‘জীবন যেখানে দ্রোহের প্রতিশব্দ- মৃত্যু সেখানে শেষ কথা নয়।’ – প্রিয় তানযীর তুহিন, মানুষ হারালেও সৃষ্টি কখনো হারায় না। আর এজন্যই আমরা স্রষ্টায় ভালোবাসি...

মোহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত:

ব্যান্ড সংগীতের মূলত কোনো সঠিক প্রতিশব্দ আমার জানা নেই। যতদূর জানি প্রচলিত আধুনিক বাংলা গান ঘরানার বাইরে গিয়ে রক ঘরানার সঙ্গীতকেই ব্যান্ড সঙ্গীত বোঝায়। গুগলে জমাকৃত এবং আমার স্বল্পদৈর্ঘ্য জ্ঞানে এর বাইরে বাংলা ব্যান্ডের বিশদ বিবরণ আমার জানা নেই।তারুণ্যের উচ্ছ্বাস,প্রেয়সীর ভালোবাসা অথবা বিদ্রোহী কোনো প্রতিবাদ;এই সবকিছু প্রকাশের জন্য জগৎজুড়ে অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম এই ব্যান্ড সংগীত। 

স্বাধীন বাংলার জন্মলগ্নে এদেশের ব্যান্ড সংগীতের যেই দুরন্ত বিপ্লব ঘটে বাংলাদেশে তার শুরুটা হয় গুরু আজম খানের ব্যান্ড "উচ্চারণ" আর ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই'দের ব্যান্ড "স্পন্দন" এর মাধ্যমে। এরপর পালাক্রমে একে একে আবির্ভাব হয় সোলস, ফিডব্যাক, টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরী, বালার্ক, এ্যাবনর্মাল, থ্রি প্লাস সহ মাইলসের মতো সব লেজেন্ডারি ব্যান্ডের। আশির দশকের মাঝামাঝিতে আবির্ভাব হয় আরেক সাড়া জাগানো ব্যান্ড ওয়ারফেইজের। তার কিছুদিন পর সঞ্জীব চৌধুরীর হাতেগড়া ব্যান্ড "দলছুট" জন্ম নেয় নব্বই দশকের দিকে। 

নব্বই দশকের অন্যতম জনপ্রিয় রকস্টার গুরু জেমস, আইয়ুব বাচ্চু এবং হাসান ছিলেন তৎকালীন ব্যান্ড ফিলিংস/এলআরবি/আর্ক ব্যান্ডের লিড ভোকাল। এই ব্যান্ডগুলোর মাধ্যমেই বাংলা গান তাঁর সোনালী অধ্যায় রচনা করে। ভাগ্য সহায়; তখনকার মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে পাইরেসি আর পেনড্রাইভ নামক জলাতঙ্ক ছিলোনা। শুনেছি এই ব্যান্ডগুলোর সিডি ক্যাসেট রিলিজ হবার পর একপ্রকার হট্টগোল লেগে যেত গলির মোড়ের সিডির দোকানে। বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের প্রতি কতটা ক্রেজ ছিলো সেই প্রজন্মের কল্পনা করা যায়! 

এই ছিলো আমাদের ব্যান্ড সংগীতের সোনালী ইতিকথা; এবার আসি বর্তমানে। নব্বই দশকের শেষদিকে এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে জন্ম নেয়া ব্যান্ডগুলোর তালিকা ক্রমাগত দীর্ঘায়িত হলেও পাইরেসি আর পেনড্রাইভের কবলে পড়ে এই ব্যান্ডগুলোর অস্তিত্ব যেন অস্তমিত সূর্যের মতই বেওয়ারিশ হয়ে পড়েছে। ব্যান্ডগুলো বর্তমানে টিকে থাকার একমাত্র উৎস লাইভ কনসার্ট। এটা আবার মৌসুমী চাহিদা নির্ভর। আর তাই জীবিকার তাগিদে প্রায় নিরানব্বই ভাগ মিউজিসিয়ানই ব্যক্তিগত কাজে মনোনিবেশ করে আছেন।

এতকিছুর মাঝেও কিছু মিউজিশিয়ান আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আমাদের ব্যান্ড মিউজিকের সোনালী ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে। ঠিক তেমনই একজন মিউজিসিয়ান সম্পর্কে আজ বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করবো। তিনি তানযীর তুহিন। শিরোনামহীন ব্যান্ডের সাবেক ভোকাল ও বর্তমানে আভাস ব্যান্ডের মূল কারিগর যিনি। মানুষটা জন্মেছিলেন ঊনিশশো চুয়াত্তর সালের আজকের দিনে। তার শৈশব-কৈশোর-যৌবনের প্রায় পুরোটা সময় কেটেছে জাদুর শহর ঢাকাতে। ছেলেবেলায় মা চাইতেন ছেলে গান শিখুক যাতে চারপাশের চলমান রাহুরগ্রাস থেকে ছেলে মুক্ত থাকে। তাই একপ্রকার জোর করেই গান শিখতে যেতে হতো এই মানুষটির। 

তানযীর তুহিন

এরপর বুলবুল ললিতকলা একাডেমী (বাফা) তে নজরুল সঙ্গীত এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বিষয়ে অধ্যয়ন করেন তিনি। আর সেখানেই ওস্তাদ আখতার সাদমানি, নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী, নারায়ণ চন্দ্র বসাক এবং ওস্তাদ কিরণ চন্দ্র রায়ের সান্নিধ্য লাভ করেন। গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক,ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্য বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন তুহিন।

