টারজান ভিসা: অন্তহীন, নিরুদ্দেশ এক অনিশ্চিত যাত্রা!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
কীভাবে একটা তরুণ বা তার পরিবার ১৫-২০ লাখ টাকা খরচ করতে পারে একটা অগস্ত যাত্রার পেছনে? এই জীবন কোন নাম না জঙ্গলে লাশ হয়ে পড়ে থাকার জন্য কি? অথবা কোন অজানা বর্ডারের বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে লাশ হয়ে ঝুলে থাকার জন্য?
অনুকুল বা কিঞ্চিত প্রতিকূল পরিবেশে, গাইড নিয়ে বা না নিয়ে, ক্যাম্প ফাঁকি দিয়ে বা না দিয়ে বান্দরবানের বর্ডার লাইন ঘুরে আমরা অনেকেই নিজেদের অনেক বড় এডভেঞ্চারার ভাবি! আজকাল দেশের কেউ কেউ হিমালয়ের নানা রিজিয়নে যাচ্ছেন, আদতেই ভালো ট্রেক করছেন। এসবে প্রস্তুতি থাকা স্বত্বেও জীবনের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। উনারাও আমার চোখে দেশের সবচেয়ে বড় অভিযাত্রী বা এডভেঞ্চারার নন। আমার চোখে যারা দেশের সবচে বড় এডভেঞ্চারার তারা অনেকেই এডভেঞ্চার কী জিনিস তা না জেনেই তা করছেন। ট্রেক কী, না জেনেই দেশের পর দেশ ট্রেক করছেন। শতভাগ বা তারচেয়েও বেশি সামর্থ্য প্রয়োগ করছেন, জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন প্রায় কে টু'র কাছাকাছি ফ্যাটালিটি রেটের অভিযানে৷
এটাকে এডভেঞ্চার না বলে হঠকারিতা বলতে পারেন, কিন্তু গত চার দশকে হাজার হাজার কিশোর-যুবক টারজান ভিসায় USA গিয়েছেন। (কদিন আগে বসনিয়ার জঙ্গলে আশ্রয় নেয়া তরুণেরা ডয়েচে ভেলের নিউজের কারণে প্রাদপ্রদীপ পেলেও এমন বহু সীমান্তে বহু বাঙালি মানবেতর সংগ্রাম করছে।) সাম্প্রতিক সময়ে এই পদ্ধতি ভয়াবহ কঠিন হয়ে গেলেও এখনো জেনে না জেনে প্রতিদিনই তরুণরা উন্নত জীবনের আশায় এই পথে পাড়ি জমাচ্ছেন৷
ঢাকা থেকে টার্কি/লিবিয়া/মরক্কো হয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাওয়া অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু টারজান ভিসায় USA যাওয়ার তুলনায় অনেক কম। কারণ ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরলে, মরুভূমিতে গুলিতে বা আফ্রিকার জেলে পঁচে মরলেও লাশ পাওয়ার কিঞ্চিত চান্স থাকে কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গলে মরলে লাশ পাওয়ার কোন চান্সই অবশিষ্ট থাকে না৷
টারজান ভিসা এক অন্তহীন নিরুদ্দেশ যাত্রা। এই যাত্রায় ঢাকা থেকে USA পৌঁছুতে সময় লাগে তিন মাস থেকে এক বছর৷ পাড়ি দিতে হয় হাজার হাজার মাইল পথ, সাত সমুদ্র, চার মহাদেশ। করতে হয় অন্তত কয়েকশো মাইল জঙ্গল এন্ড হিল ট্রেক। বাকি কয়েকশো মাইল নৌপথে, কয়েক হাজার মাইল আকাশপথে৷ এই যাত্রায় ঢাকা থেকে বিমানে দুবাই-দোহা বা আফ্রিকার কোন দেশ হয়ে ক্লায়েন্ট পৌঁছে যায় সরাসরি ব্রাজিলে৷ সেখান থেকে সড়কপথ শুরু, সাথে সীমান্তের জঙ্গল পথে ট্রেক এক দেশ থেকে আরেক দেশের বর্ডার পার হওয়া৷
এই পথে তাদের শুধু বন জঙ্গল না, এড়াতে হয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী ও প্রতিপক্ষ আন্তর্জাতিক মাদক চোরাকারবারী গোষ্ঠীদের। এড়াতে হয় বৈরী স্থানীয় এলাকাবাসী আর জঙ্গলের জন্তু-জানোয়ার৷ এই পর্যায়ে এরা শুধু হাতবদল হয় আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রের এক দেশ থেকে আরেক দেশের এজেন্টে৷ লাইক ব্রাজিলের দালাল বলিভিয়ার দালালকে জনপ্রতি দুইশো ডলার দিয়ে দিবে জাষ্ট বলিভিয়া পার করে পেরুতে ঢুকিয়ে দেবার জন্য৷ পেরুর দালালও জাষ্ট মাথা গুনে টাকা দিবে ইকুয়েডরের দালালকে তার দেশের বর্ডার পার করে কলম্বিয়ার বর্ডারে ঢুকিয়ে দেবার জন্য৷ তারপর পানামা, কোষ্টারিকা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস, গুয়াতেমালা আর সবশেষ বিশাল মেক্সিকো পাড়ি দিয়ে সবশেষে স্বপ্নের দেশ আমেরিকা৷
এর মধ্যে তাদের পাড়ি দিতে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদজনক প্যাসেজ দারিয়ান গ্যাপ। এই ভয়াবহ পাহাড়ী জঙ্গল ট্রেক করা ভিন্ন আর কোন উপায় নাই৷ তার উপর ঝাঁকে ঝাঁকে ছড়িয়ে থাকা কলম্বিয়ান ড্রাগ কার্টেল, প্রতিপক্ষের হাতে ধরা পড়লেই ভবলীলা সাঙ্গ৷
এই দীর্ঘযাত্রায় তারা কত কিছু দেখে। চোখের সামনে টিটিকাকা লেক, মাচু পিচু, আন্দিজ, আমাজন, লাপাজ, লাক্রুজ, রিও বা তার মত আমাদের দেখতে ভয় পাওয়া কত বড় বড় স্বপ্নগুলো তাদের চোখ এড়িয়ে যায় ভাইস ভার্সা তাদের স্বপ্নগুলো আমরা রিয়েলাইজই করতে পারি না৷ নয়তো আমরা হয়তো হিসাবটা মেলাতে পারতাম কীভাবে ১৫-২০ লাখ টাকা খরচ করতে পারে একটা তরুণ বা তার পরিবার একটা অগস্ত যাত্রার পিছনে?
এ জীবন কোন নাম না জঙ্গলে লাশ হয়ে পড়ে থাকবার জন্য কি? অথবা কোন অজানা বর্ডারের বৈদ্যুতিক ওয়্যারে জড়িয়ে লাশ হয়ে ঝুলে থাকার জন্য? জানি মাইগ্রেশন মানব জাতির চিরায়ত অভ্যাস, জানি মাইগ্রেশনই বাংলাদেশীদের ভবিষ্যত, তবু কোথায় যেন হিসেব মেলে না৷ এরা কি জেনে যাচ্ছে এরা কই যাচ্ছে? মানুষের অভিযোজন ক্ষমতা, লড়াই আর সহজাত প্রবৃত্তির বলে উতরে যাচ্ছ অনেকে তাই এই পথে ভীড় বাড়বে বৈ কমবে না। কিন্তু আমরা কি এই অসুস্থ্ এডভেঞ্চারের চর্চা বন্ধে ব্যবস্থা নিবো? বা নেয়ার অধিকার কি আমরা কেউ রাখি?
এই হাজার হাজার তরুণ যুবার চেয়ে বড় এডভেঞ্চারার হওয়া সম্ভব কিনা সে প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছিলাম৷ উত্তর আমরা জানি না, কিন্তু এই এডভেঞ্চার বন্ধ হওয়াই ভালো৷ (দারিয়ান গ্যাপ বা প্যাসেজ নিয়ে ইউটিউবে প্রচুর কনটেন্ট পাবেন। দেশের সব এলাকার মানুষ এই ফাঁদে পড়লেও মূলত সিলেট ও নোয়াখালী অঞ্চলের রাজনৈতিক মামলায় জড়ানো যুবকরাই এ পথে বিদেশ যাচ্ছে। মুন্সি নামের সোনাইমুড়ির এক যুবক তার এই পুরো যাত্রা ইউটিউবে আপলোড করেছে৷ USA ভিত্তিক এসবিএস টিভিও একটা বাংলাদেশী গ্রুপকে নিয়ে ভয়াবহ এক্সাইটিং একটা ডকুমেন্টারি বানিয়েছে। টারজান ভিসায় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া এডভেঞ্চারাররা কদিনের মধ্যেই বিশ্বমিডিয়ার মূলধারায় উঠে আসবে। ফলটা কী হবে?)
আরও পড়ুন- এই টারজান ভিসার কালচারটা বন্ধ করুন!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন