"এত যত্ন করে, এত পরিশ্রম করে এই প্রতিষ্ঠানটা তৈরি করেছি, এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, কি করব বলেন? মানুষ নিরুপায় হয়ে সন্তানের লাশ ফেলে দেয় না? এখন আমার ওইটাই করতে হবে। আমাকে মনে করতে হবে যে আমার সন্তান মারা গেছে, আমাকে এটা ফেলে রেখেই চলে যেতে হবে..."

নিজের হাতে গড়া স্কুলের ভেতর দাঁড়িয়ে তাকবীর আহমেদ যখন কথাগুলো বলছিলেন, তার গলা কেঁপে উঠছিল, শব্দ আটকে যাচ্ছিল বারবার। চোখে বাঁধ মানছিল না অশ্রু, কাঁদছিলেন তিনি। মোহাম্মদপুরে ফুলকুঁড়ি কিন্ডারগার্টেন এন্ড হাইস্কুল নামের একটা স্কুল চালাতেন তিনি। করোনাভাইরাসের কারণে মার্চের মাঝামাঝি থেকে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ, কবে স্কুল-কলেজ খুলবে তার কোন ঠিকঠিকানা নেই, স্কুলটা তার কাছে এখন বোঝার মতো হয়ে গেছে। তাই এটা বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। আর সেসব নিয়ে কথা বলতে গিয়েই কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন ভদ্রলোক। 

তাকবীর আহমেদের এই স্কুলে যেসব ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা করতো, তাদের বেশিরভাগই নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়ে। কারো বাবা-মা হয়তো গার্মেন্টসে চাকরি করে, কারো বা পরিবহন সেক্টরে, বা বাসাবাড়িতে। নুন আনতে পান্তা ফুরানো এসব পরিবারের জন্য করোনাভাইরাস এসেছে অভিশাপ হয়ে। অনেকেই পেটের দায়ে ঢাকা ছেড়েছেন, যারা টিকে আছেন, তারাও স্কুলের বেতন পরিশোধ করার মতো অবস্থায় নেই। 

তাকবীর আহমেদ জানেন তার স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকেরা কি অবস্থায় আছেন। তাই কারো কাছে টাকা চাননি তিনি, কাউকে বলেননি বেতন দিয়ে দিতে, নইলে স্কুল থেকে নাম কেটে দেবেন, বা পরীক্ষা দিতে দেবেন না- এরকম কোন হুমকিও দেননি। বরং চেষ্টা করেছেন পুরোটা না পারলেও, অল্প অল্প করে হলেও শিক্ষকদের বেতনটা দেয়ার। নিজের পকেট থেকে কয়েক মাসের বেতন অর্ধেক করে দিয়েছেন তিনি, বাসা ভাড়া বাকি পড়েছে মাসের পর মাস। 

কয়েক লাখ টাকা ইতিমধ্যেই হাত থেকে বেরিয়ে গেছে, অথচ আয় হয়নি এক পয়সাও। তাকবীর বা অন্য কেউই জানেন না, কবে এই পরিস্থিতির অবসান হবে, কবে স্কুল খুলবে, খুললেও ছাত্র-ছাত্রীদের কয়জনকে পাওয়া যাবে। শেষমেশ বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, স্কুলটা বিক্রি করে দেয়ার। যে স্কুলটা নিজের হাতে গড়েছিলেন, নিজের সবটুকু শ্রম ঢেলেছিলেন যে প্রতিষ্ঠানের পেছনে, সন্তানসম সেই স্কুল বিক্রি করার কথা বলতে গিয়ে যে তাকবীরের বুক ভেঙে যাচ্ছে, সেটা তার কান্না দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। 

করোনাভাইরাসের এই প্রকোপে মানুষের জীবন তো যাচ্ছেই, স্থবির হয়ে গেছে জীবিকা। অজস্র মানুষ ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে, ত্রিশ-চল্লিশ বছর ধরে এই শহরে থাকা পরিবারও সংসার গুটিয়ে বাড়ির পথ ধরেছে। অমানবিক সব হৃদয় ভাঙার গল্প লেখা হচ্ছে চারপাশে। নিম্নবিত্ত আর নিম্ন-মধ্যবিত্তের অবস্থা শোচনীয়, সংকটের আঁচ এসে লাগছে মধ্যবিত্তের সংসারেও। যে পেশাজীবিরা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী এই সময়ে, তারা হচ্ছেন স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা। 

স্কুল বিক্রির কথা বলতে গিয়ে কাঁদছেন তাকবীর আহমেদ

স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় বেতন পাচ্ছেন না অনেকেই। ঢাকা শহরের নামীদামী প্রতিষ্ঠানগুলোও শিক্ষকদের পুরো বেতন দিতে গড়িমসি করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে, এমনকি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও একই দশা! তাহলে পাড়া-মহল্লার অল্প পরিচিত বা অপরিচিত স্কুল-কলেজ বা কিন্ডারগার্টেনের কথা ভাবুন। সেগুলোর শিক্ষকরা তো আয়শূন্য অবস্থায় পড়ে আছেন! শিক্ষকদের আয়ের একটা অংশ আসে টিউশনি করিয়ে, করোনার সংক্রমণের ভয়ে সেটাও বন্ধ, কারণ পড়ালেখার চেয়ে জীবন সবার কাছেই দামী। 

ঢাকার আদাবরের পপুলার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অধ্যক্ষ আমিনা বেগম তামান্না। স্কুল বন্ধ, বন্ধ আয়-রোজগারও। সংসার চালাতে তিনি রাস্তায় নেমেছেন, মুখে মাস্ক চাপিয়ে বিক্রি করছেন মৌসুমি ফল। তার লক্ষ্য একটাই, সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেয়া, আর প্রতিষ্ঠানটাকে টিকিয়ে রাখা। বাড়িভাড়া দিতে পারছিলেন না, তাই স্বামী-সন্তানদের নিয়ে উঠে এসেছেন স্কুল ভবনে, দুটো রুম থেকে বেঞ্চ-চেয়ার টেবিল সরিয়ে সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। একজন শিক্ষিকা, একজন অধ্যক্ষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন বদলে যাওয়া পরিস্থিতির শিকার হয়ে- এর চেয়ে মন খারাপ করে দেয়া দৃশ্য আর কি হতে পারে? 

ফেসবুকে কিছুদিন আগে একটা স্কুল বিক্রির বিজ্ঞাপন খুব ভাইরাল হলো, ট্রোল পেজগুলো মিম বানানো শুরু করলো সেই 'ছাত্রছাত্রী এবং আসবাবপত্র সহ স্কুল বিক্রি হবে' লেখা টু-লেটের ছবি নিয়ে। সেই টু-লেটটার পেছনে হয়তো তাকবীর আহমেদ বা আমিনা বেগমদের মতো কোন মানুষের মন খারাপ করে দেয়া একটা গল্প লুকিয়ে ছিল, সেটা আমরা খুঁজে দেখতে যাইনি। যার যায়, সেই বোঝে, অন্য কারো বোঝার কথা নয় যন্ত্রণাটা। 

তাকবীর বা আমিনা বেগমদের এই অবস্থার জন্য কাকে দায়ী করা যায় আসলে? একশো কিন্ডারগার্টেন বন্ধ বা বিক্রির পথে আছে, পঞ্চাশ হাজার স্কুলের প্রায় ছয় লাখের বেশি শিক্ষক বেতন পাচ্ছেন না- সেটাই বা কার দোষে? সরকার দেখভাল করতে পারতো এদের সবার, কিন্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেভাবে দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনা ঢুকে গেছে, রাষ্ট্রের ছত্রছায়া পায় কেবল জিকে শামীম বা মোহাম্মদ সাহেদের মতো দুর্নীতিবাজরা। অসহায় শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রের সুদৃষ্টি কখনোই পড়ে না, ভবিষ্যতেও পড়বে, এটা আশা করা বোকামি। শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর- এই টাইপের কথা কাজীর কেতাবেই থাকে, বাস্তবজীবনে সেসবের দাম নেই খুব একটা...

তথ্যসূত্র- বিবিসি বাংলা

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা