অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশটা কিন্তু দেখতে এমনই!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
এক সাগর রক্তের দামে কিনে নেয়া এই বাংলাদেশ যতটা শরীফুল ইসলাম বিজয়ের, ততটাই বিজয় ঘোষের। এই বাংলাদেশে বিজয় ডি কস্তার যতটা অধিকার, ঠিক ততটাই অধিকার বিজয় বড়ুয়া কিংবা বিজয় মংয়েরও...
ব্যস্ত রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে একজন নারী বলছেন তিনি নাকি বিজয়। স্যুটেট ব্যুটেড হয়ে কর্পোরেট সাজে সজ্জিত এক তরুণও নিজেকে বিজয় হিসেবে দাবী করছেন। সবুজ পাহাড়ের কোমলতা গায়ে মেখে রোদ্রস্নানরত আদিবাসী এক তরুণও বলছেন, তিনিই বিজয়! পাঁচজন মানুষ, আলাদা বয়সের, আলাদা গোত্রের, আলাদা ধর্মের, আলাদা লিঙ্গের, আলাদা জাতিসত্তার, এক কেবল তারা একটা জায়গায়, সেটার নাম বিজয়।
বিশেষ দিবসগুলোতে ব্যতিক্রমী বিজ্ঞাপনচিত্র বানানোর রীতিটা পুরনো। বিজয় দিবস উপলক্ষেও বেশ কিছু ভালো টিভিসি এবং ওভিসি আমরা পেয়েছি বিগত বছরগুলোতে। দেড়-দুই মিনিটের একটা বিজ্ঞাপনে চমৎকার একটা গল্প বলার পাশাপাশি চমৎকার মেটাফোরের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িকতা আর ভেদাভেদকে দূর করাটা ভীষণ চ্যালেঞ্জিং একটা কাজ। সিটি গ্রুপ বাংলাদেশের ব্র্যান্ড তীরের জন্য বানানো বিজয় দিবসের বিশেষ বিজ্ঞাপনে সেই কঠিন চেষ্টাটারই সফল একটা রূপ দেখা গেল।
পাঁচজন পৃথক মানুষকে নিয়ে এগিয়েছে হয়েছে বিজ্ঞাপনের গল্পটা। একজন নারী, একাত্তরে যিনি বাবাকে হারিয়েছেন, যুদ্ধে যাওয়ার আগে গর্ভবতী স্ত্রীকে যিনি বলে গিয়েছিলেন- 'ছেলে হোক বা মেয়ে, নাম বিজয় রাখবা!' বাবা ফিরে আসেননি আর, স্বাধীন দেশে বেড়ে উঠেছেন বিজয় ডি কস্তা। আরেকজন বিজয় ঘোষ, বাংলাদেশের বয়স আর তার বয়স প্রায় সমান। একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনী যখন রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করছে, সেদিনই তিনি পৃথিবীর আলো দেখেছেন, তাই তার নাম বিজয়।
আরও তিনজন বিজয় আছেন বিজ্ঞাপনে, একজন বিজয় বড়ুয়া, একজন শরীফুল ইসলাম বিজয়, শেষের জন বিজয় মং। সবারই জন্মের সঙ্গে বিজয় দিবস জড়িয়ে আছে কোনো না কোনোভাবে, সবাই তাই বিজয়। কিন্ত মানুষগুলো আলাদা, আলাদা তাদের গায়ের রঙ, তাদের মুখের বাচনভঙ্গি, ধর্ম, লিঙ্গ, সবকিছুতেই। তারা এক কেবল বিজয়ে। তারা একটা জায়গায় এক- তারা বাংলাদেশী, তারা এদেশের গর্বিত নাগরিক। ষোলোই ডিসেম্বরের এই দিনটা এই পাঁচজনের জন্যেই স্পেশাল, যেমনটা স্পেশাল আঠারো কোটি বাংলাদেশীর জন্য।
একাত্তরে খুব জনপ্রিয় একটা শ্লোগান ছিল- বাংলার হিন্দু বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বৌদ্ধ বাংলার মুসলমান, সবাই আমরা গর্বিত বাংলাদেশী। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার শপথ নিয়ে পাকিস্তানী জান্তা সরকারের কবল থেকে দেশটাকে স্বাধীন করেছিল আমাদের পূর্বপুরুষেরা। সেই বাংলাদেশ আমরা গড়তে পারিনি পুরোপুরি, এখনও দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প আছে, আছে ধর্মের ভেদাভেদ, আছে পাহাড় আর সমতলের মানুষের মানসিক দূরত্ব। আমরা ভুলে যাই, সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে ভালোবাসে পাশাপাশি থাকব বলেই দেশটা স্বাধীন হয়েছিল।
এই দেশটাকে জন্ম দেয়ার জন্য একাত্তরে মুসলমানেরা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন, বন্দুক ধরেছেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই। পাহাড়ের মানুষ, যারা এই ভূমির আদিম অধিবাসী, তারাও পাকিস্তানীদের নৃশংসতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন, তারাও অস্ত্র ধরেছেন, রেখেছেন যথাসাধ্য অবদান। মুক্তিযুদ্ধটা শুধু মুসলমানের ছিল না, শুধু হিন্দুর ছিল না, শুধু বাঙালির ছিল না। ছিল এই ভূখণ্ডে বসবাসরত প্রতিটি মানুষের। এক সাগর রক্তের দামে কিনে নেয়া এই বাংলাদেশ যতটা শরীফুল ইসলাম বিজয়ের, ততটাই বিজয় ঘোষের। এই বাংলাদেশে বিজয় ডি কস্তার যতটা অধিকার, ঠিক ততটাই অধিকার বিজয় বড়ুয়া কিংবা বিজয় মংয়েরও।
এই ব্যাপারটাই যে এত চমৎকারভাবে মাত্র দুই মিনিট সময়ের মধ্যে একটা বিজ্ঞাপনে তুলে আনা সম্ভব হতে পারে, সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে। কর্পোরেট ব্র্যান্ডগুলো বিজ্ঞাপনে অসাম্প্রদায়িকতা বা সাম্যতার কথা বললেও, গভীরভাবে এই চেতনার কথা বলার ঝুঁকিটা তারা নিয়েছে খুব কমই। তীরের বিজয় দিবসের বিজ্ঞাপনটা এজন্যেই আলাদা। তারা গল্পটার গভীরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে দর্শককে। পাঁচজন আলাদা মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের সুতোয় গেঁথে বিজয় নামের মালা বানিয়েছে, যে মালায় প্রতিটি ফুল একই রকমের সুবাস ছড়ায়, প্রত্যেকেই যেখানে সমান গুরুত্বপূর্ণ, সমান অংশীদার। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চমৎকার একটা মানচিত্র হয়ে রইলো যেন তীরের এই বিজ্ঞানপনটা, দুই মিনিটে আবেগের স্রোত গায়ে কাঁটা দিলো কয়েক দফা।
তীরের জন্য দুই মিনিট চার সেকেন্ডের চমৎকার এই বিজ্ঞাপনটি নির্মাণ করেছে বিজ্ঞাপনী সংস্থা পিংক ক্রিয়েটিভ, নির্মাতা জে এ শিশির। বিজয় দিবসে ভেদাভেদ দূরে ঠেলে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার যে চেষ্টাটা তারা করেছেন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে, এই চেষ্টাটাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। শুধু বিনোদন দেয়ার বা দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা না করে প্রতিটি ব্র্যান্ড এভাবেই পজিটিভ মেসেজ নিয়ে নিয়মিত গল্পনির্ভর বিজ্ঞাপন নির্মাণে আগ্রহী হবে, এরকমটাই আশা থাকবে সবার কাছে।
বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে বানানো তীরের এই বিশেষ বিজ্ঞাপনটি দেখুন এখানে-