শৈশবের বিকেলের আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে দিতাম। বরফ পানি নামে এক অদ্ভুত খেলা ছিলো। ছুঁয়ে দিলে বরফ এর মতো স্থির হয়ে যাওয়ার নিয়ম। শৈশবটা আজ বরফ পানির মতো স্থির হয়ে আছে...
মনে পড়ে আজ, মাঝে মধ্যে কটকটিওয়ালা আসতো আমাদের বাড়িতে। পুরনো কিছু দিলে তার বিনিময়ে তিনি কটকটি দিতেন। আমরা কুট কুট করে কটকটি খেতাম। কখনো এমন হয়েছে, পুরনো কিছু খুঁজে না পেয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ঘর থেকে প্রায় নতুন এমন কিছু নিয়ে এসে কটকটিওয়ালাকে দিয়ে দিতাম। ক্রিং ক্রিং করে বেল বাজলেই বুঝতাম আইসক্রিম এর গাড়ি এসেছে।
লাল-নীল সেসব আইসক্রিম খুব দামি ছিলো না। অনেক “ফ্লেভার” ছিল না। তবুও কি মোহে ক্রিং ক্রিং শব্দ হলেই ছুটে যেতাম তার কাছে। বাড়ির নববঁধু থেকে শুরু করে আমার বৃদ্ধ দাদুও বাচ্চাদের মতো করে আইসক্রিম খেতেন। আমার শৈশব এর কিছু বিকেল ছিলো। যেই দিনগুলোতে আমরা মার্বেল খেলতাম। লাটিম ঘুরাতাম।
শৈশবের বিকেলের আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে দিতাম। বরফ পানি নামে এক অদ্ভুত খেলা ছিলো। ছুঁয়ে দিলে বরফ এর মতো স্থির হয়ে যাওয়ার নিয়ম। শৈশবটা আজ বরফ পানির মতো স্থির হয়ে আছে, কোথা থেকে হুট করে আমরাই বড় হয়ে গেলাম। লোডশেডিংয়ের রাতে আমরা “পলান্তিস” খেলতাম। লুকিয়ে থাকবে সবাই, একজন সবাইকে খুঁজে বের করবে।
বড়বেলায় এসে আমি সেই একজন হয়ে গেছি। সবাই যে কোথায় লুকিয়ে গেলো আর খুঁজেই পাই না! “ক্রাশ” বলে কিছু ছিল না। মেয়েটা খুব একটা সাজে না। চোখে একটু কাজল দিলেই তাকে বড় মায়া করতে ইচ্ছে হতো। বিকেলের বেলকনিতে সে দাঁড়াবে বলে একটা অপেক্ষা ছিল। ফোন ফেসবুক কিছুই না, চ্যাটিং ডেটিং এর কথা মাথায় আসতো না। শুধু দীর্ঘ দিবস অপেক্ষা করে এক নজর দেখা পাওয়াটাই বিশাল ব্যাপার ছিল।
দীর্ঘ রজনীতে কাগজের পর কাগজ মেয়ের জন্য চিঠির কথাগুলো ভাবা, হাতের লেখা সুন্দর এমন কাউকে দিয়ে চিঠি লিখিয়ে নেয়া, এলোমেলো ছন্দের কবিতা লিখা তার জন্য। কিন্তু মেয়েটাকে কিছুই বলা হতো না সাহসের অভাবে। একদিন মেয়েটা জানিয়ে দেয়, “আমার বিয়ে ঠিক, এভাবে পেছনে ঘুরবেন না।“ এভাবে শৈশবের নির্মোহ প্রেমের কত গল্প আছে অলিতে গলিতে।
সাদা কালো একটা টিভি যার ঘরে ছিলো, শুক্রবারের দিনে তার ঘরে সবাই চলে আসতো। জানালার ফাঁক দিয়ে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা টিভি দেখতো। বাংলা সিনেমা দেখে সরল মানুষগুলো হু হু করে কেঁদে দিতো কখনো। ''আলিফ লায়লা'' আর “ইত্যাদি” দেখার জন্য কি যে ভীড়। একেকটা নাটক শুধু নাটক ছিলো না, যেন সাধারণ মানুষের প্রতিচ্ছবি। আহ! বিজ্ঞাপন। একটুও বিরক্ত লাগতো না। কী সুন্দর জিংগেল, কী ডায়লগ, কী অসাধারণ দরদ মাখা বিজ্ঞাপন ছিলো একেকটা!
একান্নবর্তী পরিবার শব্দটা হয়ত বুঝতাম না তখন। বিশাল এক পরিবারে সব চাচাতো ফুফাতো ভাই বোন মিলে হৈচৈ লাগিয়ে রাখার সেসব দিন ছিলো। একেকটা ঈদে সবাই মিলে চাঁদ দেখতাম। কুরবানির প্রথম গোশত দাদা বিরাট পাতিলে নিজে রানতেন। আমরা নিজের বাড়ি ছেড়ে পাশের বাড়িগুলোতে থাকতাম বেশি। আবার আমাদের বাড়িতে পাশের বাড়ির লোকজন দিয়ে গমগম করতো।
আমাদের ঘুম আসতো দাদির মুখে রাজা রানী আর চাঁদের বুড়ির গল্প শুনে। দাদা খুব ভালো শ্লোক বলতে পারতেন। কোথাও এখন কেউ নেই। শহরটা একেক বাক্সবন্দী খোপের মধ্যে বন্দী, যাকে ভদ্র ভাষায় এপার্টমেন্ট বলে থাকি আমরা। পাশের বিল্ডিংয়ের কেউ মারা গেলে সে খবর পর্যন্ত কানে আসে তিন দিন পর। দামি খেলনা কেনার সাধ্য বাবার তখনো হয়নি কিংবা বললে হয়তো পেতাম অনেক কিছুই। কিন্তু বাবাকে খুব ভয় পাই বলে মধ্যবিত্ত জড়তার কারণে আবদার করিনি। সব সময় মনে হয়েছে অর্জন করে নিতে হবে, চেয়ে নেয়া যাবে না। এই জন্য আমাদের মধ্যবিত্ত সংসারে কিছু অলিখিত চুক্তি থাকে।
বার্ষিক পরীক্ষায় ভালো করলে একটা বাই সাইকেল দেয়া হবে অথবা বড় মার্কেট থেকে নিজের ইচ্ছে মতো জামা কাপড় কিনে দেয়া হবে। কোনো পরীক্ষায় ভালো করলে বিশেষ খাবারের আয়োজন হবে অথবা কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হবে কিংবা কোনো খেলনা... এমনিতে অবশ্য খেলনার অভাব ছিলো না আমাদের। পাতার বাঁশি দিয়ে বেসুরা সুর তুলতাম, পাতার ঘড়িতে ভুল সময় দেখতাম আর পাতার চশমা বানিয়ে দেখতাম নীল আকাশ।
অনেক টাকা আমাদের ছিলো না। কিন্তু আমরা খেলতাম ধনী হবার মজার খেলা। আমাদের ছিলো পুতুল সংসার। মাঝে মধ্যে “ঝোলাবাতি”রান্না হতো। এই রান্নার উপকরণ ছিলো সব বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ আর চুরি করা। আমাদের ফেসবুক ছিলো দেয়াল। আজকে এই ক্রাশ যুগে সব কিছুই ফেসবুকে জানিয়ে দেয়া যায়। আমরা জানাতাম দেয়ালকে। প্রেমিকার নামের সাথে নিজের নামের প্রথম অক্ষর যোগ করে লিখে দিতাম দেয়ালে। ডি+এস !
আমাদের ফেসবুক ছিলো ডায়েরির পাতা। একটা সময় ডায়েরির কোনো এক পৃষ্ঠায় কবিতা লিখেনি, প্রিয় মানুষের নাম লিখেনি, মন খারাপের গল্প লিখেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যেতো না। আমাদের বন্ধু ছিলো বই। তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা, ফেলুদা, শার্লক হোমস এর সাথে সাথে বড় হয়েছি আমরা। পাঠ্য বই এর ফাঁকে গল্পের বই লুকিয়ে পড়ার মধ্যে অমানবিক আনন্দ ছিলো। কত সম্পর্ক সৃষ্টি হতো বই আদান প্রদান করতে গিয়ে। উপহার হিসেবে বই দেয়ার প্রচলনও ছিলো।
ছবি তোলা আমাদের জন্য ছিলো বিশাল ব্যাপার। কত আয়োজন করে নতুন জামা পড়ে স্টুডিও গিয়ে ছবি তুলতে যেতাম পরিবার এর সবাই। সেই ছবি প্রিন্ট করে আবার এলবাম করে সাজিয়ে রাখতাম। এখন আমাদের গ্যালারি ভর্তি এত এত ছবি যে সেই এলবাম এর আর মূল্যই নেই হয়ত। বর্ষার দিনগুলো আজকাল ঘরে বসে দেয়া স্ট্যাটাস এর চেয়ে ভালো ছিলো।
ফুটবল নিয়ে কাঁদার মধ্য গড়াগড়ি খেয়ে পুকুরে এসে ডুব সাঁতার দেয়া। কলা গাছের ভেলা ভাসিয়ে পানিতে ভেসে থাকতাম। শীতের দিনে খেজুরের রস আর নানান কিসিম এর পিঠার কি যে বিরাট আয়োজন দেখেছি ছোটবেলায়। গ্রীষ্মে আমাদের আম কাঁঠালের ছুটি ছিলো। সেই গরমে গাছে উঠে ডাব পেড়ে খাওয়া, আম গাছে ডিল ছুঁড়ে আম পাড়া ছিলো আমাদের কাজ। এখন আর ঘরে ঘরে কেউ তেমন পিঠা বানায় না। কেউ খেজুরের রস চুরি করে না। আম গাছে কেউ ডিল ছুঁড়ে না। সব টাকা দিয়েই কিনে ফেলা যায়।
আমাদের বিনোদন ছিলো বায়োস্কোপ। আমাদের বিনোদন ছিলো বিকেল তিনটার বাংলা ছায়াছবি। আমাদের আনন্দ ছিলো বিটিভির প্যাকেজ নাটকে। আমাদের আনন্দ ছিলো ফিতার ক্যাসেটের গান। আমাদের আনন্দ ছিলো ভিসিডিতে। এখন তো হাতের সামনে কত কিছু আছে। কত কন্টেন্ট তবু কিছুই মনকে সন্তুষ্ট করতে পারে না আগের মতো !
পাড়ার মধ্যে একটা চায়ের দোকানের একটু আড্ডা দিতে পারলেই মনে হতো বড় হয়ে গিয়েছি। এলাকায় কয়েকজন এক সাথে চললেই মনে হতো আমাদের কি বিশাল গ্যাং। গিটার এর টুং টাং আওয়াজ করা আর ব্যান্ড এর গান শুনলে মনে হতো এই তো আমি জাতে উঠে গিয়েছি। এলাকায় আমাদের খেলার ক্লাব ছিলো। ব্যাট ভাঙ্গার গল্প আছে। খেলা থেকে দেরি করে ফিরে এসে বাসায় মার খাওয়ার গল্প আছে আমাদের। অন্যের বাড়িতে লেজার মারার কথা আছে। পাশের বাড়িতে কত বল হারিয়ে গিয়েছে। কতবার ছক্কা মেরে আউট হয়েছি এই জীবনে। আহারে...
সব জেনারেশনের কিছু ভালো দিক থাকে। সব প্রজন্ম কিছু সোনালি সময়ের স্বাক্ষী হয়। আমরা দেখেছি মুরুব্বিয়ানা, আমরা দেখেছি উদাস প্রেমিক। আমরা দেখেছি চিলেকোঠার ডিপ্রেশন। আমরা দেখেছি সেই মেয়েটির অবেলায় বিয়ে হয়ে যাওয়া। আমরা দেখেছি পাড়ার মোড়ে রঞ্জু মাস্তান। আমরা দেখেছি রঙ নাম্বারের প্রেম। আমরা দেখেছি প্রথম প্রেমে ব্যর্থ প্রেমিকের সিগারেটের ধোঁয়া।
আজ অনেক কিছু আছে আমাদের। গ্যালারি ভর্তি ছবি। রাত ভরা ২৫ পয়শার মিথ্যে গল্প। সন্ধ্যা জুড়ে সিরিয়াল। এপার্টমেন্টে একটা ব্যাক্তিগত রুম আর প্রাইভেসি। কত হাজার একাউন্ট আর পাসওয়ার্ড। কত কিছু খুঁজে পাওয়ার গুগল। কই আমি তো এত খুঁজেও শৈশবটাকে আর পেলাম না? ওল্ড স্কুলের আজ রাতে কোনো রুপকথা নেই গানটা শুনি আর খুঁজে বেড়াই রুপকথার রাতগুলো। গুগলে তো আর তাদের পাওয়া যাবে না!
সময়টা আজ কেমন যেন বড় হয়ে গেছি আমি তারাগুলো আজও মেঘের আড়াল কোথায় গিয়ে নামি...