মূলত বুয়েটে অধ্যয়নকালে ব্যান্ড সংগীতে যুক্ত হন, "শিরোনামহীন" ব্যান্ডের অসাধারণ সঙ্গীত সফরের প্রায় শুরু থেকে ভোকাল হিসেবে সার্ভিস দিয়েছেন তিনি। 'শিরোনামহীন' এদেশে নিজেদের অদ্ভুত স্বকীয়তা নিয়ে ব্যান্ডপ্রেমীদের মনে জায়গা করে নেয়। জিয়ার লিরিক, তুহিনের ব্যতিক্রমী গায়কী- এই যৌথ প্রচেষ্টার ফল হিসেবে ব্যান্ড মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে কালজয়ী অনেক গানের আঁতুরঘর যেন হয় শিরোনামহীন। তুহিন ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাসে অন্যতম সেরা একজন ভোকাল হিসেবে স্বীকৃতি পান শ্রোতামহলে। 

তানযীর তুহিনের গান পরিবেশনের নিজস্ব ঢং আছে। বাঁ হাত কানের পাশে চেপে হৃদয়ের ভেতর হতে উৎসারিত হওয়া শব্দ গলা দিয়ে বের করার যে চিরচেনা ভঙ্গি, এর বাইরে মঞ্চে উঠে লাফানো, শ্রোতাদের সাথে একাত্ম হওয়া- সব কিছুর মধ্যে কেমন ম্যাজিকেল এক কম্বিনেশন আছে। তানযীর তুহিনের কণ্ঠে শিরোনামহীনের সবচেয়ে বিখ্যাত যে গানগুলো- বন্ধ জানালা, হাসিমুখ, একা পাখি, চিঠি ইত্যাদি এসব গান যেন চিরকালীন হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই অনেক ভালো ভোকালরাও এই গানগুলো গাইতে পারেন, কিন্তু তানযীর তুহিন শিরোনামহীনের কিছু গানে এতোটাই অনবদ্য যে তাকে একারণে বাড়তি মার্ক দিতে হবেই।

২০১৭ পর্যন্ত প্রায় আঠারো বছর একটানা মঞ্চ দাপিয়ে বেড়ানো দরাজ কন্ঠের এই যাদুকর হটাৎ করেই হার্ট এ্যাটাকের কবলে পড়েন। এর কিছুদিন পরেই অভ্যন্তরীণ ভুল বোঝাবুঝিতে ব্যান্ড শিরোনামহীন থেকে সরে যাওয়া, শ্রোতাদের হৃদয় ভাঙ্গার মতো এক খবর আসে- শিরোনামহীনে নেই তুহিন। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনার পর অবশ্য শিরোনামহীন এবং তুহিন কারো পথচলা থমকে যায়নি। তবে, 'শিরোনামহীন' ক্যামিস্ট্রির ভাঙ্গণ নিঃসন্দেহে বাংলা ব্যান্ড এক অদ্ভুত অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটিয়েছে। 

২০১৭ সালের শেষদিকে তুহিন সুমন, রাজু, রিংকু, শাওন প্রমুখের সমন্বয়ে গড়ে তোলেন নতুন এক ব্যান্ডদল "আভাস"। নতুন করে পথচলায় এই পর্যন্ত দুইটি গান রিলিজ হয় ব্যান্ড আভাসের যার মধ্যে টাইটেল ট্র্যাক 'আভাস' অত্যন্ত শ্রোতাপ্রিয়তা লাভ করে। ব্যান্ড মিউজিকের চলমান অস্থিরতার পাশাপাশি উনার ভবিষ্যৎ চিন্তা-ধারা যানতে আগ্রহ প্রকাশ করলে অন্যসব মিউজিসিয়ানদের মতই চলমান নানাবিধ আগ্রাসন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন,এক পর্যায়ে তিনি বলেন, 

"দেখো, আমি প্রথমবার স্ট্রোক করার পরে তোমাদের মাঝে হয়তো আবার নাও ফিরতে পারতাম। সাধারণত এই সংখ্যাটি দুই-তিনবার হলে মানুষের কী হয় ওটা নিশ্চয় জানো। এর আগে যতদূর সম্ভব আরোকিছু স্মৃতি জমাতে চাচ্ছি। বাকিটা সময়ই বলে দিবে। নতুন গানের জন্য আমাদের অবশ্যই সময়ের প্রয়োজন। কারণ, কোয়ালিটি ছাড়া কোনভাবেই গান রিলিজ দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না। আর প্রতিকূলতা তো আছেই। সবার জন্য দোয়া করবে।"

‘জীবন যেখানে দ্রোহের প্রতিশব্দ- মৃত্যু সেখানে শেষ কথা নয়।’ - প্রিয় তানযীর তুহিন, মানুষ হারালেও সৃষ্টি কখনো হারায় না। আর এজন্যই আমরা সৃষ্টি হয়ে স্রষ্টায় ভালোবাসি। আমাদের এই প্রজন্মের কতশত না বলা গল্পের মাঝে আপনার এই দরাজ কন্ঠ বহমান তা হয়তো আপনার জানা নেই। বাংলা ব্যান্ড সংগীতের ভুবনে তানযীর তুহিন স্বতন্ত্র এক ধারার নাম, এই লিগ্যাসির ধারক একজনই। সেই তানযীর তুহিনের কাছে প্রত্যাশাও অনেক শ্রোতাদের। সেই প্রত্যাশা মেটাতে নিশ্চয়ই তিনি নিজে শারিরীকভাবে সুস্থ থাকবেন এবং শ্রোতাদের জন্যে তৈরি করবেন নতুন নতুন গান, গাইবেন, মঞ্চ মাতিয়ে যাবেন আরো অনেকগুলো বছর। স্মৃতি জমুক, স্মৃতি বাড়তেই থাকুক...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা