পেশায় তিনি রিকশাচালক। অল্প কয়টা টাকা আয় করেন, তার অর্ধেক রাখেন পরিবারের জন্যে, বাকিটা দিয়ে দেন স্থানীয় স্কুলগুলোতে। নিজের টাকা থেকে তিনি সাহায্য করেন বেদেপল্লীর মানুষকে, স্থানীয় মাদ্রাসায়, কবরস্থানের উন্নয়নে, এমনকি করোনা-আক্রান্তদেরও। মানুষটার নাম তারা, মনটা আকাশের মতো বিশাল...

কয়েকদিন আগে রাজশাহীর পত্রিকা বিক্রেতা 'খুকি' বেশ ভাইরাল হলেন। আমরা সবাই তাকে নিয়ে সংবাদ করলাম। মাতামাতি করলাম। ভাইরাল হওয়া খুকিকে অনেকেই পরে সাহায্য-সহযোগিতা করতে চাইলেন। খুকি ভদ্রভাবে ফিরিয়ে দিলেন তাদের সবাইকে। বললেন- কোনো সাহায্যের দরকার নেই তার। খুকি এখনো ষাটোর্ধ টলোমলো শরীর নিয়ে পেপার বিক্রি করছেন। সেই পেপার বিক্রিতে যে টাকা পাচ্ছেন, তার প্রায় পুরোটাই বিলিয়ে দিচ্ছেন মানুষের জন্যে। হয়তো কয়েক মাস পরেই খুকিকে আর কেউ মনে রাখবে না। কেউ মনে রাখেও না। সমাজের 'চকচকে' স্তর থেকে আসেনওনি তিনি। বিস্মৃতির অতলে যাওয়াটাই হয়তো ধ্রুব নিয়তি হবে তার। তবে খুকি, কারো স্মৃতির কুঠুরিতে থাকার বাসনাও প্রকাশ করেন না৷ এরকম আরেকজন মানুষ আছেন, যিনিও পাগলের মত মানুষের জন্যেই কাজ করে যান। তার নাম- তারা মিয়া। যার গল্প শুনলে আমাদের 'শিক্ষিত-সভ্য' মাথা হেঁট হবে অনেকটাই। এই মানুষটির গল্প হয়তো আমাদের অনেককেই দেবে নিখাদ লজ্জা। তা দিক। গল্প শুরু করি। 

তারা মিয়ার বয়স তেত্রিশ। বাড়ি নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী চকলেঙ্গুরা গ্রামে। পেশায় রিকশাচালক তিনি। গত সাত বছর ধরেই যুক্ত আছেন এই পেশায়। প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত রিকশা চালান তারা মিয়া। গল্প সেখানে না৷ রিকশা চালিয়ে যা পান, তার অর্ধেক টাকাই তিনি এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দান করে দেন। গল্প এখানে। তার দান করা টাকায় কেনা হয় স্থানীয় বিভিন্ন স্কুল-মাদ্রাসার অজস্র শিক্ষাসরঞ্জাম।  

প্রতিদিন আয় যেরকমই হোক, আয়ের অর্ধেকটা তিনি পরিবারের জন্যে রাখেন৷ বাকিটা জমিয়ে রাখেন।  মাস শেষে সে টাকায় তিনি কেনেন শিক্ষা-সরঞ্জাম৷ তারা মিয়ার বাবা দরিদ্র ছিলেন, তাই পড়াশোনা করা হয়নি তারা মিয়ার। সেই আক্ষেপ থেকেই এই পাগলামি তার। তারা মিয়া এভাবে তার এলাকার প্রায় আঠারোটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গত সাতবছর ধরে নানারকম শিক্ষাসরঞ্জাম বিতরণের কাজ করে আসছেন। এ কাজে যেন কোনো ক্লান্তি নেই তার। করোনাকালে যখন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মসূচি বন্ধ, তখনও টাকা জমানো বন্ধ করেন নি তিনি। এবং মাস শেষে সে টাকা দিয়ে তিনি এখনো সতেরোটি স্কুল আর একটি মাদ্রাসায় সরবরাহ করে যাচ্ছেন কোরআন শরীফ, খাতা, কলম, বই, ফুটবলসহ নানাবিধ সরঞ্জাম। 

শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই সাহায্য করেন তিনি, তা না। গ্রামের একটি কবরস্থানের রক্ষণাবেক্ষণ করছেন তিনি। করোনার প্রকোপে যখন তার নিজেরও রুটিরুজির সংস্থান বন্ধ, সেই সময়েও তিনি তার জমানো ১০২০০ টাকা জমা দিয়ে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর করোনা সহায়তা তহবিলে। তিনি ২০১৭ সালে এক ব্যক্তির কাছ থেকে পেয়েছিলেন এক লাখ টাকা সাহায্য। সে টাকা তিনি পুরোটাই ব্যয় করে দিয়েছিলেন স্থানীয় স্কুলগুলোর পেছনে। কিছুদিন আগে এক বেদেপল্লীর অধিবাসীদের খাদ্যাভাবের কথা জানতে পেরে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন সেখানে৷ চালের বস্তা ও টাকাপয়সা নিয়ে। নিজের মত করে যতটুকু পেরেছিলেন, সাহায্য করেছিলেন তাদের। 

ক্ষুধার্তদের সাহায্য করতে তারা মিয়া ছুটে গিয়েছিলেন বেদেপল্লীতেও! 

তারার পরিবারও মেনে নিয়েছে তারার এই পাগলামিকে। পরিবারের মানুষজন বুঝেছে, এই মানুষটিকে বাধানিষেধ দিয়ে কোনো লাভ হবে না। তাই তারা দিচ্ছেও না। তারা মিয়া নিজের ছোটবেলার স্বপ্নকে সত্যি করতে পারেন নি, সেজন্যেই তার এভাবে ক্রমশ ছুটে চলা, স্বপ্নের পেছনে। তারা মিয়া যখন ভাইরাল হবেন, তখন যদি কেউ সাহায্য করতে চান, তখন তার সেই সাহায্য তিনি নেবেন কী না, এমন প্রশ্নের জবাবে হাসিমুখে তার জবাব-

কারও কাছে আমি কিছু চাই না। শুধু দোয়া চাই, যাতে সারাজীবন এই কাজডা করতাম পারি। 

লেখার শুরুতে বলেছিলাম, তারা মিয়ার গল্প শুনলে মাথা হেঁট হয়ে আসবে অনেকেরই। আসা উচিতও। টাকার অভাবে আমরা মানুষকে সাহায্য করতে পারি না। অথচ, বিষয়টা সেরকম না। একটু বড় মনের অভাবে মানুষকে সাহায্য করা হয়ে ওঠে না আমাদের। আমরা স্ফীত ব্যাংক-ব্যালেন্স আর সংকীর্ণ মানসিকতা নিয়ে ক্রমশ যুঝতে থাকি। আর তারা মিয়ার মতন দুই একজন মানুষ যখন আমাদের যাত্রাপথে পড়ে যায়, আমরা বিব্রত হই। বালির মধ্যে মুখ গোঁজার উটপাখি হতে চাই। পারি না। তারা মিয়ারা আমাদের নগ্ন করে দেন ভরা বাজারে। দেখিয়ে দেন- মানুষ হয়ে কীভাবে মানুষের জীবনে প্রভাবক হতে হয়। তারা মিয়ারা দেখিয়ে দেন- কিভাবে মানুষ হতে হয়। 

বিনম্র শ্রদ্ধা রইলো তারা মিয়ার জন্যে। আর কিছু বলার নেই।


*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা