বর্তমান সময়ের এক আলোচিত সমস্যা কিশোর গ্যাং, এদের কর্মকাণ্ড এবং এই অপরাধী হয়ে ওঠার নেপথ্য কারণ নিয়ে আলোচনা এক জরুরী বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আসুন আমরা একটু নজর দেই এই সমস্যার পেছনে কী আছে।
কাজী ফয়সাল হোসেনঃ অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত আমাদের বাংলাদেশে নতুন নতুন সমস্যার আবির্ভাব ঘটে। বর্তমান সময়ের আরো এক নতুন আতংকের নাম কিশোর গ্যাং। তবে একে নতুন বৈশ্বিক সমস্যা বললে অত্যুক্তি হবে না। কিশোর গ্যাং হলো বিভিন্ন বয়সী কিশোরদের নিয়ে গড়ে ওঠা দল বা গোষ্ঠী যারা মূলত সংঘবদ্ধ হয়ে চলাফেরা করে এবং অপরাধে একজন আরেকজনকে সহায়তা করে। কিশোর বয়সে শারীরিক, মানসিক পরিবর্তনের কারণে বিভ্রান্ত হয়ে এ সকল কিশোর পা বাড়ায় ভুল পথে, জড়ায় অসামাজিক এবং অন্যায় কর্মকাণ্ডে। নষ্ট করে নিজেদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, পরিবারগুলোকে করে নিঃস্ব এবং নিজেদের অপকর্মের মাধ্যমে ধ্বংস করে আরো অনেক সাধারণ মানুষের জীবন। শুধুই তাই নয় সমাজকে ঠেলে দিচ্ছে এক অনিশ্চয়তার দিকে।
কিশোরদের এ ধরনের আচরণ হয়তো আগেও ছিলো, কিন্তু এমন ভয়ানক যে কখনোই ছিলো না তা বয়োজ্যেষ্ঠদের ভাষ্যমতে বোঝা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে কিশোর গ্যাং এবং তাদের অপকর্ম সম্পর্কে আসা খবর দেখে প্রায় আঁতকে উঠতে হয়। কিশোর গ্যাং নামক এই দলগুলো আগাগোড়া সন্ত্রাসী দলের মত কর্মকাণ্ডে জড়িত তাই এদেরকে সন্ত্রাস বলা খুবই যৌক্তিক। ছোটোখাটো মারামারি আর চুরি ছিনতাইয়ে থেমে নেই এদের অপরাধ। বরং অহরহ খুন, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, মাদক সেবন, মাদক বিক্রি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই ইত্যাদির মত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে। বিশাল দলবল নিয়ে বাইক ইত্যাদির মাধ্যমে মহড়া দিয়ে ক্ষমতার প্রকাশ ঘটায়। চুরি, চাপাতি থেকে আগ্নেয়াস্ত্রও বহন করে এরা। সাধারণ চোখাচোখি নিয়েও মারামারি করে কিশোর গ্যাং। আর সিনিয়র জুনিয়র দ্বন্দ্বে প্রাণ গেছে অনেক কিশোরের। এহেন অপকর্ম নেই যা এই সকল গ্যাং করে না।
এবার প্রশ্ন হলো কেন এই কিশোর গ্যাং তৈরি হচ্ছে? কোনো একক কারন নয় বরং অসংখ্য কারনের সমন্বয়ে তৈরি হয় এই কিশোর গ্যাং। তবে মূল কিছু কারনের মধ্যে আছে রাজনৈতিক আশ্রয় এবং আইন প্রয়োগের অভাব।
রাজনীতি কিশোর গ্যাং তৈরি এবং টিকে থাকার নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। রাজনীতি শব্দটিই এখন মানুষজন নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করে। তাই রাজনীতির হাল হকিকত নতুন করে বোঝানোর কিছু নেই । অর্থ আর ক্ষমতার লড়াই যখন গ্রাস করেছে দেশের রাজনৈতিক প্রাঙ্গণ তখন বাদ পড়ছে না কিশোর সমাজও। কিশোরদের মধ্যেও ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে ক্ষমতা আর অর্থের লোভ। এভাবেই জীবনে বড় হতে হয় এমন এক ভ্রান্ত ধারনায় আক্রন্ত হয়ে পড়েছে এ সকল কিশোর। আর রাজনৈতিক নেতাদের নেতিবাচক ভূমিকা এখানে সবচেয়ে বেশি। গ্যাংগুলোর সদস্যরা সকলে সরাসরি রাজনীতির সাথে জড়িত না হলেও তারা সকলেই কোন না কোন রাজনৈতিক বড়ভাইয়ের ছত্রছায়া পেয়ে থাকে। এ সকল বড় ভাইয়েরা নিজেদের দলভারী করার প্রতিযোগিতায় প্রশ্রয় দেন কিশোর অপরাধীদের, বিনিময়ে মিছিল মিটিংয়ে চা পানির খরচ দিয়ে এদের নিয়ে যাওয়া হয়। যখন এলাকার মধ্যে কোন অপরাধ এরা করে তখন আইন শৃঙ্খলার বাহিনীকে সহায়তা না করে প্রচলিত মিউচুয়াল, মীমাংসা নামক পদ্ধতির অপব্যবহার করেন বড়ভাইয়েরা। অনেক সাধারন মানুষ আক্রান্ত হয়েও পুলিশি সহায়তা নিতে ভয় পান এই ভেবে যে এদের পেছনে অনেক বড় রাজনৈতিক শক্তি আছে ফলে আরও বড় সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। তাই পুলিশ প্রশাসনও কোন ব্যবস্থা নিতে পারে না। তবে সাধারণ জনগনের শঙ্কাও একেবারে মিথ্যা নয়, ঐতিহাসিক কারনে আমজনতা পুলিশকে বিশ্বাস করতে পারে না। আর বারবার অপরাধ করেও রেহাই পেয়ে আরও বড় অপরাধ করার সাহস পায় তারা। অর্থাৎ দেশের রাজনীতি এক খারাপ উদাহরণ রেখে যাচ্ছে এই কিশোর বা তরুণদের সামনে।
সমাজ এবং পরিবারের ব্যর্থতাও আছে এই অপরাধী তৈরি হওয়ার পেছনে। এসকল কিশোর গ্যাংয়ের অধিকাংশ ছেলেপেলে নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসে। আর্থসামাজিক কারনেই সন্তানের খোঁজ খবর রাখার সুযোগ হয়ে ওঠে না। তবে মধ্যবিত্ত, উত্তবিত্তদের সন্তানেরাও এদের সাথে যুক্ত হয়। যতই খেয়াল রাখা হোক না কেন, একটা সময় সন্তানকে একা ছাড়তেই হয়। কিন্তু পঁচে যাওয়া সমাজের কবলে পড়ে সাধারণ কিশোররা হয়ে ওঠে গ্যাং এর সদস্য।
অনেক ছেলেপেলেই অস্তিত্ব সংকটে ভুগে এই সকল দলে যোগ দেয়। তারা এভাবে নিজেদের নিরাপত্তা বিধান করতে চায় এবং একসময় হয়ে ওঠে সন্ত্রাসী। লাঞ্চিত হবার পরেও অনেকে গ্যাং সদস্য হয়।
আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সমাজ বিজ্ঞানী, মনস্তত্ত্ববিদ প্রমুখরাও উক্ত কারণগুলোর ওপরেই জোর দিয়েছেন। তবে কারন বের করা সহজ হলেও সমধান অতি জটিল। তবে এই বিষয়টাকে যদি এখানেই থামানো না যায় তবে খুবই ভয়ংকর পরিস্থিতির সামনে পড়বে সাধারণ মানুষ তথা দেশ।
উপরে যেগুলো লেখা হয়েছে সেগুলো সবই আমরা জানি, কারন সহসা আমরা এ সকল বিষয় প্রত্যক্ষ করি। নিজেই বেশ কয়েকবার কিশোর অপরাধীদের দ্বারা লাঞ্চিত হয়েছি। এসব ভয়ানক অভিজ্ঞতা আমার মনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, আবারো লাঞ্চিত হওয়ার ভয় আমাকে প্রতিনিয়ত তারা করে বেড়ায়। বিষণ্ণতা আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে আমায়, বেঁচে থাকাই যেন দায় আজ। স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্নে বদলে গেছে। এমন অনেক ভুক্তভোগী আছে যারা আমার মতই মানসিক পীড়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নিপীড়িতদের হয়ে সকলের প্রতি অনুরোধ এই যে, সরল প্রাণগুলো বাঁচান।