একজন মাইক্রোফোন হাতে তুলে এনেছেন নির্যাতিতা তরুণীর ওপর প্রশাসনিক বর্বরতার চালচিত্র, আরেকজনকে শত শত পুলিশ মিলেও আটকে রাখতে পারছিল না দায়িত্ব পালন থেকে। তনুশ্রী পান্ডে এবং প্রতিমা মিশ্র- এই দুই তরুণ সাংবাদিক ভারতের রাজনীতিকেই বড়সড় একটা ঝাঁকুনি দিয়েছেন...

পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে প্রতিদিন গড়ে ৮৭টা রেপ হয়। গ্যাংরেপের ঘটনাও প্রতিদিন গোটাদশেক ঘটে, ধর্ষণের পরে ভিক্টিম খুনের শিকার হন শতকরা সাত পার্সেন্ট ঘটনায়। বড়ে বড়ে দেশ মে অ্যায়সি ছোটে ছোটে বাতে হোতি র‍্যাহতি হ্যায়- আর তাই মিডিয়ার নজর সেসবের ওপর পড়ে না। দলিত বা নিম্নবর্ণের নারীদের ওপর নির্যাতনও প্রতিদিনই ঘটে, পুলিশ মামলা নেয় না, অভিযোগ জানাতে গেলে আরেক দফায় হেনস্থা হওয়া লাগে, ঠাকুর সমাজ বা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দাপটে চাপা পড়ে যায় নির্যাতিতার আর্তচিৎকার। উত্তর প্রদেশের হাথরাসের দলিত তরুণী মনীষা বাল্মীকির ঘটনাটাও আড়ালে থেকে যেতো, হয়তো কেউ জানতোও না অবর্ণনীয় যন্ত্রণা ভোগ করে মারা যাওয়ার পর কি ঘটেছিল মনীষা বা তার পরিবারের সঙ্গে, ২৮শে সেপ্টেম্বরের রাতে যদি হাথরাসে তনুশ্রী পাণ্ডে হাজির না থাকতেন। 

তনুশ্রী পাণ্ডে, ছাব্বিশ বছর বয়স, কাজ করেন ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল ইন্ডিয়া টুডে-আজ তকের হয়ে (দুটো একই কোম্পানীর মালিকানাধীন চ্যানেল, একটা ইংরেজী, আরেকটা হিন্দি)। ছোটবেলা থেকেই তনুশ্রী প্রতিবাদী, অন্যায় সহ্য করতে পারেন না। তাই ঠিক করে রেখেছিলেন, বড় হয়ে আইনজীবী বা সাংবাদিক হবেন। পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে তার চাকরির মেয়াদ পাঁচ বছরের বেশি হবে, গ্রাউন্ড রিপোর্টিংটাই করেন মূলত, দিল্লিতে ডিউটি তার। গণধর্ষণ এবং মারধরের শিকার মনীষা বাল্মীকি যেদিন মারা গেলেন, খবর পেয়েই ক্যামেরাম্যানকে সঙ্গে নিয়ে তনুশ্রী ছুটে গিয়েছিলেন দিল্লির সফদার জং হাসপাতালে। আরও কয়েকজন সাংবাদিক ছিলেন সেখানে, তবে পুলিশের বাইট নিয়ে সবাই হাওয়া হয়ে গেছেন। 

মনীষার লাশ নিয়ে পুলিশ যখন হাথরাসের পথে রওনা দিয়েছে, তখন তনুশ্রী দোটানায় ভুগছেন, সেদিকে যাবেন কি যাবেন না। অফিসে ফোন দিলেন, তাকে বলা হলো, যাওয়াটা মেন্ডেটরি নয়, তবে যেতে চাইলে অফিসের আপত্তি নেই। গাড়িতে উঠে বসলেন তনুশ্রী, সঙ্গে ক্যামেরা পার্সন ওয়াকার আহমেদ। রাতের আঁধার কেটে ইন্ডিয়া টাইমসের গাড়ি ছুটে চললো দিল্লি থেকে তিন ঘন্টা দূরত্বের হাথরাস জেলার দিকে। ক্লান্ত শরীরটা সিটে এলিয়ে রাখা মনীষা তখনও জানেন না, কয়েক ঘন্টা পরে একটা ইতিহাসের জন্ম দিতে যাচ্ছেন তিনি, তার ধারণ করা একটা ছোট্ট ভিডিও আর সরবরাহ করা তথ্যের কারনে দ্রোহ আর প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়বে সারা দেশে, দুর্বলের ওপর প্রশাসনিক নির্যাতনের অবিশ্বাস্য এক চিত্র তুলে আনবেন তিনি! 

তনুশ্রী পান্ডে

হাথরাসে তনুশ্রীদের গাড়ি যখন পৌঁছালো, তখন একপ্রস্থ নাটক মঞ্চস্থ হয়ে গেছে সেখানে। নির্যাতিতা তরুণীর পরিবারকে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা মেরে লাশ নিয়ে চলে গেছে পুলিশ, যে কোন মূল্যে রাতের মধ্যে লাশের শেষকৃত্য করে ফেলতে হবে, যাতে নতুন করে কোন ঝামেলা তৈরি না হয়। খবর পেয়ে তনুশ্রী ছুটলেন শ্মশানের দিকে, পথে তাকে আটকে দিলো পুলিশ। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ছাব্বিশ বছরের এই তরুণী একের পর এক প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে থাকলেন, পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে রইলো নিশ্চুপ। অনেকটা দূর থেকেই পুড়তে থাকা শবের ভিডিও ধারণ করলেন তনুশ্রী, আশেপাশে গিজগিজ করতে থাকা পুলিশের মাঝখানে দাঁড়িয়েই একমাত্র সাংবাদিক হিসেবে রিপোর্ট করলেন, জানালেন, প্রশাসনের তরফ থেকে কি অমানবিকতা আর বর্বরতার নজির স্থাপন করা হয়েছে হাথরাসে। 

মোবাইলে ধারণ করা ভিডিওটা টুইটারে আপলোড দিয়ে তনুশ্রী লিখলেন- “অবিশ্বাস্য! আমার ঠিক পেছনেই হাথরস মামলার নির্যাতিতা তরুণীটির দেহ পোড়ানো হচ্ছে। পুলিশ তার পরিবারের সবাইকে ঘরে আটক করে রেখেছে। আর সবার অগোচরে গ্রামের এক প্রান্তে এনে লাশ পোড়াচ্ছে!” সেই টুইট আর ভিডিওটা ভাইরাল হয়ে গেল মুহূর্তেই, রাতের আঁধারে চাপা আক্রোশ দানা বাঁধলো মানুষের মনে, যার কারিগর ছিলেন তনুশ্রী পাণ্ডে। জন্মসূত্রে বাঙালি এই তরুণী সেদিন না থাকলে এই অবিচারটা ধামাচাপা দেয়া যোগী আদিত্যনাথের সরকারের পক্ষে অসম্ভব কিছু ছিল না। সেটা সম্ভব হয়নি শুধু তনুশ্রীর কারনেই। গোটা ভারত তো বটেই, লণ্ডন-নিউইয়র্কের মিডিয়াও হাথরাসের এই নির্মম ঘটনা ফলাও করে প্রচার করেছে তনুশ্রীর বরাত দিয়ে! 

পরদিন যখন পুরো গ্রাম পুলিশ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে, তনুশ্রীর করা ফলোআপ রিপোর্টের পরে সাংবাদিকেরা গ্রামের বাইরে জড়ো হচ্ছেন, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট গিয়ে ধমক দিচ্ছেন নির্যাতিতার পরিবারকে, তখন ফোনে তাদের ভরসা দিয়েছেন তনুশ্রীই, নিহত মনীষার ভাইকে তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, সব মিডিয়া চলে গেলেও তিনি যাবেন না, এই ঘটনার শেষ দেখে ছাড়বেন। এসবের মূল্যও অবশ্য দিতে হচ্ছে তনুশ্রীকে। বিজেপির আইটি সেল তার ক্যারেক্টার অ্যাসাসিনেশনে লেগে পড়েছে, তার ফোন ট্যাপ করেছে উত্তর প্রদেশ সরকার, তাকে 'কংগ্রেসের দালাল' হিসেবে উপস্থাপনের সর্বোচ্চ চেষ্টাই চলছে চারপাশে। 

রাতের আঁধারে ডিজেল দিয়ে মনীষার দেহ পোড়াচ্ছে পুলিশ

তনুশ্রী পাণ্ডের ইন্সটাগ্রাম প্রোফাইল খুঁজে বের করলাম, নামের নিচে লেখা- 'প্রথাবিরোধী এবং মানবতাবাদী। আমি সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ, নিরপেক্ষতার প্রতি নয়।' আর্টিকেল ফিফটিন সিনেমায় আয়ুষ্মান খুরানার একটা সংলাপ আছে- 'কোথাও আগুন লাগলে সেখানে নিরপেক্ষ থাকার মানে হচ্ছে যে আগুনটা লাগিয়েছে তাকে সাপোর্ট করা।' তনুশ্রী সেই ঠুনকো নিরপেক্ষতার দিকে না হেঁটে অসহায়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন, নির্যাতিতের কান্না তুলে এনেছেন রিপোর্টে। কলেজে পড়ার সময় নিজেকে 'রেবেল' হিসেবে পরিচয় দিতো যে মেয়েটা, সে আসলেই ডাকাবুকো একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে! 

আরেকজনের কথা না বললেই নয়। ছোটখাটো গড়ন, উচ্চতা মেরেকেটে পাঁচ ফিট দুই, লিলিপুট সাইজ বললে ভুল হবে না খুব একটা। রাত তিনটায় তনুশ্রীর রিপোর্টের পর দিল্লি থেকে ঝাঁকে সাংবাদিক ছুটে গিয়েছিলেন হাথরাসের দিকে, কিন্ত পুলিশের বাধার মুখে পড়েছেন সবাই। কেউ ফিরে এসেছেন, কেউবা ব্যারিকেডের সামনে দাঁড়িয়েই রিপোর্ট করেছেন। এবিপি নিউজের হয়ে গ্রাউন্ড রিপোর্ট করতে আসা প্রতিমা মিশ্র পুলিশি বাধার ধার ধরলেন না, হাতে মাইক্রোফোন ধরে ছুটে গেলেন ব্যারিকেড পেরিয়ে। হা রে রে করে তেড়ে এলো পুলিশ, প্রতিমা ধমক দিলেন, 'খবরদার, গায়ে হাত দেবেন না!' ছোটখাটো শরীরে বাঘের গর্জন বেরুচ্ছিল যেন! 

মেশিনগানের গুলির মতো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে গেছেন প্রতিমা, একটারও কোন জবাব ছিল না পুলিশের কাছে। হাঁটতে হাঁটতে গ্রামে ঢুকে পড়েছিলেন তিনি, গোটা সময়টা একনাগাড়ে প্রশ্ন করে গেছেন- কেন গ্রামে কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না? কার অর্ডারে? কেন এত গোপনীয়তা? সাংবাদিকদের এত ভয় করছে কেন পুলিশ? নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গে দেখা করলে কি সমস্যা? তোতাপাখির মতো মুখস্ত উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল পুলিশ- ওপরের অর্ডার। ঢুকতে দেয়া যাবে না। প্রতিমার ঝাঁঝালো জবাব- "শো মি দ্য অর্ডার। ওপরটা কে? ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট? পুলিশ সুপার? নাম বলুন! কথা বলিয়ে দিন আমার সঙ্গে!" 

শুধু প্রতিমাকে আটকানোর জন্য থানা থেকে নারী পুলিশ আনা হয়েছে, চ্যাংদোলা করে ধরে তোলা হয়েছে পুলিশের গাড়িতে, সেখানে বসেও লাইভ স্ট্রিমিং বন্ধ রাখেননি প্রতিমা। নিজের ক্যামেরাম্যান মনোজকে ধমক দিয়েছেন- খবরদার! ক্যামেরা যেন বন্ধ না হয়! মনোজ বেচারা করুণ গলায় বলেছে, ব্যাটারি শেষ হয়ে আসছে, চেঞ্জ করতে হবে। ক্যামেরার চার্জ ফুরিয়েছে বারবার, প্রতিমার এনার্জি কমেনি একটুও। পুলিশের গাড়ি যখন তাকে ছেড়ে এসেছে গ্রামের বাইরে, ব্যারিকেডের সামনে পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়েছেন তিনি, বসেছেন ধর্ণায়। গলা ভেঙে গেছে, তবুও তিনি কথা বলে চলেছেন, প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছেন স্থানীয় প্রশাসনকে। 

পুলিশি ঘেরটোপের মাঝেই চলছে প্রতিমার গ্রাউন্ড রিপোর্টিং

এই দুই সাংবাদিকের গ্রাউন্ড রিপোর্টিংয়ে মোদিভক্ত মিডিয়ার একটা বড় অংশ আচমকাই যেন বদলে গেল কিছুক্ষণের জন্য। সারাবছর সরকারের তোষামোদে ব্যস্ত থাকা টিভি চ্যানেলগুলো প্রশ্ন ছুঁড়তে শুরু করলো সরকারের দিকে। সমালোচনায় জর্জরিত হতে হতে উত্তর প্রদেশের সরকারও বুঝে গেল, ঘটনার লাগাম হাতছাড়া হয়ে গেছে তাদের। বাধ্য হয়েই একদিন পরে গ্রামে ঢোকার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলো, সাংবাদিকদের অনুমতি দেয়া হলো নির্যাতিতার পরিবারের সাথে কথা বলার। ভারতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তখন শুরু হয়েছে তনুশ্রী আর প্রতিমার স্তুতি, এক তরুণীকে ন্যায় এনে দিতে সাহসী সাংবাদিকতার অনন্য নজির স্থাপন করে ফেললেন দুজনে। 

স্বাভাবিক সময় হলে এই রিপোর্টিং নিয়ে এত হইচই হতো না। কিন্ত গত ৬/৭ বছর ধরে ভারতের ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া যেভাবে ক্ষমতা আর অর্থের কাছে নিজেদের বর্গা দিয়ে বসে আছে, সেই অবস্থাটা জানা থাকলে প্রতিমা আর তনুশ্রীকে মহাবিপ্লবের নায়ক হিসেবে আখ্যা দিতে দুবার ভাবতে হবে না। টিভি চ্যানেলগুলোর মধ্যে এক এনডিটিভি ছাড়া প্রতিটাই বিক্রি হয়ে গেছে মোদি সরকারের কাছে। প্রাইম টাইমে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানো হয় প্রতিনিয়ত, রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতায় সরকারের বদলে দায় চাপানো হয় বিরোধীদের কাঁধে। সেই গোদি মিডিয়ার একটা বড় অংশই যে দুই নারীর অবদানে বদলে যাবে আচমকা- সেটা কেউ ভাবতে পারেনি। তনুশ্রী-প্রতিমারা না থাকলে হাথরাস কখনোই এতটা ফুটেজ পেতো না, মানুষের আগ্রহ তৈরি হতো না, উত্তর প্রদেশের সরকার আর ঠাকুর সমাজ মিলে ধামাচাপা দিয়ে ফেলতো গোটা ব্যাপারটাকেই। 

একটা সময় ছিল, যখন ভারতে হাথরাস কান্ডের মতো এরকম কিছু ঘটলে আগে সেখানে বিরোধী দলের নেতারা যেতো, তাদের বাইট নেয়ার জন্য পিছু পিছু ছুটতো মিডিয়া। তনুশ্রী বা প্রতিমা সেখানেও নতুন একটা ইতিহাস তৈরি করেছেন। বিরোধী নেতাকর্মীরা যখন পুলিশের বাধায় কয়েকশো মাইল দূরে আটকে গেছেন, তনুশ্রী আর প্রতিমারা তখন কাঁটাতার আর ব্যারিকেডের বাধা পেরিয়ে গ্রামে ঢুকে পড়ছেন, সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিচ্ছেন, প্রমাণ করে দিচ্ছেন- কেন মিডিয়াকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়! এই দুর্দমনীয় সাহস, মেরুদণ্ড সোজা রেখে সৎ সাংবাদিকতা করার প্রয়াসটা দেখে অজান্তেই মনটা ভালো হয়ে যায়, শ্রদ্ধায় নত হয়ে আসে মাথা...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা