যে সিনেমাটা মুক্তির দশ বছর পরেও একই রকম নতুন মনে হয়, দেখতে গিয়ে বিরক্তি আসে না, যে সিনেমাটা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে গেছে, সেটার নামই থ্রি ইডিয়টস...
বলিউডে প্রতি বছর অজস্র সিনেমা তৈরি হয়, মুক্তি পায়, এদের অনেকগুলো তো ব্যবসাসফলও হয়, পুরস্কারও ঘরে তোলে৷ কিন্ত এমন কিছু সিনেমা হুটহাট আসে, যেগুলো নতুন একটা বেঞ্চমার্কের জন্ম দেয়, নতুন ইতিহাস তৈরি করে। সিনেমা মুক্তির দশ-বিশ-ত্রিশ বছর পরেও সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়, সেসব সিনেমার সংলাপগুলো ঘুরে ফেরে লোকের মুখে মুখে৷
রাজকুমার হিরানীর থ্রি ইডিয়টস এমনই একটা কালজয়ী সিনেমা, মুক্তির দশ বছর পার হয়ে গেলেও যে সিনেমাটাকে এভারগ্রীন বলে মনে হয়, সিনেমার চরিত্রগুলো এখনও একই রকমের আপন আমাদের কাছে। র্যাঞ্চো, রাজু কিংবা ফারহান, কিংবা প্রিয়া, ভাইরাস, সাইলেন্সার- সবাই আমাদের কত কাছের মানুষ৷
থ্রি ইডিয়টস মুক্তি পেয়েছিল আজ থেকে দশ বছর আগে, ২০০৯ সালের বড়দিনে৷ অথচ মনে হয়, এই সেদিন বুঝি প্রথম দেখলাম সিনেমাটা! একটা সময় তো শুনতাম- সিনেমা হচ্ছে দুরকমের। একরকম হচ্ছে থ্রি ইডিয়টস, আর অন্যপাশে হচ্ছে বাকীরা। এরপরে এই কথাটাই অন্য অনেক ভালো সিনেমার ক্ষেত্র ব্যবহার হতে দেখেছি, কিন্ত সবসময় মনে হয়েছে, থ্রি ইডিয়টস ছাড়া অন্য কোন সিনেমার ক্ষেত্রেই এই বাক্যটা মানানসই নয়। সাইলেন্সারের সেই বিখ্যাত বক্তৃতাটা শুনে এখনও হেসে কুটিকুটি হই। জয় লোবোর আত্মহত্যার দৃশ্যটা মন খারাপ করিয়ে দেয়, কঠিণ হৃদয় ভাইরাসের চোখে জল দেখে আর্দ্র হয় আমাদের চোখও। রাজকুমার হিরানী একটা মাস্টারপিসই বানিয়েছিলেন বটে!
থ্রি ইডিয়টসের সাফল্যের পেছনে আমির খানের অভিনয়ের ভূমিকা আছে অবশ্যই। অথচ এই সিনেমাটায় তার অভিনয় করার কথাই ছিল না। প্রথমে র্যাঞ্চো চরিত্রে অভিনয় করার জন্যে রাজু হিরানী প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন শাহরুখ খানের কাছে। শাহরুখ এই সিনেমাটা করতে রাজী হননি তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান রেড চিলিজ থেকে সিনেমাটা নির্মাণ করা যাবে না, এই কারণে! যদিও অজুহাত হিসেবে বলেছিলেন, কলেজ ছাত্রের রোলে তাকে মানাবে না! শিডিউল সংক্রান্ত ঝামেলাও ছিল। যদিও নিন্দুকেরা বলেন, রোমান্স করার সুযোগ কম ছিল বলেই নাকি শাহরুখ থ্রি ইডিয়টস করেননি!
শারমান জোশি এবং মাধবনও তাদের চরিত্রের জন্যে প্রথম পছন্দ ছিলেন না। এই দুই চরিত্রের প্রস্তাব প্রথমে গিয়েছিল সাইফ আলী খান এবং জন আব্রাহামের কাছে৷ তারা ফিরিয়ে দেয়াতেই কপাল খুলেছিল সিনেমার 'রাজু' এবং 'ফারহানে'র। শোনা যায়, আরশাদ ওয়ার্সিও নাকি এই সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়েছিলেন৷ কিন্ত তিনিও শিডিউল ম্যানেজ করতে পারেননি।
সিনেমায় নিজের বয়সটা যাতে কম দেখায়, এজন্যে ওজন কমাতে হয়েছিল আমিরকে। টানা কয়েক মাস তিনি শুধু দুধ আর কলা খেয়ে বেঁচে ছিলেন! এমনকি ছেলের জন্মদিনে ছোট্ট একপিস কেকের মায়াও অগ্রাহ্য করেছিলেন তিনি৷ এজন্যেই হয়তো 'মিস্টার পারফেকশনিস্ট' নামটা তার সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি যায়। সঞ্জয় দত্তের একটা ক্যামিও রোল করার কথা ছিল থ্রি ইডিয়টসে, সেটাও পরে আর রাখা হয়নি। চেতন ভগতকে বলিউডবাসী চিনেছে থ্রি ইডিয়টস দিয়েই। তার লেখা উপন্যাস ফাইভ পয়েন্ট সামওয়ান থেকেই তো তৈরি হয়েছিল থ্রি ইডিয়টসের স্ক্রিপ্ট।
সিনেমায় একটা দৃশ্যে মাতাল অবস্থায় আমির খানকে দেখা যায় ভাইরাসের বাড়িতে গিয়ে তার মেয়ে কারিনা কাপুরকে প্রপোজ করতে৷ সেই দৃশ্যটা বাস্তবের মতো ফুটিয়ে তোলার জন্যে শুটিং শুরু হবার আগে সত্যি সত্যি মদ খেয়েছিলেন আমির! কিন্ত ঝামেলাটা বাঁধলো মদ খাওয়ার পরে। মাতাল অবস্থায় আমিরের দেয়া সংলাপগুলো মনোঃপুত হচ্ছিল না হিরানীর৷ তাই বারবার রিটেক নিচ্ছিলেন তিনি৷ রিটেক শট নিতে নিতে এক পর্যায়ে ক্যামেরার রোল শেষ হয়ে গেল! তখন কয়েকজনকে পাঠানো হলো নতুন রোল কিনে আনতে। মাঝের এই সময়টায় কন্টিনিউটি যাতে নষ্ট না হয়, এজন্য সেই দৃশ্যটাই অভিনেতাদের বারবার অভিনয় করে দেখাতে বলছিলেন হিরানী৷
থ্রি ইডিয়টসের অন্যতম প্রধান অংশ হচ্ছে ভাইরাসের মেয়ের বাচ্চা ডেলিভারির দৃশ্যটা। এখানে একটা মজার গল্প আছে। এমন একটা দৃশ্য হিরানী তার 'মুন্নাভাই এমবিবিএস' সিনেমায় রাখার কথা ভেবেছিলেন৷ ডাক্তারির ড-ও না জানা মুন্নাভাইয়ের এই অপারেশনটা করার কথা ছিল। কিন্ত পরে আইডিয়াটা বাদ দেয়া হয়। তবে হিরানীর মাথা থেকে সেটা যায়নি। তাই থ্রি ইডিয়টসে সেটার সফল বাস্তবায়ন করে ফেললেন!
আমরা সিনেমায় যেভাবে দেখেছি, থ্রি ইডিয়টসের শুটিং হয়েছিল এর উল্টোভাবে। সিনেমায় কয়েকটা দৃশ্যের পরেই ফারহানের জবানবন্দীতে আমরা ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে যাই কলেজের সেই দিনগুলোতে। তবে শুটিং করার সময় প্রথমে বর্তমানের অংশটা পুরো শুট করে নেয়া হয়েছিল, তারপরে কলেজের অংশগুলো ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছিল।
একটা মজার ব্যাপার হয়তো অনেকেই জানে না। থ্রি ইডিয়টস মুক্তি পাবার পরেই শুটিঙের লোকেশন শিমলা-মানালী পর্যটকদের কাছে ভীষণ আকর্ষণীয় জায়গা হয়ে ওঠে, আনাগোনা বাড়তে থাকে ঘুরতে আসা লোকজনের৷ এখন তো এই দুটোই ভারতের অন্যতম সেরা পর্যটন স্পট৷ আগে ক্র্যাক টাইপের ট্যুরিস্ট ছাড়া কেউ লাদাখের দিকে অয়া বাড়াতো না৷ এখন তো দলে দলে লোকজন লাদাখে যায়, যেখানে সিনেমার ক্ল্যাইম্যাক্স সিনেমার শুটিং হয়েছিল, হারিয়ে যাওয়া র্যাঞ্চোর খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল। তবে লাদাখের স্থানীয় লোকজন এমন অনাহুত অতিথিদের ওপর বেশ বিরক্ত, পর্যটকের চাপে তাদের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ইদানিং।
আইএমডিবিতে প্রায় তিন লাখ ভোট পড়েছে থ্রি ইডিয়টসের বাক্সে, এরপরেও সিনেমাটার রেটিং ৮.৪! বক্স অফিসের সব রেকর্ড চুরমার করে সর্বোচ্চ আয় করা সিনেমা হয়েছিল এটি, তিনটি ন্যাশনাল, ছয়টি ফিল্মফেয়ার সহ সর্বমোট ৫২টি অ্যাওয়ার্ড ঘরে তুলেছিল থ্রি ইডিয়টস। দক্ষিণ ভারত এবং সুদূর মেক্সিকোতেও সিনেমাটি রিমেক করা হয়েছে, তবে কোনোটাই আলোচিত হয়নি থ্রি ইডিয়টসের মতো করে। চীনে থ্রি ইডিয়টস মুক্তি পাবার পর রেকর্ড পরিমাণ ব্যবসা করেছে, আমির খানের প্রচুর ভক্ত তৈরি হয়েছে সেখানে।
থ্রি ইডিয়টসের বয়স নয় বছর হয়ে গিয়েছে আজ! অথচ মনে হয়, এই তো সেদিন না মুক্তি পেলো সিনেমাটা! হিন্দি বুঝতাম না তখন, সাবটেইটেল দিয়ে দেখেও হেসে গড়াগড়ি খেয়েছি, জয় লোবোর মৃত্যুতে কষ্ট পেয়েছি, মেজাজ গরম করে ভাইরাস আর সাইলেন্সারকে বেঁধে পেটাতে মন চেয়েছে, আর র্যাঞ্চো-রাজু-ফারহানদের ভালোবেসেছি একদম আপন বন্ধুর মতোই। সিনেমা দেখে কোনকিছু শেখা যায় কিনা জানিনা, তবে থ্রি ইডিয়টস আমাকে শিখিয়েছে, জীবনে যতো সমস্যাই আসুক না কেন, সেই সমস্যার সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে 'অল ইজ ওয়েল' বলতে।
ভাবুন তো, সিনেমার কন্টেন্ট নিয়ে কতটা কনফিডেন্ট হলে একজন প্রযোজক প্রকাশ্যে বলতে পারেন যে, আপনারা দয়া করে পাইরেসি করবেন না, আমরা মুক্তির বারো সপ্তাহ পরেই সিনেমাটা অনলাইনে এভেইলেবল করে দেবো! হ্যাঁ, প্রযোজক বিধু বিনোদ চোপড়া এমনটাই বলেছিলেন সিনেমা মুক্তির আগে। যদিও তিনমাস নয়, প্রায় এক বছর পরে ইউটিউবে এসেছিল থ্রি ইডিয়টস। এখন হয়তো সিনেমাটা দেখলে অনেক খুঁত চোখে পড়ে, যুক্তির সঙ্গে মেলাতে বসলে প্লটহোল খুঁজে বের করা যায়। কিন্ত সেসব থাকা স্বত্ত্বেও, থ্রি ইডিয়টস আমাদের কাছে অন্যরকম একটা আবেগের নাম। বড় গলা করেই বলতে পারি, ইটস নট জাস্ট এ মুভি, 'থ্রি ইডিয়টস' ইজ অ্যান ইমোশান!