নেভারল্যান্ড র‍্যাঞ্চ মানেই মাইকেল জ্যাকসন, দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষটা থাকতেন এই বাড়িতে। এমজে'র বিরুদ্ধে শিশুদের যৌন নিপীড়নের অভিযোগও ওঠে এখানেই। বহু স্মৃতি আর বিতর্কের সাক্ষী এই বাড়িটি সম্প্রতি বিক্রি হয়ে গেছে জলের দরে...

নাইন্টিজে আমরা যারা বড় হয়ে উঠেছি, আমাদের অনেকেরই শৈশবের স্মৃতির বাক্সখানি খুললে একটি জিনিসে তীব্র মিল পাওয়া যাবে; মাইকেল জ্যাকসনের ছবি-পোস্টার-কার্ড। শৈশবে আয়ের সংস্থান ছিলো সীমিত।  টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে, বৃত্তির টাকা থেকে কিছু টাকা সরিয়ে এরকম তারকাদের পোস্টার কেনার ঝোঁক ছিলো আমার, আমাদের। এমন না যে, মাইকেল জ্যাকসনের আপাদমস্তক আমাদের কন্ঠস্থ হয়ে গিয়েছিলো অথবা লোকটি আমাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতো সবসময়। কিন্তু, কেন যেন তাঁর নামটা শুনলে মনে হতো, তিনি বিদেশে থাকা আমাদের কোনো আত্মীয়। দূরের গ্রহের কোনো নক্ষত্র। আমাদের শৈশবে মাইকেল জ্যাকসন আসলে কোনো মানবসন্তানের নাম ছিলো না। এটি যেন ছিলো একটি মিথ।

শৈশবের এই সময়টুকু ভালো। অনেক কিছুই সরল মনে বিশ্বাস করে ফেলা যায়। বিপত্তি ঘটে, বয়সের ডায়েরিতে যখন আঁকিবুঁকি বাড়তে থাকে। অনেক কিছুই আর সরলরৈখিক মানসে বিশ্বাস করা সম্ভব হয় না। অনেক যদি, কিন্তু চলেই আসে সেখানে। তখন আরব্যোপন্যাস এর দৈত্য কে আর ভয় লাগে না। মনে হয়- ছেলেভুলানো গপ্প। মাইকেল জ্যাকসনের ক্ষেত্রেও বিষয়টা অনেকটাই সেরকম। আস্তে আস্তে  যখন লাউয়ের লতার মত বেড়ে উঠছি, জানাশোনা বাড়ছে, চোখের গণ্ডি বিস্তৃত হচ্ছে- আবিষ্কার করলাম, মাইকেল জ্যাকসনও আমাদের মতই একজন মানুষ। যার জীবনেও দুঃখ আছে, কষ্ট আছে, তেরোটা গ্রামি এ্যাওয়ার্ডের পাশাপাশি যন্ত্রণার এক শৈশবের গল্প আছে, রেকর্ড ভাংচুর করা একেকটা অ্যালবামের পাশাপাশি একাধিক প্লাস্টিক সার্জারির রহস্যময়তাও আছে। স্টেজে যে মানুষটি এত অপার্থিব, স্টেজের বাইরে তিনি ঠিক ততটাই সাধারণ রক্ত-মাংসের ক্যারিকেচার। বহু বিতর্কে জড়িয়ে এরপর তিনি প্রয়াত হলেন। মাইকেল জ্যাকসন আটকে গেলেন জন্মদিন আর মৃত্যুবার্ষিকীর চোরাস্রোতে। আমরাও ক্রমশ ভুলতে বসলাম তাকে।

আজ কেন মাইকেল জ্যাকসন নিয়ে এত কথা বলছি। সংবাদে দেখলাম- মাইকেল জ্যাকসনের বাড়ি 'দি নেভারল্যান্ড র‍্যাঞ্চ' বিক্রি হয়ে গিয়েছে। একটু বিষন্ন লাগলো। মুনীর চৌধুরীর সেই বিখ্যাত লাইন 'মানুষ মরে গেলে পঁচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়' মেনে মাইকেল জ্যাকসন আজ কফিনের কয়েক টুকরো হাড় ছাড়া আর কিছুই না। এটাই ভবিতব্য। মেনে নেওয়া ছাড়া উপায়ও বা কী! কিন্তু পৃথিবীর বুকে টিকে থাকা তাঁর স্মৃতির নিদর্শনগুলোও ক্রমশ দখল হয়ে যাচ্ছে, এই বিষয় একটু অন্যমনস্ক করে দিলো। স্মৃতির গোড়ায় হালকা একটু ধাক্কাও খেলাম যেন। 

মাইকেল জ্যাকসন ক্যালিফোর্নিয়ার লস অলিভসের এই বাড়িটি কিনেছিলেন ১৯৮৮ সালে। এই বাড়ির সাথে ছিলো পার্ক, চিড়িয়াখানা, মুভি থিয়েটার এবং ড্যান্স স্টুডিও। অসুস্থ শিশুরা নিয়মিতই এখানে আসতো এবং খেলাধুলা করতো। মাইকেল জ্যাকসনের নিজেরও বেশ পছন্দের জায়গা ছিলো এটি। তিনি নিজেও অবসরের অনেকটুকু সময় এখানে পার করতেন। কিন্তু ২০০৫ সালের পরে তিনি এই বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিলেন বেমালুম।

দ্য নেভারল্যান্ড র‍্যাঞ্চ! 

২০০৫ সালের দিকে গুজব রটে, যেসব অসুস্থ বাচ্চারা এই বাড়িতে কিছু সময় কাটানোর জন্যে আসতো, তাদের মধ্যে একজনকে যৌন নির্যাতন করেছেন মাইকেল জ্যাকসন। এজন্যে পরবর্তীতে তাকে কোর্টেও যেতে হয়। যদিও কোর্ট তাকে বেকসুর খালাস দেয়, কিন্তু এই অভিযোগ তার জনপ্রিয়তায় দেয় বড়সড় এক ধাক্কা। এরপর থেকেই নেভারল্যান্ড র‍্যাঞ্চের রাস্তায় পা বাড়ানো বন্ধ করে দেন মাইকেল জ্যাকসন।

২০০৯ সালে 'দ্য কিং অব পপ' মারা যাওয়ার পরে নেভারল্যান্ড র‍্যাঞ্চের ভৌত অবকাঠামোগত নানা পরিবর্তন আনা হয়। নেভারল্যান্ড র‍্যাঞ্চের নাম পালটে করা হয় সিকামোর ভ্যালি। এরপর বিক্রির জন্যে নিলামে তোলা হয়। মাইকেল জ্যাকসনের এক বন্ধু রন বার্কলে শেষমেশ কিনে নেন এই বাড়িটা৷

'চৌরঙ্গী'খ্যাত শঙ্করের একটি বিখ্যাত উপন্যাসের নাম 'ঘরের মধ্যে ঘর।' অনেকেই পড়েছেন। এই উপন্যাসে লেখক একটি সুন্দর  কথা বলেছিলেন-

প্রত্যেকটি বাড়ি একেকটি উপন্যাস। বাড়ির মালিক লেখক আর বাড়ির বাসিন্দারা চরিত্র। মালিক পালটে গেলে উপন্যাসের কাহিনী পালটে যায়। চরিত্র পালটে যায়।

'নেভারল্যান্ড র‍্যাঞ্চ' ছিলো মাইকেল জ্যাকসনের সেরকমই এক উপন্যাস। যে উপন্যাস বিক্রি হয়ে গিয়েছে অন্য এক মানুষের কাছে। প্রয়াত মানুষদের সব স্মৃতি বুঝি এভাবেই হাতবদল হয়ে যায়। সে মানুষটি মাইকেল জ্যাকসনই হোক অথবা অন্য কেউ, নিয়তির অমোঘ লিখন খণ্ডাতে কেউই আর পারে না কখনো!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা