আজকাল বড্ড দূষণ এই পৃথিবীতে। এত এত বর্জ্যে ভরা এই আমার শহর৷ সেখানে একটা মানুষ রিসাইকেল আর্টটাকেই বেছে নিলেন নিজের ট্যালেন্টকে উপস্থাপন করবার জন্য। এটা শুধু যে আর্টের প্রতিই ভালবাসা তা তো নয়, এটা প্রকৃতির প্রতিও ভালবাসা।

তার হাতের ছোঁয়ায় টিব্যাগ যেন হয়ে উঠে এক টুকরো বাংলাদেশ৷ শেষ বিকেলের হিমেল বাতাস, হাতে এক কাপ ধূমায়িত চা, দেখছি এক দক্ষ কারিগরের শিল্পকর্ম- যিনি কিনা আঁকাআঁকিটা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিখেননি কখনো। তার টিব্যাগ স্টোরিজ কাজগুলো দেখে মনে হয়, এগুলো হৃদয় থেকে উতসারিত সৃজনশীল কাজ। না হলে কিভাবে পরিত্যাক্ত বস্তুকে এভাবে বদলে ফেলেন! চা পান করার পর যে টিব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে দেই আমরা, তিনি সেই টিব্যাগটা যত্ন করে উঠিয়ে রাখেন। তারপর পরিষ্কার করে শুকিয়ে বানিয়ে ফেলেন ছবি আঁকার অদ্ভুত ক্যানভাস, সে ক্যানভাসে একটা পরিত্যাক্ত টিব্যাগ বদলে হয়ে যায় বাংলাদেশের কোনো সুন্দর দৃশ্য।

এই ছোট ছোট প্রচেষ্টা আসলে এই শিক্ষাটাই দেয়, হতাশ না হয়ে নিজের জায়গা থেকে চেষ্টা করে গেলে বাংলাদেশ বদলে দেয়া যায়৷ সবটাই আসলে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি। ব্যবহৃত যে টিব্যাগ আমাদের কাছে এক টুকরো ময়লা ছাড়া কিছু নয়, সেটাই তার হাত ধরে শিল্প হয়ে যায়! তিনি যে শুধু টিব্যাগেই ছবি আঁকেন তা নয়, যেকোনো পরিত্যাক্ত বস্তুকে তিনি শিল্পমাধ্যমে রুপান্তর করার চেষ্টা করেন। এই মানুষটার নাম সাদিত উজ জামান, বাড়ি রাজশাহী। পেশায় ব্যবসায়ী, আর মনেপ্রাণে আছে যার এক উদ্দ্যমী শিল্পীসত্তা! 

আর্টের এই পথে সাদিতের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকলেও তার কাজ প্রাতিষ্ঠানিক সীমারেখা ভেঙ্গে তুমুল পরিচিত হয়ে উঠছে, প্রশংসিত হচ্ছে। ছোটবেলার একটা ঘটনা আছে তার। বাবা আইস্ক্রিমের বক্স আনলেন। খাওয়ার পর খালি, পরিত্যাক্ত আইসক্রিমের বক্সে মনের খেয়ালে সাদিত এঁকে ফেললেন একটা ছবি, গ্রামের সরল সাধারণ ছবি। কিন্তু, সেই ছবি দেখেই প্রিয় মানুষগুলোর কি ভীষণ প্রশংসা! সেই প্রশংসারও প্রচ্ছন্ন একটা প্রভাব হয়ত অবচেতন মনে থেকে গিয়েছিল তার। সৃজনশীল মানুষরা তো অল্পতেই খুশি হন, সামান্য একটু অনুপ্রেরণা পেলেই এই মানুষগুলো কি অসাধারণ ক্রিয়েটিভ কাজ উপহার দিতে পারেন, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। সাদিতের ক্ষেত্রেও সেরকমটাই হয়েছে।

বাবাও ছিলেন শিল্পমনা, আঁকাআঁকি পছন্দ করতেন৷ তাই পারিবারিক একটা শৈল্পিক আবহও ছিল। যদিও, নিয়মিত ভাবে টিব্যাগে ছবি আঁকা শুরু করেন ২০১৪/১৫ সালের দিকে৷ এই মাধ্যমে যে খুব বেশি শিল্পী কাজ করেন তাও নয়৷ যুক্তরাষ্ট্রের এক শিল্পী আছেন, রুবি সিলভিয়া, যার কাজ ভাল লাগত সাদিতের৷ সেই আর্টিস্টকে যখন সাদিত খানিকটা সাহস, খানিকটা স্বলজ্জ ভাব নিয়ে নিজের কাজ দেখালেন, যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পী রুবিও বেশ মুগ্ধ হলেন সাদিতের কাজে। এখন এই গুণী শিল্পী নিয়মিতই কাজ করেন, নিজের ব্যবসার ফাঁকে ফাঁকে৷ শখের কাজ বটে, কিন্তু করেন নিজের আবেগ ঢেলে। আর তার সব কাজের ছবিগুলো প্রকাশ করেন ফেসবুকে টিব্যাগ স্টোরিজ নামক পেজে৷ এখন তাকে অনেকেই চেনে, অনেকেই জানে৷ আমাদেরও একজন শিল্পী আছেন, যিনি পরিত্যাক্ত মাধ্যমকে বানিয়ে ফেলেন শিল্পের ক্যানভাস। 

সাদিত উজ জামান

এগিয়ে চলো'র সাথে নিজের কিছু অনুভূতি, ভাবনা ভাগাভাগি করেন শিল্পী সাদিত। ক্যানভাসে যেমন তিনি স্বতঃস্ফূর্ত, নিজের অনুভূতি প্রকাশেও তেমনি অকপট এই মানুষ। জানতে চাইলাম একজন শিল্পীর বেড়ে উঠার যে পরিবেশ সেটা সাদিত কিভাবে পেয়েছিলেন, কেমন ছিল পারিপার্শ্বিক অবস্থাটুকু। তিনি বললেন নিজের ভাষায়-

"যেকোন সৃষ্টিশীল কাজ করার জন্য আশপাশের পরিবেশটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। আমি এমন একটা পরিবারে বড় হয়েছি যেখানে সব ক্ষেত্রেই জীবনকে উপভোগ করতে শেখানো হয়েছে। কখনো কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়া হয়নি, বরং আমার সৃষ্টিশীলতাকে উৎসাহিত করা হয়েছে প্রতিটা ক্ষেত্রেই। তাই আমার মনে হয় পরিবার আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার জায়গা। বাবা-মার কথা বলতে গেলে তো একদম ছোটবেলা থেকেই বলতে হবে৷ আব্বু ছোটবেলায় নানান রকম খেলনা কিনে দিত, কিন্তু কোনোটাতেই নাকি দুই এক দিনের বেশি আগ্রহ থাকত না আমার। এরপর একদিন কাগজে দুইটা গোল এঁকে মাঝে জোড়া দিয়ে দুটা লম্বা দাগ টেনে আব্বুকে দেখিয়ে বললাম, "আব্বু দেখো চমমা"।

চশমা আঁকার গল্পটা আব্বুর কাছেই শোনা, আমার কিছুই মনে নেই। তার পরেই আব্বু নাকি আমাকে রঙ আর খাতা কিনে দিয়েছিল। শুরুটা বোধহয় তখন থেকেই। আমার আব্বু খুব সুন্দর স্কেচ করতে পারে, যে কোনো কিছু কল্পনা থেকেই স্কেচ করে ফেলে! আমি এই গুনটা পাইনি। আমার রেফারেন্স দরকার হয়। তবে প্রাকৃতিক ভাবেই আব্বুর ভেতরে থাকা শৈল্পিক স্বত্তাটা হয়তো আমার মাঝে এসেছে। আর তার সাথে যুক্ত হয়েছে আম্মুর রুচিবোধ ও জীবনদর্শন।

আম্মু দীর্ঘ ২৬ বছর স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। সেই সুবাদে আমার জীবনের প্রথম শিক্ষক আমার মা, ঘরেও এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও। আম্মু ছোটবেলা থেকে আমাকে যেভাবে মানুষ করেছে তার প্রতিচ্ছবি হয়তো আমার কাজেও ফুটে ওঠে প্রতিনিয়ত। মানুষ মানুষে ভেদাভেদ না করা, ধর্ম নিরপেক্ষতা, খুব সামান্য কিছু থেকেই আনন্দ বের করে আনা- এই মূল্যবোধ গুলো আম্মুর থেকেই পাওয়া। সুতরাং আমার প্রায় পুরোটাই বাবা আর মা মেশানো।" 

তিনি যে কতখানি অসাম্প্রদায়িক মনোভাব ধারণ করেন, মানবে মানবে, মনুষ্যধর্মের উর্দ্ধে যে মানবিকবোধ সেটা তার কিছু ছবিতে ধরা পড়ে। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান এই ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে আমরা তো মানুষ। সেই ব্যাপারটাও তার ক্যানভাসে তিনি নিজের মতো দেখিয়েছেন। অবাক হতে হয় এই ভেবে, তিনি তো আঁকাআঁকিটা কখনো কোনো স্কুল বা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিখেননি। কিন্তু, একই সাথে কিছু একটা ব্যাপার তো থাকে যা মানুষকে প্রভাবিত করে, অন্যদশজন থেকে আলাদা করে। সেটা কি আমরা আবিষ্কার করতে চাই? তিনি বললেন,

"হ্যাঁ, আঁকাআঁকিটা আসলে কখনোই কারো কাছে শেখা হয়নি। স্কুলে ড্রয়িং ক্লাস থাকত কিন্তু সে আর এমন কি! স্কুলে থাকতে আমি বরং অবাক হয়ে দেখতাম আমার বন্ধু জিশানের আঁকা। দরুণ ছবি আঁকত, এখন সে একজন আর্কিটেক্ট। আমি পড়েছি মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে। যেকোনো প্রতিষ্ঠানের সুন্দর পরিবেশ একজন মানুষকে বিকশিত করতে সহায়তা করে, সেটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই হোক আর কর্মক্ষেত্রই হোক।

আমি উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছি বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ রাইফেলস পাবলিক কলেজ থেকে, আর পরবর্তীতে বিবিএ এবং এমবিএ করেছি আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ থেকে। গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ করে চার বছর চাকরি করেছি 'টপ অফ মাইন্ড' বিজ্ঞাপনী সংস্থায়। বর্তমানে নিজের ছোট্ট একটা ব্যবসা নিয়ে আছি। গর্ব করেই প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানের নাম বললাম কারণ আমার আজকের এই অবস্থানের পেছনে বাবা-মার মতোই এদেরও অনেক অবদান রয়েছে।" 

Caption

জানতে চেয়েছিলাম শৈশব কৈশোরের গল্প। সেই গল্প এতোটাই সুন্দর করে তিনি বর্ণনা করলেন যে, আমার মনে হলো তার কথাগুলো যে কোনো তরুণ সৃজনশীল কাজে ইচ্ছুক মানুষকে সাহায্য করবে। কারণ, ক্রিয়েটিভ কাজ করতে তো একটা মানসিক প্রস্তুতিরও দরকার হয়৷ সেটা যেভাবে পেয়েছিলেন সাদিত-

"ছোটবেলায় গল্পের বই পড়তে খুব ভাল লাগত আমার। আমি খুব বেশি বই পড়ুয়া না হলেও আমি মনে করি বই আমার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা বিকাশ। টিনটিনের সাথে পরিচয় হয়েছিল ক্লাস থ্রি বা ফোরে থাকতেই। নোবেল নামে আমার প্রিয় এক দুলাভাই আমাকে এই টিনটিনের জগতে প্রবেশ করিয়েছেন। পড়তে পড়তে নিজেকেই টিনটিন মনে হতো আমার! এখনও ভাবি মাঝে মাঝেই! ভাইয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা আমার ছেলেবেলায় এতো সুন্দর একটা কিছুর সাথে আমাকে সম্পৃক্ত করানোর জন্য। তিব্বতে টিনটিন পড়ে যে মন খারাপটা হয়েছিল সেই ছোট্ট মনে, সেটা আমি আজও অনুভব করতে পারি। 

এরপর যার হাত ধরে পুরোপুরি গল্পের বই এর জগৎে প্রবেশ করলাম তার নাম তন্ময়, আমার বন্ধু। কখনও ড.মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর ফোবিয়ানের যাত্রী হয়ে, কখনও শাহরিয়ার কবিরের নুলিয়াছড়ির নেলী খালার বাসায়, কখনও বা হুমায়ূন আহমেদের তেঁতুল বনে জোছনায়। একের পর এক পড়ে গেছি নেশার মতো।

টুকটাক অনেক লেখকের বই পড়া হলেও প্রিয় হুমায়ূন আহমেদকে আমি আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলে মনে করি। উনি এত সুন্দর করে জীবনের ছোট ছোট মুহূর্তগুলোকে উপভোগ করতে শিখিয়েছেন যে, এখন আমার ঘি দিয়ে গরম ভাত খেলে, প্রবল বরষায় খিঁচুড়ি রান্না হলে, সুন্দর পেইন্টিং বাঁধানো কোনো ড্রইংরুমে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিলে, কাউকে খুব চালাকি করতে দেখলে বা বোকার কান্ড কারখানা দেখলে, ট্রেনে করে কোথাও ঘুরতে গেলে, আকাশে বিশাল করে চাঁদ উঠলে, আম্মু রাগে গজগজ করলে- মনে হয় হুমায়ূন আহমেদ এর কোনো উপন্যাসের পাতায় আছি। এই মুহূর্ত গুলোর নাম দিয়েছি হুমায়ূন মুহূর্ত।

হুমায়ূন আহমেদকে সাজিদ তাঁর জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলে মনে করেন

হুমায়ূন আহমেদ পড়তে যেয়ে রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছি বার বার, এবং তাকেও ভালোবেসেছি। না বেসে উপায়ও নাই। তিনি মনে হয় প্রত্যেকটা মুহূর্তে, প্রত্যেক মেজাজের জন্য অন্তত একটা করে গান বা কবিতা দিয়ে গেছেন। গানও আমার অনেক মুক্তির একটা যায়গা। বিশেষ করে গান শুনতে শুনতে ছবি আঁকার মজাই আলাদা। অর্ণব বা অনুপম রায়ের গান যে আমার খুব পছন্দ, তা হয়তো আমার কিছু কাজ দেখলেই যে কেউই বুঝে যাবে। আসলে যা বলতে চাচ্ছি, ইনাদের সবারই অনেক প্রভাব আছে আমার ভেতরের শিল্পী স্বত্তাটাকে বিকশিত করার। 

আরেকজন মানুষের কথা আলাদা করে না বললেই নয়, তিনি হচ্ছেন আমার সেঝো খালা নূর ই হাফসা পারভিন। তিনি একজন বেতার ও মঞ্চ শিল্পী এবং নানান গুণে গুণান্বিত একজন মানুষ। খালামনির সান্নিধ্যে থেকে থেকে আমার নানা রকম ব্যাতিক্রমী কাজের সূচনা হয়েছে। আমি আর খালামনি কখন যে কি দিয়ে কি বানিয়ে ফেলি, তার কোনো ঠিক ঠিকানা নাই। খালার সাথে কাজ করতে যেয়ে বিভিন্ন ফেলে দেয়া জিনিসকে নতুনভাবে ব্যবহার করার আগ্রহটা তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন রিসাইকেল ম্যাটেরিয়াল দিয়ে কাজ করতে করতেই টিব্যাগে আঁকার বিষয়টাও স্থায়ী হয়ে গেছে। এগুলো যেমন আমাকে আনন্দ দেয়, তেমনি অন্যদেরও একটু ভাবিয়ে তোলে। অসুন্দরের মাঝেও যে সুন্দর লুকিয়ে থাকে সেটা আমরা খেয়াল করি না অনেক সময়ই। প্রয়োজন শুধু একটু ইতিবাচক ছোঁয়া।"

আজকাল বড্ড দূষণ এই পৃথিবীতে। এত এত বর্জ্যে ভরা এই আমার শহর৷ সেখানে একটা মানুষ রিসাইকেল আর্টটাকেই বেছে নিলেন নিজের ট্যালেন্টকে উপস্থাপন করবার জন্য। এটা শুধু যে আর্টের প্রতিই ভালবাসা তা তো নয়, এটা প্রকৃতির প্রতিও ভালবাসা। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, চাইলে একটা ফেলে দেয়া বর্জ্যকেও শিল্পে রুপান্তর করা যায়। নিজের মধ্যে তিনি অনুভব করেন প্রকৃতির প্রভাব, এই প্রকৃতির প্রতি তার ভালবাসা ভীষণ প্রগাড়। এই বিষয়ে বললেন,

"প্রকৃতির প্রভাবটাও আমার কাজে খুব জোড়ালো। প্রকৃতির নানা রুপ, তার পরিবর্তন আর সেটা ঘিরে আমাদের কার্যক্রম- এগুলো খুব আকর্ষণ করে আমাকে। মনের ভেতরে কেমন একটা আয়োজন বোধ করি এক ঋতু থেকে আরেক ঋতুর পরিবর্তনের সময়টা। ছাদে লেপের রোদ পোহানো দেখলেই মনে আনন্দ হয় শীত আসছে, বসন্তে আম্রমুকুলের ঘ্রাণ মনে করিয়ে দেয় ফলময় গ্রীষ্মের কথা, আকাশ কালো করে ঝড় আসার পূর্বের থমথমে ভাবটা মনের কোথায় যেনো এক উন্মাদনা সৃষ্টি করে। এগুলোই চলে আসে আমার কাজে বারবার। 

আমি ঘুরতে খুব পছন্দ করি, কোথাও ঘুরতে গেলে সেই জায়গার বৈশিষ্ট্যও অনেক সময় আমার আঁকার জগৎকে নাড়া দেয়। একবার বান্দরবান ঘুরে এসে বেশ কয়েকদিন মনটা সবুজ হয়েছিল। এঁকে ফেলেছি কেউক্রাডংয়ের চূড়ায় ওঠার স্মৃতি। সিলেটের চা বাগান ঘুরে এসে তার দৃশ্যও স্থান পেয়ে গেছে আমার চায়ের ব্যাগের ক্যানভাসে। দেশের বাইরে ঘুরতে গেলেও চেষ্টা করি আমার মতো করে সেই দেশের উল্লেখযোগ্য কিছু আমার চায়ের ব্যাগের গল্পে নিয়ে আনতে।"

তিনি চেষ্টা করেন টিব্যাগে একটা গল্প নিয়ে আসতে

একজন শিল্পীর দায়িত্ববোধের জায়গাতেও তিনি ভীষণভাবে দায়িত্বশীল। একারণেই বোধহয় সামাজিক ইস্যুগুলোও তার ক্যানভাসে ধরা দেয়৷ সমসাময়িক ইস্যু, কিংবা কোনো ভাল বিষয় পেলেই তিনি সেটাকে ক্যানভাসে নিয়ে আসেন রঙয়ের ছোঁয়ায়। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কিংবা হুমায়ূন আহমেদের দেবী উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমা- এসবও তার টিব্যাগের ক্যানভাসে উঠে এসেছে গল্পের অন্য একটি রুপ হয়ে। দেবী নিয়ে আঁকার পর অবশ্য ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর আক্রমনাত্মক মন্তব্যেরও শিকার হতে হয়েছিল তাকে। তাতে কি এসে যায়! তিনি তো জানেন তিনি আসলে নিজের কাছে পরিষ্কার, নিজের কাজে শুদ্ধ। নিজেই বলেন, 

"সমাজের নানা রকম অস্থিরতাও মাঝে মাঝে চলে আসে আমার কাজে। আঁকাআঁকিটা আমার আত্মতৃপ্তির যায়গা, আমি সব সময় চাই আমার এই তৃপ্তির যায়গাটা থাকবে শরৎের নীল আকাশের মতো। কিন্তু আমার চাওয়া মতো আকাশ তো আর সব সময় নীল থাকে না, ধুসর মেঘ চলেই আসে মাঝে মাঝে। শিল্প এমন একটা মাধ্যম যা কখনই দায়িত্ববোধের বাইরে না। তাই কিছু অপ্রত্যাশিত বিষয় নিয়েও কাজ করা হয়। মোট কথা আমার দৈনন্দিন জীবনের নানা বিষয়ই উঠে আসে আমার চায়ের ব্যাগের গল্পে। তার সাথে কখনও যুক্ত হয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, প্রিয় ব্যক্তিত্ব আর শৈশবের ফেলে আসা কিছু স্মৃতি।"

এই মানুষটার ভাবনাচিন্তায় ডুবে গেলাম। জানতে ইচ্ছে হলো, কি ভাবেন তিনি নিজের জীবন নিয়ে৷ কি তার জীবনদর্শন?

"আমার জীবনদর্শন, যতটুকু বাঁচব সেটা অল্পতে হোক আর বেশিতেই হোক মন ভরে বাঁচব। নিজের অবস্থান বুঝে নিজের আনন্দটাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো। সৃষ্টিকর্তা খুব কায়দা করে আনন্দকে ছড়িয়ে রেখেছে বিভিন্ন কিছুর মাঝে, আমাদের খুঁজে পেতে যা দেরি হয়। মানুষের সুখে দুঃখে কাছে থাকার চেষ্টা করব, তবেই তো সৃষ্টিকর্তার কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব হবে। দেশকে ভালোবাসব, চেষ্টা করব দেশের জন্য খুব সামান্য হলেও কিছু একটা করার। নাগরিক হিসেবে নিজ দায়িত্ব কর্তব্য সঠিক ভাবে পালন করাও তার মাঝেই পড়ে। আর এইসব তখনই সম্ভব হবে, যখন আমরা নিজেকে ভালোবাসব। যেটা আমারা প্রায়ই ভুলে যাই। জীবনে এইটুকু পথ অতিক্রম করে একটা বিষয় মাথায় খুব ভালো করে ঢুকেছে যে, নিজেকে ভালোবাসতে হবে, নিজের কাজ নিষ্ঠার সাথে করে যেতে হবে। তবেই আমাকেও সবাই ভালোবাসবে।"  

আমাদের দেশের আনাচে কানাচে অনেক প্রতিভাবান মানুষ ছড়িয়ে আছেন। কিন্তু, সবাই নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন না। তাদের কাছে অনুপ্রেরণার নাম হতে পারে একজন সাদিতউজ্জামান। যার আর্টের ব্যাকগ্রাউন্ড নেই, অথচ তাকে তো নিজের প্রতিভা প্রমাণ করার জন্য ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি৷ তিনি শুধু নিজের কাজটুকু, ভালবাসার জায়গাটুকু লালন করে গেছেন। বাদ বাকি সব এমনিই এসেছে। এই কাজ করাটা, কাজ শুরু করাটাই বড় ব্যাপার। যাদের ব্যাকগ্রাউন্ড নেই, কিন্তু মনে মনে স্বপ্ন দেখেন, সৃজনশীল কাজের সাথে যুক্ত হবেন তাদের জন্য সাদিত উজ জামান বললেন,

"আমি কখনও আঁকতে শিখিনি, কিন্তু আঁকতে ভালো লাগে আমার। মাথার ভেতরে কিছু একটা ঘুরলে সেটাকে আঁকার মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারলে এক প্রকার মুক্তি পাই, আর সেটা যদি অন্যকেও আনন্দ দেয়, তবে দুটো মিলে দারুণ একটা তৃপ্তি বোধ করি। আমার মতো নিশ্চয়ই অনেকে আছে যারা আর্ট ব্যাকগ্রাউন্ডের না, অথচ মনে মনে এই শিল্পকে লালন করে। অনেক কিছু ভেবে হয়তো সামনে আসার সাহস করে না। তাদের প্রতি আমার একটাই অনুরোধ, মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার এই বিশেষ জায়গাটা থেকে যেন নিজেকে যেনো বঞ্চিত না করে। নিজের যোগ্যতা আর পারদর্শিতা বুঝে মন থেকে কাজ করে গেলে সেটা মানুষের দৃষ্টিগোচর হবে, লোকে তার মূল্যায়ন করবেই। বিষয় যেটাই হোক উপস্থাপনা হতে হবে নিজের মতো। আর সেটা যদি দৃষ্টিনন্দন হয়, ব্যাকআপ আর ব্যাকগ্রাউন্ড খুব একটা বড় বিষয় বলে আমার মনে হয় না। তবে নিজেকে উন্নত করতে শিখার কোনো বিকল্প নাই। শিল্পচর্চা আমাদের মূল্যবোধ এর বিকাশ ঘটায়, একটা সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে এই বিকাশটা জরুরী।" 

টিব্যাগ স্টোরিজ এখন পরিচিত নাম। অনেক সম্মাননা পেয়েছেন সাদিত, পেয়েছেন অকৃত্রিম ভালবাসা। তার সেদিন ভীষণ গর্ব হয়েছিল যেদিন টেলিভিশনের এক প্রোগ্রামে তার মাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল, সাদিতের মা বলে। সে এক অপূর্ব অনুভূতি। পুরোটাই শখের কাজ৷ অনেকে কিনতে চায় তার শিল্পকর্ম। পুরোপুরি কমার্শিয়াল এখনি হতে চান না সাদিত। তবে, এখন কর্পোরেট কিছু কাজ করছেন। ইস্পাহানি মির্জাপুর কোম্পানির সাথে কাজ করেছেন এরই মধ্যে৷ বিভিন্ন জায়গায় তার চিত্রকর্ম ব্যবহার হয়েছে প্রচ্ছদ ছবি হিসেবে৷ টিব্যাগ স্টোরিজ নিয়ে নিজের আরো কিছু প্রিয় মুহুর্তের কথা জানালেন এগিয়ে চলোকে।

"টিব্যাগ স্টোরিজ নিয়ে অনেক প্রিয় মুহূর্ত আছে। এই যেমন ঠিক এখনই যখন নিজেকে নিয়ে বলার সুযোগ পাচ্ছি। নিজ জীবনের কিছু অংশ নিয়ে কথা বলতে পারছি, এতো অবশ্যই দারুণ মুহূর্ত আমার জন্যে। মনে হচ্ছে অনেকদিন পর আবার নিজেকেই নিজে দেখতে পেলাম! ধন্যবাদ এত সুন্দর করে প্রশ্নগুলো করার জন্য। সবচেয়ে প্রিয় যদি বলতে হয়, তবে সেটা মনে হয় দৈনিক প্রথম আলোর ছুটির দিনে নিজেকে নিজের কাজসহ দেখতে পাওয়া। আমি রাজশাহী থাকি, আমার এদিকে পত্রিকা আসতে একটু বেলা হয়ে যায়। সেইদিন ঘুম ভাঙে ফোন আর মেসেজের আওয়াজে। ফেইসবুকে ঢুকে দেখি এলাহী কারবার। অনেকেই আমার ফিচারের ছবি তুলে ট্যাগ দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। অনেক ছোটবেলার শিক্ষক, বন্ধু, প্রতিবেশি ফোন দিয়ে শুভেচ্ছা দিয়েছে। এটা আমার জন্য অবশ্যই দারুণ একটা প্রাপ্তি। তারপর যখন পত্রিকা হাতে পাওয়ার পর প্রথম নিজ চোখে দেখলাম ঐ মুহূর্তটা সত্যিই খুব আনন্দের ছিল। আর সব সময়ের জন্য প্রিয় মুহূর্ত যখন আমার বাবা মা কে আমাকে নিয়ে ভালো কিছু শুনতে হয়। এক রকম মনে হয় যাক, কিছুতো দিতে পারলাম তাদের। 

যেহেতু এটা একদম ভিন্ন একটা ক্যানভাস, খুব সহজেই একজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সম্ভব। আমি স্বপ্ন দেখি আমার এই কাজের মাধ্যমে আমার দেশকে বিশ্বের কাছে নতুন করে তুলে ধরব। দেশের বাইরে থেকে কেউ যখন আমাকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠায়, তখন এই দায়িত্ববোধটা আরো বেড়ে যায়। মনে হয় দেশকে নিয়ে আরো বেশি করে আঁকি। তাছাড়া যেহেতু বাংলাদেশে এই ধরনের কাজ আগে কখনও হয়নি, আমাদের শিল্পাঙ্গনে আমার এই চায়ের ব্যাগের গল্পগুলো নতুন একটা মাত্রা যোগ করতে পারলে সেটাই হবে আমার সবচেয়ে বড় ভালোলাগা।"

কথোপকথনের সীমারেখা টানতে ইচ্ছে হয় না। প্রশ্নের চেয়েও উত্তরে তিনি বড়ই অকৃপণ। মন খুলে কথা বললেন, মনের কথার কি সুন্দর বহিঃপ্রকাশ। তবুও কথার সীমা টানতে হচ্ছে৷ শেষ করলেন, কিছু আশাবাদ আর অদ্ভুত সুন্দর কিছু কথা দিয়ে৷ বললেন,

"আমাকে একজন বলেছিলেন, ফেলে দেয়া বস্তুকে তুলে এনে তুমি সেটাকে সম্মান দিয়েছ, এখন সে'ই তোমাকে সম্মান এনে দিচ্ছে। খুব সুন্দর এবং সত্যি কথা। প্রকৃতিকে যদি আমরা যত্ন করি প্রকৃতি তার দিগুণ আমাদের ফেরত দেয়। কিন্তু আমরা বেশিরভাগ সময়ই সেটা করি না। রবার্ট লুইস স্টিভেন্সন রচিত বিখ্যাত একটা রহস্য উপন্যাস আছে যার নাম "ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড" সেখানে কায়দা করে লেখক মানুষের মধ্যকার ভাল এবং মন্দ এই দুটো স্বভাবকে নিয়ে একই দেহের ভিতর দুটি মানুষকে লালন করার একটা চিত্র তুলে ধরেছেন। সত্যিকার জীবনে আমরাও হয়তো কিছুটা সেরকমই। আমরা উপভোগও করতে জানি আবার বিনষ্ট করতেও জানি। মাঝে মাঝে আমরা বাগান শুণ্য করে ড্রইংরুম সাজাতে ব্যাস্ত হয়ে যাই, অথচ একটু ভেবে দেখি না যে প্রজাপতি গুলোর মধু আহরনের দৃশ্য বাগানেই দেখতে সুন্দর, ঘরের ফুলদানিতে নয়। আমি ভেবে রেখেছি খুব শীঘ্রই পরিবেশ দুষন বিশেষ করে টুরিস্ট স্পট গুলোর সংরক্ষণ নিয়ে হয়তো কিছু কাজ করব। আমার কাজ দিয়ে যদি অন্তত একজনকেও সচেতন করতে পারি তবে সেটাই হবে দেশের জন্য কিছু করতে পারা।" 

এই বিস্ময়কর ভাল মনের মানুষটির জন্য শুভেচ্ছা, ভালবাসা। তার শিল্পকর্মের ক্যানভাস প্রিয় বাংলাদেশকে এভাবেই ফুটিয়ে তুলুক। শিল্পীর রঙ তুলির জাদুতে বাংলাদেশ হয়ে উঠুক স্বপ্নের রঙিন দেশ। 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা