ছবিতে যে ছেলেটিকে দেখছেন, বয়স মাত্র ১১ বছর। জীবনের চঞ্চলতা সবে মাত্র শুরু। কতো স্বপ্ন, কতো আশা। তার সাথে মিশে আছে পরিবারের ভালোবাসা। সামনে পুরোটা জীবন পড়ে রয়েছে তার। এক কবিরাজের কেরামতিতে ধ্বংস হয়ে গেছে তার সুস্থ জীবন।

ছবিতে যে ছেলেটিকে দেখছেন, বয়স মাত্র ১১ বছর। জীবনের চঞ্চলতা সবে মাত্র শুরু। কতো স্বপ্ন, কতো আশা। তার সাথে মিশে আছে পরিবারের ভালোবাসা। সামনে পুরোটা জীবন পড়ে রয়েছে তার। এক কবিরাজের কেরামতিতে ধ্বংস হয়ে গেছে তার সুস্থ জীবন।

ছেলেটি যখন আমাদের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের জরুরী বিভাগে এলো তখন শুধু তাকিয়ে ছিলাম ছেলেটার চোখের দিকে। তার চোখে কোনো অভিযোগ ছিলো না, ছিলো না কোনো রাগ, অভিমান। যে হাত দিয়ে মানুষ তার জীবনের স্বপ্ন বুনে কিছুক্ষণ পরে সে ডান হাতটিই কেটে ফেলা হবে।

সেটা জেনেও তার মধ্যে কোনো ভয় ছিলো না। ছিলো এক ধরণের ভয়াবহ নির্লিপ্ততা। কারণ সে বুঝে গেছে তার অভিযোগ, অনুযোগ, অভিমান, রাগ, কষ্টের কোনো দাম নেই এই সোনার বাংলাদেশে। চোখের সামনে নিজের জীবনটাকে ধ্বংস হয়ে যেতে দেখেও, কিচ্ছু করার নেই তার। এটাই এদেশের বাস্তবতা। আর কতো জীবন নষ্ট হলে এ বাস্তবতা বদলাবে?

এই অসহায়ত্বের শেষ কোথায়? 

যে মানুষরূপী জানোয়ারের জন্য আজ ছেলেটার এ অবস্থা, সে তার এলাকার কবিরাজ (Traditional Bone Settler)। এই বাচ্চাটার জীবন শুরু হবার আগেই যে শেষ করে দিয়েছে, তার একটা চুলও কেউ ছিঁড়তে পারবে না কেউ। তার মা, বাবা-ই বাঁচাতে পারেনি তাকে, খোদ রাষ্ট্রেও পারেনি, কারণ এর প্রতিকার করবার ইচ্ছাটাও কারোই নেই।

বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে-শহরে পল্লী চিকিসক নামে, কবিরাজ নামে, ফার্মাসিওয়ালা নামে এরা চিকিৎসা চালাচ্ছে। কোনো প্রকার শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়া, সরকারের প্রতিটি আইন ও স্বাস্থ্য নীতিমালাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, এবং বিএমডিসি এর সকল নীতিমালা ভঙ্গ করে গ্রাম কিংবা শহরের জনসাধারণের উপর চিকিৎসার নামে চলছে এ অত্যাচার। ঝাড়ফুঁক, কবিরাজি ঔষধ, তাবিজ কবজ বা মুখস্থ তিন বেলা এন্টিবায়োটিকের কোর্সের নামেই চলছে উন্মুক্ত গুন্ডামি।

তাদের বিচার করা তো দূর, আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়েই কূল পাচ্ছে না মানবকূল। এরা থাকে সবার ধরা ছোঁয়ার বাইরে, তাদেরকে স্পর্শ করার কারো সাহস নেই। এর কোনো প্রতিকার নেই, বিচার নেই আমাদের সমাজে, দেশে। কপালের দোষ দিয়ে সবকিছু মেনে নেয়াটা আমাদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে এখন।

ছেলেটির ডান হাতের এক্স-রে রিপোর্ট

প্রায়ই ঐ অমানুষদের শিকার এই মানুষদেরকে সু-চিকিৎসা দিতে গিয়ে কেটে ফেলতে হয় হাত, পা। থমকে যায় এক একটি ভুক্তভোগীর জীবন। আমরা শুধু উটপাখির মতো মাথা গুঁজে রাখি। কোথাও স্থান পায় না এই খবর। না কাগজে, না আমাদের মনে, না বিবেকে। এসব খবরে কোনো গ্ল্যামার নেই। আছে শুধু যন্ত্রণা। আর বিচার? সে তো আমাদের দেশে অতিথি পাখি। তার নিস্তব্ধ যন্ত্রণা দেখতে দেখতে একটা সময় মনে হলো, ছেলেটি হয়তো বুঝে গেছে তার পাপ কী! এদেশে জন্মানোই তার আজন্ম পাপ!

কৃতজ্ঞতা: হাসিব উজ জামান, রেসিডেন্ট, ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ট্রমাটোলজি এন্ড অর্থপেডিক রিহ্যাবিলেটেশন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা