অবশেষে রিটায়ার করলেন আন্ডারটেকার। ধন্যবাদ আমাদের শৈশবকে এভাবে রাঙাবার জন্য। তিনি এমনই একজন রেসলার, বানানো গল্প জেনেও যার জন্য ঐ চারকোনা রিংটা ফাঁকা লাগবে আজীবন।

রেসলিং। শুধু এই একটা শব্দের সাথেই জড়িয়ে রয়েছে আমাদের অনেকের শৈশব। টিভিতে রেসলিং দেখে বড় হয়ছে একটা জেনারেশন। এবং এটা দেখা নিয় তারা এতোটাই সিরিয়াস ছিলো যে ‘ডোন্ট ট্রাই দিস এট হোম’ এটা পর্যন্ত বলে দেয়া হতো। তবুও জন্ম নিয়েছে নানা দুর্ঘটনা। এসব ছাপিয়ে আমাদের ছেলেবেলা রাঙিয়ে দিয়ে গেছে এই রেসলিং।

রেসলিং জগতের যে নামগুলো আমাদের বাধ্য করেছে তাদের একনিষ্ঠ ভক্ত হবার জন্য, তন্মোধ্যে অন্যতম দ্য আন্ডারটেকার। আমাদের স্কুলজীবনের সুপরাহিরো। সাত ফুট উচ্চতার এই মানুষটার নাম শুনলেই স্মৃতিকাতরতা চলে আসে। শুধু শিশু কিশোর নয়, প্রতিটা বয়সের মানুষের কাছেই বেশ পরিচিত নাম এটি। এমনকি যারা রেসলিং দেখেননি, তারাও তাকে চেনেন।

১৯৬৫ সালে আমেরিকার টেক্সাসে জন্ম নেয়া আন্ডারটেকারের আসল নাম মার্ক উইলিয়াম কালাওয়ে। মার্কের ইচ্ছে ছিলো বড় হয়ে বাস্কেটবল খেলোয়াড় হবেন। সে পথেই এগুচ্ছিলেন। নিজের স্কুল টিমের হয়েও খেলেছেন, তবে বাদ পড়ে গেছেন পার্ফরমেন্সের কারণে।

উচ্চতার সুবিধা থাকায় নাম লিখিয়েছিলেন বিভিন্ন রেসলিং ক্লাবে। প্রথমে সেখানেও সুবিধা করতে পারেননি। শরীরের আকার বড় হওয়ার অনেকেই তাকে বলতেন তিনি কখনো ভালো রেসলার হতে পারবেন না। জীবনের স্ট্রাগলিং পিরিয়ডে নজরে আসেন বিখ্যাত রেসলার হাল্ক হোগানের। হোগান তাকে নিয়ে যান ডাব্লিউসিসিডাব্লিউ এর চেয়ারম্যানের কাছে। তাকে দেখেই পছন্দ করে ফেলেন। উচ্চতার জন্য তার নাম দেয়া হয় ‘ডেড ম্যান’।

এই দৃশ্য দেখা যাবে না আর কখনও 

১৯৮৪ সালে রেসলিং এর ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। সেখানে টানা ছর বছর স্ট্রাগল করার পর নজর কাড়েন ওয়ার্ল্ড রেসলিং এন্টারটেইনমেন্টের কর্ণধার ভিন্স ম্যাকম্যানের। ম্যাকম্যান তার নিজের কোম্পানি জন্য চুক্তিবদ্ধ করেন ডেন ম্যানকে।

তৎকালীন ডাব্লিউডাব্লিউএফে ‘কেইন দ্য আন্ডারটেকার’ ছদ্মনামে রেসলিং শুরু করেন তিনি। ম্যাকম্যানের পরামর্শে নাম থেকে কেইন বাদ দিয়ে শুধু আন্ডারটেকার রাখা হয়। পরবর্তীতে কেইন নামে আরেকজন রেসলারের আগমন ঘটে। বানানো স্ক্রিপ্ট আর স্টোরিলাইনে দেখানো হয়েছে কেইন আর আন্ডারটেকার দুই ভাই। আর পল বিয়ারার তাদের বাবা।

ছোটবেলায় আন্ডারটেকার কেইনের মুখ পুড়িয়ে দিয়েছে, এমন নাটকীয় গল্পে ঠাসা স্ক্রিপ্টেড রেসলিং এ আমরা বুঁদ হয়ে থাকতাম। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাস্তব জীবনে কেইন এবং আন্ডারটেকার কিংবা পল বিয়ারের মাঝে রক্তের কোনো সম্পর্কই নেই। এই ব্যাপারটা আমরা অনেকেই জানিই না। এই হচ্ছে আমাদের রেসলিং ক্রেজ।

রেসলিং জগতে আন্ডারটেকারের অন্যরকম এক প্রতাপ ছিলো। তাকে মনে করা হতো অতিমানবীয় কেউ। সহজে হারানো যেত না তাকে। ডাব্লিউডাব্লিউএফ এর বর্নাঢ্য ক্যারিয়ারের প্রথম তিন বছরে কোনো ম্যাচই হারেননি এই কিংবদন্তি। এমনকি রেকর্ডসংখ্যক একুশটা রেসলমেনিয়াতে অপরাজিত ছিলেন।

তার বিশেষত্ব ছিলো তিনি ভিন্নধর্মী টার্মের ম্যাচ খেলতেন। তার মধ্যে হেল ইন এ সেল, বারিড এলাইভ, দ্য লাস্ট রাইড কিংবা কাস্কেট ম্যাচ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

মূলত দুইটা থিম স্টাইলে খেলতেন তিনি। দ্য ডেডম্যান এবং আমেরিকান ব্যাড অ্যাস। কালো হ্যাট, লং কোট, গ্লাভসে নিজে মুড়িয়ে রেখে একপ্রকার মরা মানুষের মতই আচরণ করতেন তিনি। এটা ছলো তার ডেড ম্যান স্টাইল ব্যাপারটাই ছিলো ব্যাপক আতঙ্কের। পুরো স্টেজের লাইট অফ হয়ে যেত, আর হরোর একটা মিউজিকের সাথে তার অশরীরী উপস্থিতি যে কেউকেই প্রচন্ড ভয়ে ফেলে দিতো। এমনকি তার প্রতিপক্ষরাও শঙ্কিত থাকতেন। এমনই এক ত্রাস তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি।  

তার আরেকটা স্টাইল ছিলো কপালে কাপড় বেঁধে জোশ একটা জিপসি বাইক নিয়ে স্টেইজে প্রবেশ করতেন তিনি। বাইকটাকে যেভাবে কয়েক পাক ঘুরিয়ে পার্ক করতেন, দেখতে আসলেই পুরো ব্যাড অ্যাসই লাগতো।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে হাল্ক হোগানের হাত ধরে রেসলিং জগতে প্রবেশ করেছিলেন, তাকে হারিয়েই লাইম লাইটে আসেন তিনি। একে একে তৎকালীন সব সুপারস্টারদের হারিয়ে দিতে থাকেন। এর মধ্যে আল্টিমেট ওয়ারিয়র, সার্জেন্ট স্লটার, ইয়োকোহুনা, কামালা, র‍্যান্ডি স্যাভেজ, ডাস্টি রোডসদের মতো লেজেন্ডরাও রয়েছেন। এরপর আরেক লেজেন্ড শন মাইকেলের ক্যারিয়ারই তো শেষ করে দিয়েছিলেন তিনি। এছাড়া ট্রিপল এইচ, দ্য রক, স্টোন কোল্ড স্টিভ অস্টিন, কেইন, বিগ শো, রিকিশিদের বলে কয়ে হারাতেন তিনি।  

টেক্সাসের যে এলাকায় তিনি থাকতেন সেই পুরো এলাকাটা কিনে নিয়ে নাম দিয়েছিলেন ডেথ ভ্যালি মানে ম্রত্যু উপত্যকা। এভাবেই নিজের চারপাশে একটা রহস্যময় অবয়ব তৈরি করে রাখতেন। স্ক্রিপ্টেড স্টোরিলাইন অনুযায়ী, কখনও ছিলেন হিরো, কখনও বনেছেন ভিলেন। তবুও কখনও তার জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র কমেনি। তার এন্ট্রির সাথে সাথে দর্শকদের উল্লাস সেই প্রমাণই দিয়েছে বারংবার।

ক্যারিয়ারে বেশ কয়েকবার ইঞ্জুর্ড হয়েছেন, গিয়েছেন রিটায়ারমেন্টে, আবার ফিরেছেনও। তবে এবার শেষ বিদায় জানিয়ে দিলেন। ডকুমেন্টারি সিরিজ “দ্য লাস্ট রাইড” এ অবসরের ঘোষণা করলেন এই কিংবদন্তী।

তিনি এমনই একজন রেসলার, যার জন্য ঐ চারকোনা রিংটা ফাঁকা লাগবে আজীবন। এগুলো সব বানানো গল্প, এটা জানার পরেও মনের ভেতর যে হাহাকার জেগে ওঠে সেই ব্যাপারটার সাথে কেউ যদি নিজে থেকে কানেক্ট না করাতে পারে, তবে শত চেষ্টা করে কাউকে বোঝানো যাবে না এই অনুভূতি।

ধন্যবাদ, প্রিয় আন্ডারটেকার! আমাদের শৈশবকে এভাবে রাঙাবার জন্য। টানা ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমাদের এন্টারটেইন করে গেছেন। যতদিন রেসলিং থাকবে, আপনার নামটাও উচ্চারিত হবে। কখনো কোনো পে-পার ভিউতে আচমকা আপনার সাথে সাময়িক দেখা হয়ে যাবে, এই কামনায় ভালোবাসা অবিরাম। তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম।  

আরও পড়ুন- এই হত্যার দায় দুই পরিবারকেই নিতে হবে!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা