বিরাট নেই, পূজারা তার হয়ে রান করে দিচ্ছেন। অজিঙ্কা দ্রুত ফিরছেন, বিপদের মুহূর্তে বিহারী ত্রাতা হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। টপ অর্ডার ফেইল করেছে? জাদেজা-অশ্বিন রান এনে দিচ্ছেন, এই দুজন যখন নেই, তখন সেই রোলটা পালন করছেন শার্দুল-সুন্দর!
বোর্ডার-গাভাস্কার সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট থেকে ভারতীয় দলের বদলে যাওয়া নিয়ে যখনই আলোচনা হয়েছে, 'ক্যারেক্টার অফ ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিম' কথাটা বারবার এসেছে ধারাভাষ্যকারদের মুখে। হার্শা ভোগলে থেকে সঞ্জয় মাঞ্জারেকার কিংবা গ্লেন ম্যাকগ্রা- প্রত্যেকেই বলেছেন, এই দলটা ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলছে। অ্যাওয়ে সিরিজে এমন নজির খুব দুর্লভ, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে তো নেই বললেই চলে। অস্ট্রেলিয়ায় সবশেষ সফরেও টেস্ট সিরিজ জিতেছিল ভারত, তখন এত কথা হয়নি, স্মিথ-ওয়ার্নারবিহীন অজি দলটাকে বি-টিমের তকমা দিয়েছিল সবাই। ভারতের জয় কিংবা পূজারার অতিমানবীয় পারফরম্যান্স তাই অতটা গৌরবান্বিত হয়নি তখন।
অ্যাডিলেড, ২০২০। ছত্রিশের লজ্জায় মুখ চুন ভারতের, অস্ট্রেলিয়া তখন হোয়াইটওয়াশের স্বপ্নে বিভোর। এদিকে কোহলি ফিরে যাচ্ছেন দেশে, সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর পাশে থাকবেন বলে। রোহিতের সঙ্গে তার গৃহবিবাদের গুঞ্জন তখন চরমে, পেস ব্যাটারির তারকারা খসে পড়ছেন একে একে। ভারতের টিম মেম্বারদের সবার ওপরে লাই ডিটেক্টর টেস্ট চালানো হলে কয়জন ধবলধোলাই এড়ানোর কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, সেটা জানা যেতো। ভারতীয় দল তখন যেন ক্ষুধার্ত বাঘের সামনে পড়া কচি ছাগল ছানাটি, তারচেয়ে অসহায় পৃথিবীর বুকে আর কেউ নেই।
তারপর মেলবোর্ন এলো। ঘুরে দাঁড়ানোর প্রায় অবাস্তব একটা গল্প লেখা হলো সেখানে। অজিঙ্কা রাহানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন, কেন তাকে কোহলির ডেপুটি করা হয়েছে, সেটার প্রমাণ দেয়ার জন্য সেরা মঞ্চটাকেই বেছে নিয়েছিলেন তিনি। দুই ইনিংসের কোনোটাতেই দুশোর কোটা পেরুতে পারলো না মাইটি অজিরা, এমন ঘটনা গত ত্রিশ বছরে ঘটেনি! যে ব্যবধানে অ্যাডিলেডে হার এসেছিল, ঠিক সেই ব্যবধানেই অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে মধুর প্রতিশোধ নিলো ভারত।
তারপর সিডনি, ভারত তখন চলন্ত একটা হাসপাতাল যেন। প্রতিটা সেশনেই কেউ না কেউ আঘাত পাচ্ছেন, ছিটকে যাচ্ছেন। এই টেস্টটা নিয়ে আপনি একটা রূপকথার গল্প লিখে ফেলতে পারবেন। সিরাজের কান্না, স্মিথ-পূজারার কামব্যাক, রবীন্দ্র জাদেজার অতিমানব হয়ে ওঠা কিংবা হার এড়াতে হনুমা বিহারীর সেই মহাকাব্যিক ইনিংস- টেস্ট ক্রিকেট ওয়াজ অ্যাট ইটস ব্লাডি বেস্ট ইন সিডনি! একশো ওভারের বেশি খেলে ম্যাচটা ঠেকিয়ে দেবে ভারতের এই বি-টিমটা, কে ভেবেছিল? রিষভ পান্টের পাল্টা আক্রমণ অথবা পূজারা-বিহারী জুটির সেই দাঁতে দাঁত চেপে করা তুমুল প্রতিরোধ নিয়ে ক'দিন পরেই সিনেমা হবে বলিউডে, নিশ্চিত থাকুন। অ্যান্ড দে ডিজার্ভ দিস ট্রিবিউট, ট্রুলি, জেনুইনলি।
ব্রীসবেন, ২০২১। অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে পয়া ভেন্যু, গত বত্রিশ বছর ধরে এখানে হারে না অস্ট্রেলিয়া। স্টিভ ওয়াহ হারেননি, হারেননি রিকি পন্টিং, মাইকেল ক্লার্ক বা স্টিভ স্মিথও। টিম পেইন সেই গৌরব ধরে রাখতে পারলেন না। তারচে বরং বলা ভালো, অজিঙ্কা রাহানের ভঙ্গুর দলটা সেই গৌরব ধরে রাখতে দিলো না অস্ট্রেলিয়াকে। ব্রীসবেনে শেষদিনের পুরোটা ব্যাট করে ম্যাচ বাঁচানোই যেখানে অসম্ভব, সেখানে সোয়া তিনশো রান চেজ করে টিম ইন্ডিয়া কিনা জিতে গেল! বডিলাইনে বল করে, শরীরে বারবার আঘাত হেনেও পূজারাকে থামানো গেল না, রিষভ প্যান্ট আরও একবার জানান দিলেন, তার ব্যাটিংটা ভারতের কেন দরকার। যে দলে কোহলি নেই, ইশান্ত-ভূবনেশ্বর নেই, শামি-যাদব নেই, নেই অশ্বিন-জাদেজাও, তারা কীনা লিখলো এমন অসম্ভব এক জয়ের গল্প! এ তো ডেভিডের গোলিয়াথ বধ হয়ে গেল!
এখানে, ঠিক এখানেই ক্যারেক্টারের ব্যাপারটা আসে। এখানেই আসে টিম ইন্ডিয়ার ড্রেসিংরুমটার একটা সেনাছাউনিতে পরিণত হবার গল্প। বিরাট নেই, পূজারা তার হয়ে রান করে দিচ্ছেন। অজিঙ্কা দ্রুত ফিরছেন, বিপদের মুহূর্তে বিহারী ত্রাতা হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। টপ অর্ডার ফেইল করেছে? জাদেজা-অশ্বিন রান এনে দিচ্ছেন, এই দুজন যখন নেই, তখন সেই রোলটা পালন করছেন শার্দুল-সুন্দর! পেস অ্যাটাকে বুমরাহ ছাড়া বাকিদের নাম শুনলে দুই মাস আগে ভারতীয়রাও লজ্জা পেতো, সেই সিরাজ-নটরাজনরা দায়িত্ব তুলে নিলে কাঁধে। অস্ট্রেলিয়ায় এসে বাবার মৃত্যসংবাদ শোনা সিরাজ নিজেকে উজাড় করে দিলেন, জাতীয় সঙ্গীত শুনে কাঁদলেন, কিন্ত বর্ণবাদী মন্তব্যে ভাংলেন না, বরং ভেতরের আগুনটা ঢেলে দিলেন বল হাতে।
এটাই টিম ইন্ডিয়ার সেই 'ক্যারেক্টার', যে ক্যারেক্টারের কথা সবাই বলছেন বারবার। এই চরিত্র হার না মানার, এই চরিত্র যে কোন সিচুয়েশনে ম্যাচ বের করার, এই চরিত্র প্রতিটা ম্যাচ জিততে চাওয়ার, প্রতিটা সেশন রাজত্ব করতে চাওয়ার। ভারতকে বলা হতো দেশের মাটিতে বাঘ, বিদেশে বেড়াল। সেই চরিত্রটা সৌরভ আর ধোনি মিলে বদলে দিয়েছিলেন খানিকটা, কোহলি তাতে আরও সাহস জুড়েছিলেন, ব্রীসবেনে বিজয়পতাকা উড়িয়ে দিয়ে রাহানের টিম ইন্ডিয়া প্রমাণ করলো, দুনিয়ার যে কোন প্রান্তে ভারত জেতার জন্যেই খেলে, জিতেই মাঠ ছাড়ে। এটাই তাদের 'ক্যারেক্টার'! একাদশে যেই থাকুক বা না থাকুক, প্রত্যেকের মাথায় একটা শব্দই গেঁথে থাকে সারাক্ষণ- জয়!
সিরিজের শুরুতে আমার প্রেডিকশন ছিল ২-০, অবশ্যই অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে। প্রথম টেস্টের পর হোয়াইটওয়াশের কথাই মাথাই ছিল, ছত্রিশে ভেঙে পড়া তাসের ঘর যে এভাবে হিমালয় হয়ে ঘুরে দাঁড়াবে, ভাবিনি কম্মিনকালেও। আমাকে ভুল প্রমাণিত করার জন্য ধন্যবাদ ভারতীয় দলকে, রাহানেকে, পূজারাকে, বিহারী-প্যান্টকে, জাদেজা-অশ্বিনকে, সিরাজ-সুন্দর-শার্দূল; সবাইকেই। টিম ইন্ডিয়া, তোমারে সেলাম!