টাইগার উডস: জীবন্ত কিংবদন্তী, অথবা গলফের সবচেয়ে বড় বিলবোর্ড!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
বহু চড়াই-উৎরাই এর পরে আজ তিনি বিশ্ব গলফের সবচেয়ে বড় আইকন, সবচেয়ে বেশি আয় করা ক্রীড়াবিদ। গলফের এমন কোনো রেকর্ড নেই, যা ছুঁয়ে দেখেননি তিনি! ব্যক্তিগত জীবনে জড়িয়েছেন বিতর্কে, সবকিছু হারিয়ে আবার ফিরেছেন রাজার বেশে...
আমাদের দেশের সাপেক্ষে 'গলফ' অনেকটাই বড়লোকদের খেলা। তৃনমূল মানুষদের খেলা ক্রিকেট, ফুটবল আর পেটি বুর্জোয়াদের খেলা গলফ। যদি খেলাধুলার শ্রেনিবৈষম্যের একটি খসড়া করি, গলফ সেখানে উপর তলার বাসিন্দা। তবে 'গলফ'কে নিরাপদ দূরত্বে রেখে বেড়ে ওঠা এ দেশেও একজন গলফার ছিলেন, যাকে বলা হতো- বাংলার টাইগার উডস। মানুষটির নাম সিদ্দিকুর রহমান। কথা হলো, তাকে বাংলার টাইগার উডস ডাকা হতো কেন? আমিই বলে দেই উত্তর। সিদ্দিকুর রহমানকে টাইগার উডসের সাথে নাম মিলিয়ে ডাকা হতো তার উৎকর্ষের জন্যে। অর্থাৎ 'টাইগার উডস' বিশেষ্য থেকে এমন এক বিশেষণে পরিণত হয়েছেন, কারো অসাধারণত্ব বোঝাতে ব্যবহার করা হয় নামটিকে। গলফ আমরা বুঝি আর নাই বুঝি, যিনি আমাদের কাছে গলফেরই সমার্থক শব্দ, সেই এলড্রিক টন্ট টাইগার উডস কে? কেন? কীভাবে? সেটাই জানার চেষ্টা করি আজ নাহয়।
টাইগার উডসের পুরো নামটা একটু খটোমটো হলেও নামের প্রত্যেক অংশের আছে আলাদা তাৎপর্য ও মজার ইতিহাস। নামের প্রথম অংশ 'এলড্রিক (Eldrick)' এর 'ই' নেওয়া হয়েছে বাবার নাম আর্ল এর 'ই' থেকে এবং এই শব্দের শেষ অক্ষর 'কে' নেওয়া হয়েছে, মায়ের নাম কুলতিদা'র 'কে' থেকে। টাইগার উডসের মা ছিলেন থাইল্যান্ড বংশোদ্ভুত৷ থাইল্যান্ডে 'টন্ট' একটি সম্মানজনক উপাধি। এলড্রিক এর পরে তাই বসেছে টন্ট। নামের 'টাইগার' অংশটি এসেছে বাবার বন্ধু কর্নেল ভুওং ডাং ফং এর ডাকনাম থেকে, এই কর্নেলেরও ডাকনাম ছিলো 'টাইগার।' এবং নামের শেষ অংশটি বংশপদবী 'উডস।'
ক্যালিফোর্নিয়ায় কর্নেল বাবা ও থাইল্যান্ড বংশোদ্ভুত মায়ের ঘরে জন্ম নেন টাইগার উডস। উডসের যখন জন্ম, তখন তার বাবা অবসর নিয়েছেন সেনাবাহিনী থেকে। গলফ নিয়ে তার ছিলো তীব্র আকর্ষণ। জন্মের পর ছেলেকেও তাই গলফ শেখাতে বসলেন। মাত্র দুই বছর বয়সের টাইগার কে নিয়ে চলে গেলেন গল্ফ কোর্সে। নিজে নানা সীমাবদ্ধতার কারনে গল্ফ নিয়ে এগোতে পারেননি। ভাবলেন, ছেলে এবার স্বপ্নপূরণ করুক।
ছেলেও কম যায় না। তিন বছর বয়স থেকেই পত্রিকায়, ম্যাগাজিনে শিরোনাম হয়ে আসতে লাগলো সে। গল্ফের কারিশমা দেখাতে লাগলো ক্রমশ। সাত বছর বয়সে এসে জিতে নিলো ক্যালিফোর্নিয়ার অনুর্ধ্ব দশ গলফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা। এরপরই ক্রমশ এগিয়ে যাওয়া। আর থামাথামি নেই। টাইগার উডসের বাবা কর্নেল আর্ল একবার হাসতে হাসতেই বলেছিলেন-
যাকে আমি খেলা শেখালাম, আমার সেই ছেলে এগারো বছর বয়সে আমাকে হারিয়ে দেয়। আমি জেতার অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু জিততে পারলাম না। এরপর থেকে আমি আর একবারও জিততে পারিনি ওর সাথে।
তেরো বছর বয়সে প্রথম ন্যাশনাল টুর্নামেন্টে খেলে উডস। পনেরো বছর বয়সে যখন সে ওয়েস্টার্ন হাই স্কুলে পড়াশোনা করছে, সে বছরে সে হয় সবচেয়ে কম বয়সের 'ইউএস জুনিয়র অ্যামেচার চ্যাম্পিয়ন।' এর পরের দুই বছরেও সে এই শিরোপা ধরে রাখে নিজের কাছে। হয়ে যায় এই ইভেন্টের একমাত্র খেলোয়াড়, যে অর্জন করেছে তিনটি শিরোপা। প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার, ন্যাশনাল অ্যামেচার প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার সহ অজস্র টাইটেলেও ভূষিত করা হয় তাকে।
ছোটবেলা থেকেই তোতলামির সমস্যা ছিলো টাইগার উডসের। তাই এক দিকে যেমন সাফল্য পাচ্ছিলো সে, আরেক দিকে গলার কাঁটার মত যন্ত্রণা দিচ্ছিলো এই সমস্যা। পরবর্তীতে সে এই সমস্যা দূর করতে অভিনব পদ্ধতি নেয়। ঘরের মধ্যে সে অনর্গল কথা বলতো। তার পোষা কুকুরকে পাশে বসিয়ে শোনাতো তার কথা এবং কুকুরটিও চুপটি করে শুনতো সব। এভাবেই ক্রমশ সে তার সমস্যা দূর করে। এই ঘটনা থেকে একটা বিষয় সচেতন পাঠকের নজরে আসবে, টাইগার উডসের একাগ্রতা। সমস্যা হলে সেটিকে দূর না করা পর্যন্ত চেষ্টা করে যাওয়া, এটাই করতেন তিনি। তার এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য আমরা দেখবো এই লেখার পরবর্তী অংশেও।
কলেজে ওঠার পরেও জয়রথ চলতে থাকে উডসের। বিশ বছর বয়সে এসে সে ইউএস অ্যামেচার টাইটেলের টানা তৃতীয় শিরোপা অর্জন করে। এসময়ে এসে প্রফেশনাল গল্ফে আস্তে আস্তে মানুষ জানতে শুরু করে টাইগার উডসের চমৎকারিত্বের কথা। জয়রথ চলছে, এর মাঝখানে চোখের একটা অপারেশন করতে হয় উডসকে। লেজার অপারেশন করার পরে আবার গল্ফ কোর্সে ফেরে সে। ভাঙ্গতে থাকে একের পর এক বিশ্বরেকর্ড। চব্বিশ বছর বয়সে এসে ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ গলফার হিসেবে জেতেন গ্রান্ড স্লাম!
উডস তার খেলায় সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতেন ডিসটেন্স কন্ট্রোলিং এর উপর। ক্লাবহেড দিয়ে শট নেয়ার সময়েই তিনি মেপে নিতেন হোলের দূরত্ব ও শটের আপেক্ষিকতা। ড্রাইভিং অ্যাকিউরিসিতেও মনোযোগ থাকতো তার। রিকোভারি, বাংকার স্টাইল, পুটিং এ আক্রমণ করতেন৷ নানা রকম টেকনিকের পাশাপাশি তিনি প্রাকটিসে সময় দিতেন অনেক বেশি৷ যেকোনো গলফারের চেয়ে বহুগুন বেশি সময় নিয়ে প্রাকটিস করতেন উডস। কুকুরকে পাশে বসিয়ে তোতলামো সারানোর গল্পটি কী মনে পড়ছে এখন?
২০০১ সালে টাইগার উডস করেন আরেকটি অবিস্মরণীয় রেকর্ড৷ এই গ্রহের একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে তিনি টানা চারটি মেজর প্রফেশনাল গলফ টাইটেল জেতেন। এই অর্জনকে নামকরণ করা হয় 'টাইগার স্ল্যাম' নামেও! স্বপ্নের মত কয়েকটি সিজন শেষ করেই যবনিকাপতন। আগস্ট ১৯৯৯ থেকে সেপ্টেম্বর ২০০৪... টানা পাঁচ বছর অথবা ২৬৪ সপ্তাহ ধরে 'নাম্বার ওয়ান গলফার' হিসেবে থাকার পরে র্যাংকিং এর দুই নাম্বারে নামতে হয় তাকে। একটু ধাক্কা খান তখন।
তবে এ ধাক্কা সাময়িক। গল্ফ কোর্সে প্রত্যাবর্তন করে আবার জিততে থাকেন একের পর এক ট্রফি। শীর্ষস্থান থেকে পতনের দুঃখ ভুলতেই হয়তো তিনি জিততে থাকেন ক্লান্তিহীনভাবে। এরইমধ্যে আসে বাবার মৃত্যুসংবাদ। গল্ফ কোর্স থেকে সাময়িক বিদায় নিয়ে চলে যান ক্যালিফোর্নিয়ায়। এরপর আবার আসেন। কিন্তু বেশিদিন খেলতে পারেন না। হাঁটুর সমস্যা ভোগাচ্ছিলো। হাঁটুর সার্জারি করতে হয়। সার্জারির পরে বেশ কিছুদিন থাকতে হয় ট্রাকের বাইরে। এসময়ে ঘটে এক কাণ্ড। টাইগার উডস ট্রাক থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর অধিকাংশ মিডিয়া গলফের কাভারেজ করে দেয় বন্ধ। কারণ, টাইগার উডস গলফের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। সে ই যদি না থাকে, গলফ দেখবেও বা কে! বলতে গেলে পুরো 'গল্ফ দুনিয়া' এক জৌলুশহীন জীবন কাটায় অনেকদিন।
২০০৯ সালে টুর্নামেন্টে খেলা শুরু করেন আবার৷ কিন্তু কেন যেন আগের সেই টাইগার উডসকে পাওয়া যাচ্ছিলো না। অবশ্য পুরোনো হিংস্র 'টাইগার'কে পাওয়ার কথাও না। স্ত্রী'র সাথে তাঁর দাম্পত্যকলহের কড়চা আর অন্য এক মহিলার সাথে তার অবৈধ সম্পর্কের গুজব তখন ঘুরে ফিরছে গণমাধ্যম কর্মীদের মুখে মুখে। এরমধ্যে খেলায় মনোযোগ দেওয়া বেশ শক্তও বটে। কোনো মেজর টাইটেল না জিতেই সিজন শেষ করেন। ডিসেম্বরে এসে ঘোষণা দেন- অনিশ্চিত সময়ের জন্যে গলফ কোর্স ছাড়ছেন তিনি। এই সময়ে অনেক কোম্পানি, যারা টাইগার উডসকে স্পন্সর করতো, তারা উডসের সাথে চুক্তি স্থগিত করে দেয়। পরের বছরেই টাইগার উডস নিজের কাজের জন্যে ক্ষমা চান এবং আবার গলফে ফেরার ইচ্ছে ব্যক্ত করেন।
২০১০ সালে তিনি ফিরলেও খুব একটা চমক দেখাতে পারেননি৷ ব্যক্তিগত সমস্যা, ইনজুরি আর আশেপাশের বেশ কিছু বিষয় মিলিয়ে জঘন্য এক সিজন কাটান তিনি। সে বছরের কোনো টুর্নামেন্টেই শিরোপা জেতা হয়নি আর তার। এরপর ক্রমশ এসেছেন। গিয়েছেন। ইনজুরিতে পড়েছেন। ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। ২০১৭ সালে এসে অ্যারেস্টও হলেন একবার। পুলিশ দাবি করেছিলো, মদ্যপ হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন তিনি। যাই হোক, সে অভিযোগ কাটিয়ে আবার তিনি গলফের সবুজ মাঠে আসেন পরের বছরেই। ট্রফিও জেতেন। এ বছরের শেষে এসে পিজিএ ট্যুরেও হয়েছেন চ্যাম্পিয়ন। অলটাইম গ্রেট স্যাম স্নিডের সাথে যুগ্মভাবে হয়েছেন পিজিএ ট্যুরের সর্বোচ্চ জয়ের মালিক। আরেকটি জয় পেলেই তিনি টপকে যাবেন স্যামকে। হবেন ৮৩টি পিজিএ ট্যুর ইভেন্টে চ্যাম্পিয়নশিপের মালিক!
টাইগার উডসকে নিয়ে চাইলে অনেক কথাই বলা সম্ভব। তাকে নিয়ে গবেষণা করেছিলো আমেরিকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের পরিসংখ্যানে জানা গিয়েছিলো- গল্ফের বাঘা বাঘা খেলোয়াড়েরা কোনো এক অদ্ভুত কারণে টাইগার উডসের মুখোমুখি পড়লে ঘাবড়ে যায় ও যথেষ্ট বাজে পারফরম্যান্স করে। এই বিষয়টিকে তারা বর্ণনা করেন 'টাইগার এফেক্ট' নামে। এখন পর্যন্ত টাইগার উডস জিতেছেন ১৫টি মেজর ইভেন্ট শিরোপা, ৪১ টি ইউরোপিয়ান টুর্নামেন্ট শিরোপা, ২১টি অ্যামেচার টুর্নামেন্ট শিরোপা, সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে চারটি মেজর চ্যাম্পিয়নশিপ সহ অগুনতি শিরোপা। ২০১৯ সালে পেয়েছেন 'প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম।' বহুবার হয়েছেন 'স্পোর্টসম্যান অব দ্য ইয়ার', 'অ্যাথলেট অব দ্য ইয়ার।' অনেকের চোখে তিনিই গলফের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়৷
'টাইগার উডস ফাউন্ডেশন' নামের এক সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন টাইগার উডস ও তার বাবা। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে গলফ খেলোয়াড়দের উঠিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে বহুদিন ধরেই। বিভিন্ন গলফ কম্পিটিশনেও স্পন্সর করে এই ফাউন্ডেশন। 'টাইগার উডস ডিজাইন' নামের আরেকটি সংগঠন আছে উডসের। যেটি কাজ করে গলফ কোর্সের নানারকম ডিজাইন নিয়ে। এছাড়া লেখালেখিও করেন উডস। 'গলফ ডাইজেস্ট' ম্যাগাজিনে টানা চৌদ্দ বছর লেখালেখি করেছেন তিনি। 'হাউ আই প্লে গলফ' নামে বই লিখেছেন, যা হয়েছে বেস্ট সেলার। তিনি স্মৃতিমূলক আরো কিছু বই লিখেছেন। সামনেও বেশ কিছু বই লেখার কথা আছে তার৷
'টাইগার উডস' এক অদ্ভুত বিলবোর্ডের নাম। মাঠের বাইরে অজস্র কানাঘুষো, গুজব, আটক, জরিমানা, বিতর্ক। কিন্তু মাঠে ঢুকলেই সেই মানুষটি যেন ধ্যানী বুদ্ধ। যাকে ভয় পায় সবাই। যার সামনে এলেও স্বাভাবিক খেলা ভুলে যায় অনেকে। গল্ফ খেলতে খেলতে এতটাই একপেশে করে ফেলেছেন সব রেকর্ড আর পরিসংখ্যানকে, যিনি হয়ে গিয়েছেন গল্ফ এর জীবন্ত কিংবদন্তি, ওয়ার্ল্ড গল্ফ এর সবচেয়ে বড় পোস্টারবয়, গল্ফ ইতিহাসের সবচেয়ে ওজনদার, সবচেয়ে সফল নাম।
এলড্রিক টন্ট টাইগার উডস নামের এই মানুষটির আজ জন্মদিন। তাঁর জন্মদিনে শুভকামনা ও গুণমুগ্ধ বিস্ময় রইলো গল্ফ-বিমুখ দেশের এক ভক্তের পক্ষ থেকে।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন