মসজিদ বানাতে চাইলে খালি জায়গার তো অভাব নেই। কিন্ত সাম্প্রদায়িক বর্বর এই লোকগুলো অন্যের প্রার্থনাস্থল বন্ধ করে মসজিদ বানাতে চাইছে। ইসলাম কি এই জোর-জবরদস্তি সমর্থন করে? করে না...

তুরস্কের হায়া সোফিয়া নামের গীর্জাটাকে মসজিদে পরিণত করার ঘটনা এখনও টাটকা, এরইমধ্যে পাকিস্তানে শিখ ধর্মাবলম্বীদের প্রাচীন একটি গুরুদ্বারকে (শিখদের প্রার্থনাস্থল বা মন্দির) মসজিদে রূপান্তরিত করার চেষ্টা চলছে। প্রায় আড়াইশো বছর পুরনো এই গুরদ্বারটি শিখদের জন্য ঐতিহাসিকভাবে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। লাহোরে অবস্থিত শহীদ আস্থান ভাই তারুজি নামের গুরদ্বারটিকে মসজিদে পরিণত করা হলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হবে, সংখ্যালঘু শিখ সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচারের নতুন একটা নিদর্শন স্থাপিত হবে। শিখ ধর্মাবলম্বীরা পাকিস্তান সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে, যাতে এটিকে মসজিদে রূপান্তরিত করা না হয়। 

লাহোরের শহীদি আস্থান ভাই তারুজি গুরুদ্বারটি আসলেই ঐতিহাসিক। ১৭৪৫ সালে ভাই তারু সিংহের চরম আত্মত্যাগের কথা মাথায় রেখেই ওই গুরুদ্বারটি তৈরি হয়েছিল। অমৃতসরের বাসিন্দা ভাই তারু সিংহ মূলত কৃষিকাজ করতেন। সে সময় ভারতবর্ষে চলছিল মোগলরাজ। পাঞ্জাব অঞ্চলে মোগল তহসিলদারের অত্যাচার বেড়ে যাওয়ায় শিখদের একটি দল বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে সময় মোগলরা বহু শিখকে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করছিল বলেও অভিযোগ আছে। 

এরই প্রতিবাদে মোগলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের দলে নাম লিখিয়েছিলেন তারু সিংহ। ধরাও পড়ে যান। প্রবল নির্যাতন সত্ত্বেও ধর্মান্তরিত হতে রাজি হননি তিনি। একারণে নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। এক পর্যায়ে তার চুল সহ মাথার খুলির একটা অংশ তুলে ফেলা হয়। সেই আঘাতেই ১৭৪৫ সালে তার মৃত্যু হয়। ভাই তারুজির স্মৃতির স্মরণেই লাহোরে তৈরি হয়েছিল শহীদি আস্থান ভাই তারুজি গুরুদ্বারটি। এখনও ভারত এবং পাকিস্তানের শিখ সম্প্রদায়ের কাছে ওই গুরুদ্বারটি অত্যন্ত পবিত্র। প্রতি বছর হাজার হাজার শিখ ধর্মাবলম্বী এই গুরুদ্বার দেখতে এবং প্রার্থনাসভায় যোগ দিতে ভারতের পাঞ্জাব থেকে লাহোর যান। 

ভাই তারুজি গুরুদ্বার, লাহোর

অভিযোগ উঠেছে, পাকিস্তান প্রশাসন ওই গুরুদ্বারটিই মসজিদে পরিণত করতে চাইছে। পাকিস্তানে শিখ ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা খুব বেশি নয়। সাতচল্লিশের দেশভাগের সময়ই হিন্দু এবং শিখদের একটা বড় অংশ ভারতে চলে এসেছিলেন। যারা থেকে গিয়েছিলেন, তারাও সময়ে সময়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছেন, একদম নিরুপায় যারা, তারাই মাটি কামড়ে পড়ে আছেন। ধর্মান্তরের হুমকি তাদের শুনতে হয় প্রতিনিয়তই, পাকিস্তানে সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন হিসেবে বেঁচে আছেন শিখরা। প্রার্থনার জন্য গুরুদ্বারে যান খুব কম সংখ্যক মানুষই। আর তাই লাহোরের স্থানীয় প্রশাসন চাইছে, দশ-বারোজন মানুষের জন্য এত বড় গুরুদ্বার না রেখে সেটাকে মসজিদে পরিণত করতে।

কিন্ত এটা যে সংখ্যালঘু নির্যাতনের চরম একটা মাত্রা, সেটা মাথামোটা লোকগুলো বোঝার চেষ্টা করছে না। গুরুদ্বারে প্রার্থনা করতে দশজন আসুক কিংবা একজন, এটা শিখদের সম্পত্তি, আড়াইশো বছর ধরে তারা এখানে প্রার্থনা করে আসছে, সেখান থেকে তাদের হঠিয়ে দেয়ার অধিকার কারো নেই। মসজিদ বানাতে চাইলে পাকিস্তানজুড়ে অনেক জায়গা পড়ে আছে, সরকারী জায়গা, খাস জমি সবই আছে। ইচ্ছে করলেই সেখানে মসজিদ বানানো যায়। কিন্ত সেটা না করে সাম্প্রদায়িক বর্বর এই লোকগুলো অন্যের প্রার্থনাস্থল বন্ধ করে মসজিদ বানাতে চাইছে। ইসলাম কি এই জোর-জবরদস্তি সমর্থন করে? করে না। 

পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের ওপর এমন অত্যাচার অবশ্য নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এইতো, কয়েকদিন আগে একটি বুদ্ধ মূর্তি ভাঙার অভিযোগ উঠেছে সেদেশে। 'ইসলাম বিরোধী' বলে ওই মূর্তি ভাঙা হয় বলে অভিযোগ। বাড়ি তৈরির জন্য ভিত তৈরি করতে গিয়ে মাটির তলা থেকে বেরিয়ে এসেছিল বুদ্ধ মূর্তি, যার বয়স কমপক্ষে কয়েকশো বছর। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে এই মূর্তির গুরুত্ব ছিল অনেক। আর সেই মূর্তিটাই ভেঙে ফেলে সেখানকার নির্মাণ শ্রমিকেরা। 

তুরস্কের প্রাচীন গীর্জা হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়েছে

এই ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। পাকিস্তানে খাইবার পাখতুন প্রদেশে ঘটেছে ঘটনাটা। নির্মাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত কন্ট্র্যাকটর ছিল এক বকধার্মিক, তার পরামর্শে শ্রমিকরা এই কাজ করেছিল। ওই মূর্তি থাকলে ভয়ঙ্কর ক্ষতি হতে পারে, সেই কারণেই নাকি কন্ট্র্যাকটর মূর্তিটি ধ্বংস করে দিয়েছে!

মজার ব্যাপার হচ্ছে, শিখদের এই গুরদ্বারকে মসজিদ বানানোর ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ভারত সরকার। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে অফিসিয়ালি বার্তা পাঠানো হয়েছে। যে ভারত শুধুমাত্র কট্টরপন্থী হিন্দুদের তুষ্ট করে ভোটব্যাংক বাগে আনার জন্য বাবরি মসজিদের ভাঙা জায়গার রাম মন্দির বানাচ্ছে, এখন তারাই আবার সংখ্যালঘুর অধিকার নিয়ে বুলি ছুঁড়ছে! আইরনি আর কাকে বলে! 

এখন বলা হচ্ছে, লাহোরের ওই গুরুদ্বারের জায়গায় নাকি শত শত বছর আগে মসজিদ ছিল। সেটা অবশ্য ভারতের কট্টরপন্থী হিন্দুরাও বলে, বাবরি মসজিদের মাটির তলায় নাকি হাজার বছরের পুরনো রাম মন্দির লুকিয়ে আছে। যদিও ইতিহাসের কোন দলিলই সেটাকে সমর্থন করে না। এগুলো হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে জবরদখলের পুরনো, কিন্ত কার্যকর টেকনিক। রাম মন্দিরের আরতি শুনে, হায়া সোফিয়া বা গুরুদ্বারের জায়গায় নির্মিত মসজিদে আজানের আওয়াজ শুনে কারো মন স্রষ্টার প্রতি দ্রবীভূত হতেই পারে, তবে জেনে রাখবেন, আজান কিংবা আরতি- কোনটাই স্রষ্টাকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না। কারণ ধর্মের নামে ঘৃণা আর অত্যাচারের বিষবাস্প জুড়ে দেয়া আছে এখানকার ইতিহাসে...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা