়ে করে, সেক্ষেত্রে আবার 'লাভ জিহাদ' ফর্মূলা প্রযোজ্য হয় না।
যাই হোক, ক্রমাগত হুমকি দেয়া হচ্ছিল, টুইটার এবং ফেসবুকে ট্রেন্ড হচ্ছিল বয়কট তানিস্ক হ্যাশট্যাগ। এই মিছিলে শামিল হচ্ছিল ভারতের কট্টরপন্থী রাজনীতিবিদেরা। ক্ষমতাসীন দল বিজেপির কয়েকজন হাইপ্রোফাইল নেতা টুইট করেছে, কেন তানিস্কের বিজ্ঞাপনে হিন্দু নারীকে মুসলমানের ঘরেই বিয়ে দেয়া লাগলো? গল্পটা কি অন্যভাবে উপস্থাপন করা যেতো না? লাভ জিহাদের প্রসঙ্গ টেনে এনেছে তারাও।
আবার কংগ্রেস নেতা শশী থারুর এই বিজ্ঞাপনের প্রশংসা করে তানিস্কের পাশে দাঁড়িয়েছেন, প্রশংসা করেছে সেন্সিবল মানুষজনও। এরইমধ্যে গুজরাটে তানিস্কের শোরুমে হামলা করেছে উগ্রপন্থী হিন্দুদের একটা দল, শো-রুমের ম্যানেজারকে দিয়ে জোর করে মাফ চাওয়ানো হয়েছে মারধরের ভয় দেখিয়ে। সামান্য একটা বিজ্ঞাপনের চমৎকার একটা বার্তা যে ধর্মান্ধদের কতটা ভয় পাইয়ে দিতে পারে- সেটারই একটা জ্বলন্ত নিদর্শন স্থাপিত হলো যেন।
ক্রমাগত হুমকির কারনে গতকাল সেই বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার করে নিয়েছে তানিস্ক, অফিসিয়াল একটা স্টেটমেন্টও দেয়া হয়েছে। এরপর আরেকদফা সমালোচনার মুখে পড়েছে ব্র্যান্ডটি, এবার তাদের সমালোচনা করেছে যারা এই বিজ্ঞাপনের প্রশংসা করেছিল, যারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাস করে তারাই। তাদের বক্তব্য হচ্ছে- তানিস্কের উচিত হয়নি এসব হুমকি বা বয়কটের ট্রেন্ডে কান দেয়া। যারা বয়কটের ডাক দিচ্ছে, এরা জীবনে তানিস্ক থেকে কিছু কেনার মতো সামর্থ্যই করতে উঠতে পারবে না। তানিস্ক এভাবে পিছু না হঠলেও পারতো, এতে ধর্মান্ধরা নিজেদের আরও শক্তিশালী ভাববে, এরপরে কোনকিছু তাদের মনমতো না হলেই সেটা নিষিদ্ধের মিশনে নামবে।
এর আগে গত দিওয়ালিতে সার্ফ এক্সেল একটা বিজ্ঞাপন বানিয়েছিল, সেখানে দেখা যাচ্ছিল, পাঞ্জাবি-পাজামা পরা এক মুসলিম শিশু হিন্দুদের হোলি খেলার উৎসবে যোগ দিচ্ছে। সেই বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধেও উঠেপড়ে লেগেছিল ভারতের উগ্রপন্থী কিছু হিন্দু। তখন একটা মজার কাণ্ড ঘটেছিল। গুগল প্লে-স্টোরে গিয়ে তাদের অনেকে মাইক্রোসফট এক্সেলকে এক রেটিং দেয়া শুরু করেছিল, তারা ভেবেছি সার্ফ এক্সেল আর মাইক্রোসফট এক্সেল দুটো একই কোম্পানীর প্রোডাক্ট। ধর্মান্ধদের বুদ্ধি যে হাঁটুতে থাকে, এই ঘটনাটাই তার প্রমাণ।
তবে দিনশেষে এদের জোরের কাছে হার মানতে হয় অসাম্প্রদায়িকতাকে। ঘৃণা জিতে যায় ভালোবাসার বিরুদ্ধে। শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের চিত্রটাও এমনই। এই ধর্মান্ধরা যে দলে ভারী তা নয়, কিন্ত এদের আস্ফালনের সামনে সিংহভাগ মানুষ চুপ করে থাকে, 'ঝামেলায় জড়াব না' ভেবে সেফ জোনে বসে থাকে, আর তাই পেয়ে বসে এরা। তানিস্কের এই বিজ্ঞাপন সরিয়ে নেয়াটাই সেই বার্তা দিচ্ছে।
তানিস্কের আলোচিত সেই বিজ্ঞাপনটি দেখুন এখানে ক্লিক করে-
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন