মেয়েকে শেখানোর আগে ছেলেকে শেখান। ধর্ষিত হওয়াটা অপরাধ না। ধর্ষণ করা অপরাধ।

শাখাওয়াত হোসেন সোহাগঃ 'টাইট জিন্স পরেছিলো, ধর্ষণই যোগ্য শাস্তি তার।' সোশ্যাল মিডিয়ায় নিউজলিঙ্কের নিচে এই বক্তব্য দিয়েছেন যিনি, তিনি একটা প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা। এবং ঠিক তখনই আমার মনে হলো, আমরা একদম বেহুদাই মানববন্ধন, মিছিল, মোমবাতি প্রজ্জ্বলন কিংবা ধর্ষকের শাস্তির দাবী জানাচ্ছি।

'বারুদ ভেজা' নামক একটা প্রবাদ আছে। সম্ভবত হুমায়ূনের কোনো এক বইয়ে পড়েছিলাম। স্পষ্ট মনে নেই, আবছা যেটুকু মনে আছে সেটুকু বলি। যুদ্ধ হচ্ছে। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে হারানোর জন্য প্রচুর গোলা বারুদ আনা হলো। পরদিন সকালে আক্রমন হবে। রাতে ঝুম বৃষ্টি নামলো। পরদিন অফিসার অধস্তনদের ডেকে প্রতিপক্ষকে এখনো হামলা না করার পেছনের কারণ জানতে চাইলেন, অধস্তনরা কারণ বললো, 'আমরা সংখ্যায় কম' 'আজকে আবহাওয়া খারাপ' 'কিছু সৈনিকের শরীর খারাপ' 'বাতাসে কিছু তাবু উল্টে গেছে' 'হেন তেন ব্লা ব্লা' অফিসার তাকিয়ে রইলেন। অনেক পরে এক অধস্তন বললো, 'গতরাতের বৃষ্টিতে বারুদ ভিজে গেছে' অফিসার বললেন, 'তোমাদের এত কারণ বলতে হলো কেন? প্রথমেই বলতে, বারুদ ভেজা। আমি বুঝে যেতাম!'

আমরাও একটা যুদ্ধক্ষেত্রে আছি। আমাদেরও বারুদ ভেজা। হুদাই কারণ দেখাচ্ছি, এটার জন্য ধর্ষণ, ওটার জন্য ধর্ষণ, ধর্ষককে এটা করো, ধর্ষককে ওটা করো। ধর্ষণের শেকড় কাটার কথা কারোর মাথায়ই নেই। প্রতিটা বিদ্যালয়, কলেজ, ভার্সিটির শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শিক্ষিকাদের মানসিক সুস্থতা পরখ করার পরই চাকুরিতে নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা করুন। গাদা গাদা এম.সি.কিউ আর ভাইবার পাশাপাশি সাইকোলোজিস্ট দিয়ে ধর্ষণ সম্পর্কে এদের প্রত্যেকের প্রকৃত অবস্থান কোনদিকে জেনে নিন এরা শিক্ষার আলো ছড়ানোর আগেই। প্লেটোর গুরু সক্রেটিস না হয়ে হিটলার হলে ফিলোসোফি কিলওসোফি হয়ে যেত।

Learn what to teach

শুভ দাশগুপ্তের একটা কবিতায় পড়েছিলাম, 'অফিসের সঠিক মাইনের কথা নিজের বৌকে বলতে নেই। হিন্দুদের সামনে গো-মাংসের কথা বলতে নেই। রেলের কর্তাদের সামনে টাইম টেবিলের কথা বলতে নেই। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে শিক্ষকদের বলতে নেই। আর পুলিশকে সততার কথা বলতে নেই।' অযথাই কবিতা লেখা হয় না। কুর্মিটোলার যে জায়গায় মেয়েটি ধর্ষিত হলো, ঐ জায়গায় প্রচুর অপরাধমূলক কাজ আরো হয়। মাদকদ্রব্যের বেচাকেনাও চলে। জনসাধারণের বক্তব্য, পুলিশ কিছুই করে না। কখনো সখনো আটক করে, টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়। একটা শহরের নিয়ম শৃঙ্খলা যাদের হাতে, ধর্ষণ কিংবা সেক্সুয়াল হ্যারাজমেন্টে তাদের অবস্থান কোনদিকে জানা অতিমাত্রায় আবশ্যক। কারণ, একমাত্র তখনই অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগা যায় যখন খোদ তুমি বুঝতে পারো এটা অপরাধ!

প্রতিটা আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী সদস্যের নিয়োগ সম্পর্কিত কার্যক্রমে সুস্বাস্থ্যের পাশাপাশি সুস্থ মস্তিষ্কেরও সমপরিমাণ গুরুত্ব দিয়ে যাচাই করুন। এটা ভীষণ প্রয়োজন। এবং পরিবার, বাকি দুইটা কাজ সরকার প্রশাসন করতে পারবে চাইলে। এটা শুধুই আমাদের করতে হবে। প্রতিটা ধর্ষকই শিশু ছিলো একটা সময়। তেতো হলেও সত্য, আজকে যারা শিশু আগামী দিন তারা হলেও হতে পারে ধর্ষক। আপনার শিশু আপনার কাছ থেকেই শিখবে।

প্রিয় আন্টি, 'ঐ যে পাশের বাসার মেয়েটা, কি বাজে জামাকাপড়ে বয়ফ্রেন্ডের সাথে টাংকি মারে। এই মেয়ে কি যে খারাপ, রাস্তাঘাটে রেইপ হয়ে মরবে সিউর!' আপনার সন্তানের সামনে এইসব চুদুরবুদুর আলাপ বন্ধ করুন। আমি বলি কী, সন্তানের পেছনেও না বলুন। সন্তান দ্রুত শিখে সবকিছু। চরিত্র নির্ধারণ হয় পোশাকের মাধ্যমে এবং ধর্ষণ হচ্ছে বেপর্দায় চলা নারীর উপযুক্ত শাস্তি। আপনার কাছ থেকে দ্রুত এটাও শিখে যাবে। 

প্রিয় আংকেল, একটা নারীর জীবনের প্রথম ভালোবাসার পুরুষটি আপনি। আপনার কন্যা সন্তান। আর একজন পুরুষের প্রথম অনুকরণীয় আদর্শ ব্যক্তিত্ব আপনি। ওই পুরুষটি আপনার ছেলে সন্তান। আপনিই ঠিক করবেন, আপনার একটা সন্তান অকৃত্রিম ভালোবাসার পুরুষ হবে নাকি আরেকটা সন্তান ধর্ষিতা।

'পিংক' মুভি দিয়ে শেষ করি। আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়, এই মুভি অথবা মুভির সারমর্মটা বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষকে যদি সকালের চায়ের সাথে মিশিয়ে গিলিয়ে দিতে পারতাম। আমরা এবং আমাদের সোসাইটি আজ পর্যন্ত একটা উল্টোপথে হেঁটেছে... 'We should save our boys, not the girls. Because if we save our boys then our girls will be safe.'

লেখাটি ফেসবুকের ক্যানভাস গ্রুপে প্রকাশিত। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা