শুভ জন্মদিন, নিকোলা টেসলা। প্রাপ্তির খাতা শূন্য থাকার পরেও এই ক্লান্তিকর লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্যে, এক অসাধারণ জীবন-গল্পের জন্য এবং অবশ্যই অজস্র বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের অনুপ্রেরণা হওয়ার জন্যে।

ইলন মাস্কের 'টেসলা মোটরস' নিয়ে আমরা মোটামুটি সবাই মাতামাতি করি। এবং সারা বিশ্বে এই মোটর কোম্পানিকে নিয়ে এরকম আদিখ্যেতার অন্যতম কারণ, 'টেসলা মোটরস' এর অসাধারণ প্রযুক্তির ব্যবহার। বিষয়টা এমন একটা পর্যায়ে চলে গিয়েছে, আরেক বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান 'জেনারেল মোটরস' নাকি একটা টাস্কফোর্সই বানিয়ে রেখেছে, যাদের অন্যতম প্রধান কাজ- 'টেসলা মোটরস' সামনে কী প্রোডাক্টস নিয়ে আসবে, তা নিয়ে গবেষণা করা!

যাই হোক, আজকের গল্প 'টেসলা মোটরস' নিয়ে না, আজকের গল্প এই 'টেসলা মোটরস' এর 'টেসলা' সাহেবকে নিয়ে। যিনি প্রয়াত হবার পরেও তাকে বিনম্রচিত্তে স্মরণ করে শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে, মার্টিন এবারহার্ড, মার্ক টারপেনি নামের দুই মানুষ গড়ে তোলেন টেসলা মোটরস। সার্বিয়ান আবিষ্কারক নিকোলা টেসলার জন্মদিন আজকে। আজকে তাই তাকে নিয়েই কলম চলুক।

বড় পরিবারের কৌতূহলী বালক

টেসলার জন্ম ১৮৬৫ সালের ১০ জুলাই স্মিলিয়ান (বর্তমানে ক্রোয়েশিয়া) নামের একটি গ্রামে। পরিবারে বাবা মিলুতিন টেসলা, মা ডুকা টেসলা ছাড়াও ছিলেন পাঁচ ভাই-বোন। টেসলা ছিলেন চতুর্থ সন্তান। বাবা ছিলেন ধর্মযাজক, তা সত্বেও তিনি টুকটাক বিভিন্ন জিনিসপত্র বানাতেন, কিশোর টেসলাও বাবাকে দেখেই আস্তে আস্তে বিভিন্ন জিনিস বানানোর জন্যে আগ্রহী হন। তাছাড়া টেসলার স্মৃতিশক্তি ছিলো অসাধারণ, টেসলা দাবী করতেন, এই প্রখর মস্তিষ্কের বিষয়টি এসেছে তাঁর মা থেকে।

পড়াশোনা করেছেন সিমিলজান, গোসপিক এবং কারলোভাক এর বিভিন্ন স্কুলে। কারলোভাকের স্কুলটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই স্কুলটিতেই পদার্থবিজ্ঞানের এক শিক্ষক তাকে পদার্থবিজ্ঞানে আগ্রহী করে তোলেন। তাছাড়া ক্যালকুলাসের বিরাট বিরাট অঙ্ক তিনি মনে মনে করে ফেলতেন। এ সব কারণেই হয়তো চার বছরের বিদ্যালয় জীবন তিনি তিন বছরে শেষ করেন।

যাযাবর টেসলা

১৮৭৪ সালে টেসলা অস্ট্রিয়-হাঙ্গেরীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৮৭৫ সালে অস্ট্রিয়ার গারাজে সেনাবাহিনীর একটা বৃত্তি পান। কঠোর পরিশ্রম করে পড়াশোনা করতেন টেসলা। রবিবার এবং ছুটির দিনগুলো ছাড়া বাকি দিনগুলোতে ভোর তিনটা হতে রাত এগারোটা পর্যন্ত পড়াশোনা করতেন। এতটাই পরিশ্রম তিনি করতেন যে, অনেকে আশঙ্কা করেছিলেন, এভাবে চলতে থাকলে টেসলা বেশিদিন বাঁচবে না। 

এরকম পরিশ্রমী, মেধাবী ছাত্রই কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে তাঁর বৃত্তি হারান। জুয়া খেলায় আসক্ত হয়ে পড়েন। ক্রমশ অবস্থা আরো খারাপ হয়। তৃতীয় বর্ষে এসে অবস্থাটা এমন দাঁড়ায় যে, টেসলার ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে যায়, তাকে বের করা দেয়া হয় কলেজ থেকে। টেসলা তখন বাক্সপ্যাটরা গুছিয়ে বাড়ি চলে আসে। এই ঘটনা টেসলার মনে ক্ষত তৈরী করে। পরবর্তীতে এই মানুষটাই আর পড়ালেখাই করতে চাননি। ১৮৭৮ সালে ঘর, পরিবার ছেড়েছুড়ে মারিবর চলে যান।

যাযাবর জীবনের শুরুটা এভাবেই। সারাদিন রাস্তায় কার্ড খেলতেন আর মারামারি, হাতাহাতি করতেন। এভাবেই দিন চলছিলো। এরমধ্যে টেসলা'র বাবা একদিন এসে ছেলেকে ফিরিয়ে নিতে চান বাসায়। কিন্তু টেসলা আসেন না। পরবর্তীতে টেসলা অবশ্য আবার বাড়িতে ফেরেন। পড়াশোনাও শুরু করেন। বয়স্ক ছাত্র হিসেবে। যদিও পড়াশোনায় খুব বেশিদূর যেতে পারেননি আর।

বন্ধু তুমি, শত্রু তুমি

টমাস আলভা এডিসনের সাথে টেসলার সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে চাইলে বেশ টানটান থ্রিলার সিনেমা বানানো যাবে। প্রতিভাবানদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সবসময়ে কিছু না কিছু দ্বৈরথ লেগেই থাকে, সেটা নতুন কিছু না। কিন্তু সেই দ্বৈরথকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন এডিসন ও টেসলা। সেটাই বলছি এখানে।

১৮৮২ সালে ফ্রান্সে এডিসন এর কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন টেসলা। এডিসন তখন বিশাল কেউকেটা। বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করে বিজ্ঞানের হালচালই পালটে দিয়েছেন। সবার মুখে তার প্রশংসা। নাম হয়ে গিয়েছে- আলোর পুরুষ। সেই এডিসন অবশ্য তার আবিষ্কৃত বাতি নিয়ে সন্তুষ্ট নন। কারণ, তার বাতি চলে ডিসি কারেন্ট বা ডিরেক্ট কারেন্টে। মোবাইল, টর্চগুলোতে যে ড্রাই সেল সেগুলো ডিসি কারেন্ট। এই কারেন্ট দিয়ে খুব বড়সড় ডিভাইস চালানো যেতো না। এডিসন এটা জানতেন। কিন্তু তিনি জানতেন না এসি কারেন্ট নিয়ে।

ওদিকে টেসলা কাজ করতেন এসি কারেন্ট বা অলটারনেটিং কারেন্ট নিয়ে। যেটা এখন আমরা সবাই ব্যবহার করি, ঘরবাড়ি-অফিস আদালতে। টেসলা বুঝেছিলেন, এসি কারেন্টই দুনিয়া শাসন করবে এক সময়ে এসে। এই বিষয়টা পরে যখন জানতে পারেন এডিসন, টেসলার সাথে তাঁর দ্বৈরথ তখনই শুরু হয়।

যাই হোক, এডিসনের কোম্পানিতে ফিরি আবার। যেখানে কাজ করছেন টেসলা। এডিসন টেসলাকে জব্দ করার জন্যে বলেন, একটা ভালো মানের বৈদ্যুতিক বাতির মডেল আবিষ্কার করে দিতে, যেটা ডিসি কারেন্টে ভালো কাজ করবে। যদি টেসলা পারেন, তাহলে তাকে পঞ্চাশ হাজার ডলার দেয়ারও প্রতিশ্রুতি দেন এডিসন। এডিসন ভেবেছিলেন টেসলা পারবেন না। তাই বড় এই অঙ্কের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। কিন্তু টেসলা গরীব মানুষ। তার কাছে পঞ্চাশ হাজার ডলার বিশাল বড় সংখ্যা। এই টাকাটা পাওয়ার জন্যে তিনি আদাজল খেয়ে লাগেন। অমানুষিক পরিশ্রম করে একটা মডেল দাঁড় করিয়েও ফেলেন। কিন্তু এডিসন তাকে পঞ্চাশ হাজার ডলার আর দেয় না। জানিয়ে দেয়- এটা কথার কথা ছিলো। আগে টেসলার মাসিক বেতন ছিলো ১৮ ডলার। সেখান থেকে বাড়িয়ে ২৮ ডলার করা হয় শুধু।

এখানেই গল্প শেষ না! এরপর টেসলা রাগে, দুঃখে চাকরী ছেড়ে দেন। পরবর্তীতে জর্জ ওয়েস্টিং হাউসের সাথে পরিচয় হয় তাঁর। যিনি ছিলেন এডিসনের আরেক রাইভাল। শত্রুর শত্রু, আমার বন্ধু। এভাবেই টেসলা আর হাউস একত্রিত হন। এসি কারেন্ট নিয়ে কাজ শুরু করেন দুইজনে। সাফল্য আসা শুরু হয়, এসি কারেন্ট এর গ্রাহক বাড়ছিলো বানের জলের মতন। তখনই আবার মঞ্চে এসে উপস্থিত হন এডিসন।

নড়েচড়ে বসতে হবে এবার সবার। গল্প ক্লাইম্যাক্সে ঢুকছে এখন। এডিসন জানতেন, এসি কারেন্ট এভাবে সফল হলে ডিসি কারেন্ট'কে কেউ গুরুত্ব দেবে না। তাই মানুষজনকে 'এসি কারেন্ট' থেকে দূরে রাখার জন্যে তিনি একটা স্টান্টবাজি করলেন। ১৮৮৮ সালে যুক্তরাষ্টের ম্যানহাটনে আসেন এডিসন। একটা কুকুর নিয়ে আসেন সাথে। কুকুরের গায়ে জড়িয়ে দেন বিদ্যুতের তার। তারপর তারে দেন বিদ্যুৎ সংযোগ। শক পেয়ে তীব্র আর্তনাদ করে মারা যায় কুকুরটা। প্রচুর মানুষ জমেছিলো সেদিন। সাথে বড় বড় পত্রিকার সাংবাদিকেরাও ছিলেন। এডিসনের এই এক্সপেরিমেন্টের উদ্দেশ্য ছিলো, এসি কারেন্টের ভয়াবহতা মানুষকে বোঝানো। এসি কারেন্ট ব্যবহার করলে মানুষ যে মরে যেতে পারে যেকোনো সময়ে, সেটাই তিনি বোঝাতে চাইলেন মানুষকে।

এই স্টান্টবাজিতে কাজ হলো। মানুষজন ভয় পেলো এসি কারেন্ট ব্যবহার করতে। দুম করে টেসলার 'এসি কারেন্ট' এর সাকসেস আবার মুখ থুবড়ে পড়লো, লেজকাটা ঘুড়ির মতন। এডিসন আবার বাজিমাত করলেন!

শেষ জীবন ও আক্ষেপ

এডিসনের এই শঠতার পরেও টেসলা দমে যাননি। নিজের মত করে আবিষ্কারের চেষ্টা বরাবরই করে যেতেন। সে কারণেই হয়তো, তাঁর নামের পাশে রয়েছে হাজারের উপরে প্রোডাক্টের পেটেন্ট। যদিও হতভাগ্য টেসলার কপাল থেকে অনেক পেটেন্টেরই নাম ছুটে গিয়েছে, সেগুলো দখল করেছে অন্য কেউ। তা নিয়ে খুব একটা হাহুতাশ করেননি তিনি। তিনি তাঁর মত মেতেছিলেন, তাঁর কাজে। শেষদিক এসে টেসলা তারবিহীন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ওয়ারলেস যোগাযোগ নিয়েও বেশ গবেষণা শুরু করেছিলেন। ওয়ারলেস নিয়ন্ত্রিত প্রথম নৌকাও তিনি তৈরী করেন।

'এসি কারেন্ট' এর ব্যবসা থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন, সেগুলো আবার খরচ করতেন বিভিন্ন গবেষণার কাজে। শেষ বয়সে এসে হোটেলে জীবনযাপন শুরু করেন। এবং সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। যদিও অনেকে বলেন, মৃত্যুকালে হোটেলের বিল পরিশোধ করার মতও তাঁর টাকা ছিলো না। মানেটা দাঁড়ায়, শূণ্য থেকে শুরু করে আবার সেখানে গিয়েই শেষ করেন জীবন-অধ্যায়।

শেষ কথা

সার্বিয়ান-আমেরিকান উদ্ভাবক 'নিকোলা টেসলা'র জীবন থেকে সবচেয়ে অসাধারণ যে বিষয়টি আমরা দেখি, তিনি কখনোই দমে যাননি। এডিসনের কপটতাই বলা হোক বা কপর্দকশূন্য হয়ে জীবনযাপন- বিজ্ঞানের জন্যে ভালোবাসা তিনি জিইয়ে রেখেছিলেন নিজের ভেতরে, অজস্র ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যেও। জীবনে কখনো দুই ঘন্টার ওপরে ঘুমাতেন না একদিনে, তাছাড়া আইনস্টাইনসহ সমসাময়িক অন্যান্য বিজ্ঞানীদের সাথে ছিলো বেশ ভালো সম্পর্ক। শেষ বয়স পর্যন্ত।

অগুনতি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার থাকার পরেও সেগুলো ক্রমাগত অন্যের হাতে চলে গিয়েছে, তবুও হাল ছেড়ে দেননি। নিজের মতো করে সময়ের আগে এসে ভেবেছেন। সভ্যতা-পরিবর্তনকারী প্রযুক্তি তুলে দিয়েছেন মানুষের হাতে। ব্যক্তিগত জীবনে কোনোদিন বিয়ে করেননি। পুরো জীবনটাই নিবেদন করেছেন বিজ্ঞানের জন্যে। এ কারণেই মৃত্যুর এত বছর পরে এসেও তাঁর নামে 'টেসলা মোটরস' গড়ে উঠতে দেখে আমরা চমকিত হই না। মুচকি হেসে ভাবি- এরকমটাই তো হওয়ার কথা ছিলো।

শুভ জন্মদিন, নিকোলা টেসলা। প্রাপ্তির খাতা শূন্য থাকার পরেও এই ক্লান্তিকর লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্যে, এক অসাধারণ জীবন-গল্পের জন্য এবং অবশ্যই অজস্র বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের অনুপ্রেরণা হওয়ার জন্যে।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা