২০১৯ সালে সারা বিশ্বে সর্বোচ্চ ডাউনলোড করা মোবাইল এপের ভেতর প্রথম ৫টি এপের চারটির মালিকই ফেসবুক। শুধু একটার মালিক ফেসবুক নয়। সেই এপের নাম টিকটক।
[প্রারম্ভিতাঃ কিছুদিন আগে একজনের সাথে টিকটক নিয়ে দীর্ঘক্ষন কথা হলো, সেখানে টিকটকের মার্কেটিং, বিজ্ঞাপন পদ্ধতি ও একে ঘিরে রাজনীতি নিয়ে আলাপ হয়েছে। ভাবলাম পুরো কথপকথনকে একটা স্বতন্ত্র পোষ্টে রূপ দিলে কেমন হয়?
তাছাড়া, অনেকে লম্বা লেখা পড়তে অনভ্যস্ত, কিন্তু সেটা ইন্টারভিউ আকারে হলে লম্বা লেখা পড়তেও অনেক সময় একঘেয়েঁ লাগে না। এটি প্রায় ২,৪০০ শব্দের একটা লেখা। সত্যিকার আগ্রহী পাঠক না হলে এটি কেউ till the end পড়তে পারবে না। তাই ভাবলাম, আমার তৈরী করা কনটেন্ট কনজাম্পশন প্যাটার্ন নিয়েও এই ফাঁকে ছোটখাট একটা এক্সপেরিমেন্ট করে ফেলি!]
- আচ্ছা ভাইয়া, ভারী টপিকে লেখালেখির সময় আপনার মাথা দিয়ে কি ধোঁয়া উড়ে না মাঝে মাঝে?
- হ্যাঁ, তা তো উড়েই।
- তখন কি করেন?
- টিকটক দেখি।
- টিকটক!! বলেন কি!?
- কারণ আমি আবিস্কার করেছি, টিকটক ভিডিও আমার স্ট্রেইস লেভেল কমিয়ে দেয়। তবে সবগুলা না। কিছু কিছু ভিডিও। কিছু ক্ষ্যাত টাইপের টিকটকার আছে, ওগুলোকে ফিল্টার করে দেই।
- আপনি নিজেও তো মনে হয় কয়েকটা ভিডিও বানিয়েছেন।
- হ্যাঁ, টিকটক ভিডিও বানালেও আমার স্ট্রেইস রিলিভ হয়। কিন্তু ওগুলা আমি কারো সাথে শেয়ার করি না। আমি টিকটক বানাই আমার স্ট্রেইস রিলিভের জন্য। কাউকে দেখানোর জন্য না।
- রেগুলার টিকটকার হয়ে যান ভাইয়া!
- আপাততঃ তেমন কোন ইচ্ছে নাই। তাছাড়া, টিকটক ভিডিও বানানো আমার জন্য সময় সাপেক্ষ, কারণ আমি নিজের ল্যাপি থেকে আপলোড করা গান দিয়ে ভিডিও বানাই।
- টিকটকেই তো কত ভালো ভালো গান আছে!
- টিকটকে যে গান আছে সেগুলো আমার রুচি বা মুড কোনটার সাথেই যায় না। তাই নিজস্ব অডিও ট্র্যাক আপলোড করে আমাকে ভিডিও বানাতে হয়।
- এমন কোন ফিচার আছে যেটা আপনি টিকটকে মিস করেন?
- ফেসবুকের মত একটিভিটিজ আর্কাইভ নাই। এটা মিস করি।
- টিন্ডার একাউন্ট আছে আপনার?
- দুই বছর আগে ১ ঘন্টার জন্য ইন্সটল করেছিলাম। কৌতুহল ছিলো এটা কি জিনিস, কিভাবে ইউজ করে। কৌতুহল মেটার পর পরই অ্যাপ আনইন্সটল করে দিয়েছিলাম।
- কারণ কি?
- কারণ টিন্ডারকে আমার টিকটকের চাইতেও অনেক বেশী লেইম আর নন-প্রডাকটিভ মনে হয়েছে। টিন্ডারে ক্রিয়েটিভিটি দেখানোর মত কিছু খুঁজে পাইনি। আমি টিকটক পছন্দ করি তার অন্যতম কারণ মনে হয়, এটাতে সামান্যতম হলেও ক্রিয়েটিভিটি প্রদর্শনের সুযোগ থাকে।
- টিকটককে অনেকে অপছন্দ করেন। তাদের ব্যাপারে মন্তব্য কি?
- আমি নিজেই তো একটা সময়ে টিকটককে অবজ্ঞা ও অপছন্দ করতাম।
- তাহলে ভালো লাগাটা কিভাবে শুরু হলো?
- এর সাকসেস ফিগার থেকে আগ্রহের সূত্রপাত! তুমি কি জানো টিকটকের ভ্যালুয়েশন এখন ১১০ বিলিয়ন ডলার! ইতিহাস বলে, যে সব কোম্পানির বাজারমূল্য ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়, সেগুলো পৃথিবীকে ডিজরাপটিভ টেক ট্রেন্ড উপহার দেয়।
এখন, আমি যদি তাকে অবজ্ঞা ও অপছন্দ করে তাকে দূরে সরিয়ে রাখি, তার ব্যাপারে না জানি, তাহলে বুঝতে হবে আই অ্যাম মিসিং আউট আ হেল লটা থিংস!
আরেকটা ব্যাপার হলো, গত বছর টিকটকের লভ্যাংশ ছিলো ৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশী। টিকটকে কিন্তু কোন এড নাই, ইউটিউব বা ফেসবুকে যেমন থাকে। তাহলে তারা পয়সা কামাই করে কি করে?
- ইন-অ্যাপ পারচেজ?
- রাইট! এটা তাদের প্রাইমারি ইনকাম সোর্স! তার মানে তারা তাদের ইউজারদের বিরক্ত উদ্রেক করা ছাড়াই মোটা অংকের প্রফিট করছে। আর তার মানে, টিকটক অন্যান্য সকল সোশ্যাল মিডিয়ার চাইতে অন্তত এই দিক থেকে মোর ইউজার ফ্রেন্ডলি।
- এভাবে তো কখনো চিন্তা করে দেখি নাই।
- টিকটক নিয়ে কিন্তু অনেক চিন্তার খোরাক আছে। আমার মনে হয়, একে নিয়ে আনবায়াসলি চিন্তা করলে আমাদের লাভ বৈ ক্ষতি হবে না।
- টিকটকের ইতিহাসটা আসলে কি? কই থেকে শুরু হলো? গত ২ বছর ধরে হঠাৎ করে বিশ্বজুড়ে এর হাইপের কারণ কি?
-ভালো প্রশ্ন। ২০১৪ সালে মিউজিক্যালি নামে একটা চাইনিজ ক্যারাওকে এপ লঞ্চ করা হয় এপস্টোরে। এটি ছিলো ছোট্ট একটা চাইনিজ স্টার্টাপ! এটি দিয়ে ক্যারাওকে গানের সাথে লিপসিং করা যেতো বলে টিনেজদের ভেতর তুমুল জনপ্রিয়তা পায় পরবর্তী ৩ বছরে।
২০১৭ এর নভেম্বরে টিকটকের প্যারেন্ট, আরেকটা চাইনিজ কোম্পানি বাইটড্যান্স একে 1 বিলিয়ন ডলারে কিনে নেয়, তখন এর ইউজার ছিলো প্রায় ১০০ মিলিয়ন! তাদের আগে ফেসবুক মিউজ্যাকেলিকে কিনে নেবার চেষ্টা করে, টানা ৬ মাস ধরে মুলামুলি চলে। কিন্তু মার্ক জাকারবার্গের সাথে বনিবনা না হওয়াতে এবং বাইটড্যান্সের কাছ থেকে বেটার অফার পাওয়াতে মিউজিক্যালি তাদের কাছেই বিক্রি হয়ে যায়।
বাইটড্যান্সের আগে থেকেই টিকটক নামে একই ধরনের একটা এপ ছিলো, সেটা দিয়েও মিউজিক্যালির মত ১৫ সেকেন্ডের ভিডিও পোষ্ট করা যেতো, কিন্তু সেটাতে লিপসিং ফিচার ছিলো না বলে স্রেফ শর্ট ভিডিও দিয়ে তারা ততটা জনপ্রিয়তা পায়নি।
কিন্তু মিউজিক্যালি কিনে নেয়ার পর বাইটড্যান্স একে নিজেদের এপ টিকটকের নামেই ঢালাওভাবে রিব্র্যান্ডিং করে। এরপর থেকেই মূলত এর হাইপ শুরু। হাইপ এতটাই ছিলো যে, ২০১৮ সালে পৃথিবীর সবচাইতে অধিকসংখ্যকবার ডাউনলোডেড iOS app ছিলো টিকটক!
মিউজিক্যালি কেনার সবচাইতে বড় যে সুবিধাটা বাইটড্যান্স ভোগ করেছে, সেটা হলো - একদম রাতারাতি তারা ১০ কোটি বাড়তি ইউজার পেয়ে যায় তাদের এপ টিকটকের জন্য। মিউজিক্যালির পুরনো টিম এরপর যখন টিকটকের জন্যও কাজ করা শুরু করে, তখন তারা আরো ইউজার পেতে শুরু করে। এখন তো টিকটকের মোট গ্রাহকসংখ্যা প্রায় ৮০ কোটি! একুইজেশনের মাত্র ৩ বছরের ভেতর ৮ গুন গ্রোথ! মানে প্রতি বছর গড়ে প্রায় তিনগুন গ্রোথ রেট!
এই দুর্দান্ত গ্রোথ রেইট করপোরেট বিশ্ব ও বোদ্ধামহলের নজর কাড়ে, নতুবা এর আগে টিকটককে তারা খুব একটা পাত্তা দিতো না। এই অস্বাভাবিক সফলতা না পেলে টিকটকও হয়তো অগোচরেই থাকতো বা নীশ টিজিতেই খেলাধুলা করতো, মেইনস্ট্রিম সোশ্যাল মিডিয়ার কাতারে আসতে পারতো না।
টিকটকের হাইপের দুটো প্রধান কারণ হচ্ছেঃ একটা নতুন আইডিয়া, আরেকটা রাজনৈতিক!
- রাজনৈতিক? অদ্ভুত তো!
-হ্যাঁ অদ্ভুতই বটে! কারণ, বিশ্বের বাঘা বাঘা সব কয়টা সোশ্যাল মিডিয়া হচ্ছে আমেরিকান। একমাত্র টিকটকই হচ্ছে চাইনিজ! সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে আমেরিকার একচ্ছত্র আধিপত্য টিকটক এসে গুড়িয়ে দিয়েছে। এই কারণেই এখন আমেরিকার চক্ষুশূল হয়ে গেছে টিকটক। নিরাপত্তার অজুহাতে ট্রাম্প সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে টিকটকের আমেরিকা শাখা বন্ধ করে দেবে।
অথচ বোকাটা দেখছে না যে, এতে চাকরী হারাবে দেড় হাজার আমেরিকান, তাও আবার এই করোনাক্রান্তি কালে যেখানে অসংখ্য আমেরিকানের চাকরী নেই। অথচ যদি সে টিকটক বন্ধ না করে, তবে আগামী ৩ বছরে এখানে চাকরী পাবে প্রায় ১০ হাজার আমেরিকান।
রাজনৈতিক কারণেই ভারতেও টিকটক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সম্প্রতী, চীন-ভারত সীমান্তে যুদ্ধের জের ধরে। টিকটকের ভারতীয় ইউজার আছে প্রায় ১২ কোটি, সেখানে থেকে উল্লেখযোগ্য রেভিনিউ আসতো টিকটকের। তাই এটি টিকটকের জন্য একটা বড় ধরনের ধাক্কা।
কিন্তু এই চান্সে আবার ভারতীয় অনেক টিকটক-জাতীয় এপ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, তারাও করে কেটে খাওয়া শুরু করেছে। ভারতীয়দের যে দেশপ্রেম, তাতে করে আমার মনে হয় না, দেশীয় কোন এপে অভ্যস্ত হয়ে গেলে তারা আবার একই ধরনের ভিনদেশী এপে ফিরে যাবে।
-আচ্ছা! হাইপের একটা কারণ তো রাজনৈতিক, আরেকটা কারণ কি?
- নিউ আইডিয়া!
-কি রকম?
-গুগল > ফেসবুক > টুইটার > লিংকড ইন > হোয়াটস অ্যাপ > ইন্সটাগ্রাম > পিন্টারেষ্ট > স্ন্যাপচ্যাট - এরা প্রত্যেকে কিন্তু কোন না কোন ওয়েব বেইসড সেবা দেয় এবং সেগুলোর সবগুলাই বিশ্বজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়।
অলরেডি একজন আধুনিক মানুষের যা যা দরকার, তার সবই কিন্তু এই ব্র্যান্ডগুলো দিচ্ছে। এই কারণে, নতুন কি হাইপ আসতে পারে, কিংবা নতুন কি মিসিং - যেটা এখন পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি, সেটা নিয়ে কারো কোন আইডিয়া ছিলো না।
টিকটক (কিংবা মিউজিক্যালি) এমন আইডিয়া নিয়ে এসেছে যেটা আরো মাথাতেও আসেনি, কিংবা এটা যে সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে নেক্সট বিগেষ্ট হিট হবে, এটা কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। পেলে তারাই এটা রাতারাতি নামিয়ে ফেলতো! আর টের পাওয়া মাত্র ২০১৬ সালে ফেসবুক উঠে পড়ে লেগেছিলো মিউজিক্যালি কিনতে।
মিউজক্যালি আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, লিপসিং করাকে মানুষ ভালবাসে, যেটাকে এত্তগুলো কোম্পানির কেউই এত দীর্ঘ বছরেও এড্রেস করতে পারেনি। সবকিছু থাকলেও এই একটা জিনিস মিসিং ছিলো এতদিন!
আরেকটা ব্যাপার হচ্ছেঃ টিকটক আমাদের কাছে প্রমাণ করেছে যে, আইডিয়ার চাইতেও বড় হচ্ছে এক্সিকিউশন।
ঠিকঠাকভাবে যদি এক্সিকিউট করা যায়, তবে টিকটকের মত আপাতঃ স্টুপিড আইডিয়া দিয়েও যে বছরে বিলিয়ন ডলার কামানো সম্ভব, সেটা টিকটক পৃথিবীর তাবৎ টেকপ্রিনিউরদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
টিনেজ UGC (User Generated Content) কে টিকটক মাত্র 3 বছরের মধ্যে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছে, পৃথিবীর সব কয়টা সোশ্যাল মিডিয়া গত দেড় দশকেও তা পারেনি।
এবং এটা ক্রিয়েটিভ, এন্টারটেইনিং, স্ট্রেস রিলিভিং আবার একই সাথে ইজি-টু-ক্রিয়েট। যেটা অন্য জায়ান্টরা মিস করেছে। গুগল যেমন মিস করেছিলো ফেসবুকের আইডিয়াকে। নতুবা ফেসবুক যে সময়ে আত্নপ্রকাশ করেছিলো, সে সময়ে গুগলের আরো অনেক বেশী সক্ষমতা ছিলো ফেসবুকের চাইতে বেটার প্লাটফর্ম বানানোর।
স্রেফ সময় আর টিজির প্রবলেমকে সঠিকভাবে ধরতে না পারার কারণে তারা সেটা করতে পারেনি। কিন্তু গুগলের মত টিকটক একই ভুল করেনি। গুগলের আসলে সোশ্যাল-প্লাটফর্ম-ভাগ্য খুবই খারাপ। তারা গুগল ওয়েভ লঞ্চ করলো, এরপর করলো গুগল প্লাস - দুটোই চূড়ান্ত রকমের ফ্লপ প্রডাক্ট ছিলো, তাই দুটোই বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলো। ভাগ্যিস তারা ইউটিউবকে কিনে রেখেছিলো, জাভেদ করিম নামের এক বাংলাদেশী ছেলের কাছ থেকে, নাইলে আজ সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে তাদের কোন নাম নিশানাও থাকতো না।
টিকটক ভালো লাগার আরেকটা কারণ হলো, ছোট বেলা থেকেই আমার ভিডিও এডিটিংয়ের ব্যাপারে বেশ ঝোঁক ছিলো। কলেজে পড়ার সময় আমি Windows Movie Maker দিয়ে প্রায়ই মিউজিক ভিডিও বানাতাম। কাজটা এখনকার মত এত ইজি ছিলো না, ঘন্টার পর ঘন্টা নষ্ট হতো।
কিন্তু টিকটক এই কাজটাকে অবিশ্বাস্য রকমের সহজ আর কমপ্যাক্ট করে ফেলেছে। ১ মিনিটের একটা মিউজিক ভিডিও টিকটকে ৩/৪ মিনিটেই বানানো সম্ভব! ভিডিও এডিটিংয়ের জগতে এইটা একটা রেভুলেশনারি ডিভালাপমেন্ট হয়েছে! পৃথিবীর আর কোন মোবাইলে এপ এই কাজটাকে এত সহজভাবে করতে পারেনি।
তো এত কিছু ভেবে দেখার পর মনে হলো, আমার মত একজন প্রযুক্তি মনস্ক -আধুনিক মানুষের উচিত হচ্ছে না টিকটককে দূরে সরিয়ে রাখা। আমি এরপর টিকটক সমন্ধে সমস্ত বায়াসড চিন্তা-ভাবনাকে দূর করে ঘাটঁতে লাগলাম how Tiktok works.
এবং আমি আবিস্কার করলাম, আমি যখন স্ট্রেসে থাকি তখন আমার ব্রেইন এটাকে উপভোগ করে, বিনোদিত হয়। কয়েক মিনিট টিকটকের ফিড স্ক্রল করার পর আবার আমার কাজে মনোনিবেশ করতে পারি। এটা আমার জন্য মুটামুটি ”পোমোডোরো টেকনিকের” মত কাজ করে!
তবে কিছু জঞ্জাল টাইপের টিকটকার রয়েছে, ফালতু ও উগ্র ভিডিও থাকে ফিডে, সেগুলোকে ফিল্টার করলে আমি মনে করি টিকটক চমৎকার একটা সোশ্যাল নেটওয়ার্ক!
আর্বজনা টাইপের ইউজার আর কনটেন্ট তো ফেসবুকেও আছে, তাই বলে কি ফেসবুককে আমরা ঢালাও ভাবে খারাপ বলি? অপছন্দ করি? অবজ্ঞা করি? বিদ্রুপ করি?
ইউজার বা কন্টেন্ট খারাপ হতে পারে, কিন্তু আস্ত একটা প্লাটফর্ম তো আর খারাপ হতে পারে না। আলেকজান্ডার নোবেল তো ডিনামাইট বানিয়েছিল পাহাড় ধ্বংস করে রাস্তা বানাবার জন্য, মানুষ মারার জন্য না বা মানুষের ঘরবাড়ি ধ্বংস করার জন্য নয়। এখন কেউ যদি ডিনামাইট দিয়ে মানুষ ধ্বংস করে সেটা কি নোবেলের দোষ নাকি ডিনামাইটের দোষ?
- তাহলে বেশিরভাগ মানুষজন টিকটক অপছন্দ করে কেন?
- এক কথায় যদি বলি তাহলে আমি বলব, তারা আদতে টিক টক এর প্রতি অতিমাত্রায় বায়াসড। আমাদের উচিত টিকটকের ভালো দিকগুলো নিয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখা! তবে আমি বিশ্বাস করি, যেসব ক্রিয়েটিভ ফেসবুকার এখন টিকটককে অপছন্দ করছেন, তারাহ এক সময় টিকটক দিয়ে অসামান্য সব সৃষ্টিশীল কাজ করবেন।
- টিকটক এড কিভাবে কাজ করে?
- টিকটক আপাততঃ শুধু আমেরিকা আর ইউরোপে এডের টেষ্ট রান করছে। আমার ধারনা, শীঘ্রই তারা তাদের ফিডে এড দেখানো শুরু করবে, কিন্তু সেটা গতানুধিক এড টাইপ থাকবে না। লোকে গতানুধিক এড দেখতে দেখতে বিরক্ত, তারা এখন raw & unedited video দেখতে চায় এড হিসেবে। এ সুযোগটাই টিকটক নেওয়ার প্ল্যান করছে। এটার সফলতার উপর ভিত্তি করে বাকী রিজিওনে রোল আউট করবে।
- কিভাবে সুযোগ নিবে বুঝিনি ভাইয়া!
-সোজা কথায় বল্লে, টিকটকই হবে সবচাইতে সফল মেইন স্ট্রিম সোশাল মিডিয়া, যেখানকার কোন এড হঠাৎ দেখলে মনে হবে ইউজার জেনারেটেড অর্গানিক কনটেন্ট, কিন্তু আসলে সেটা হবে বিজ্ঞাপন।
-দারুন তো!
-হ্যাঁ, তবে কতদিন দারুন থাকবে সেটাই ভাবার বিষয়। কারণ এরপর তো লোকে অরিজিনাল UGC কেও বিজ্ঞাপন বলে ভাবা শুরু করতে পারে। অর্গানিক কনটেন্ট আর পেইড কনটেন্ট এর মাঝে একটা মোটা দাগ আছে, যেটা তখন fine line এ রূপ নেবে। এবং ক্রমেই সরু হতে হতে হয়তো মিলিয়ে যাবে। মানে মানুষ তখন আর অর্গানিক কনটেন্ট আর পেইড কনটেন্ট এর মাঝে পার্থক্য করতে পারবে না।
টিকটক যেভাবে এড দেখাতে পারে তাদের ফিডেঃ
- Brand takeover
- In-feed native video (উপরে এটার কথাই বলেছিলাম)
- Hashtag challenge
- Snapchat-style 2D lens filters for photos.
-এবার টিকটক মার্কেটিং নিয়ে কিছু বলুন।
- গতকাল দেখলাম একটা ছেলে নতুন একটা ভিডিও এডিটিং এপের রিভিউ পোষ্ট করেছে টিকটকে। দেখে মনে হলো পেইড রিভিউ। টিনেজরা এই পণ্যের টিজি, সে হিসেবে এটার রিভিউ তথা মার্কেটিং করার জন্য টিকটক পারফেক্ট একটা জায়গা। এইভাবে টিকটককে লেভারেজ করা যেতে পারে।
তবে টিকটক মূলতঃ ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিংয়ের জন্য বেষ্ট। কারণ সেখানে অনেকেরই ফলোয়ার থাকে রীতিমতো কোটির ঘরে। আমাদের দেশের মামুন নামে একজন টিকটকার আছে, তার ফলোয়ার ১০ মিলিয়ন মানে ১ কোটি+। আরেকজন আছে, অপু! তাকে তো ফেসবুকে অনেকেই বিদ্রুপ করে! তার কিন্ত অফলাইনেও বিশাল ফ্যানবেইজ।
এক আমেরিকান টিনেজার আছে, নাম Charli d’Amelio, তার ফলোয়ার প্রায় ৫২ মিলিয়ন। সেই মেয়ে তার প্রতিটি টিকটক ভিডিওর জন্য প্রায় ৫০ হাজার ডলার চার্জ করে ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং বাবদ। তো আমার মনে হয়, আমাদের দেশেরও টিকটককে এভাবে লেভারেজ করা সম্ভব!
- সোশ্যাল জায়ান্ট কর্তৃক টিকটককে টেকওভার করার সম্ভাবনা কতটুকু?
সত্যি বলতে, ফেসবুক টিকটককে মারাত্নক থ্রেট হিসেবে দেখে। এই কারণেই তারা ২০১৮ থেকে চেষ্টা করছে টিকটককে অধিগ্রহন করার। গত মাসে প্রকাশিত ফোর্বসের একটা প্রতিবেদনে ধারনা দেয়া হয় যে, এই বছরের ভেতরই ফেসবুক টিকটকের আমেরিকান অপারেশন কিনে নিতে পারে।
তার উপর এক্ষেত্রে ট্রাম্পের সমর্থনও পাবে জাকারবার্গ! একই সাথে নিজের কম্পিটিটরকে এলিমিনেট করা + দেশের রাষ্ট্রপতির গুড বুকে থাকা - এক ঢিলে দুই পাখি মারার এই দুর্লভ সুযোগ জাকারবার্গের মত চালাক ব্যবসায়ী ছাড়বে বলে মনে হয় না।
২০১৯ সালে সারা বিশ্বে সর্বোচ্চ ডাউনলোড করা মোবাইল এপের ভেতর প্রথম ৫টি এপের চারটির মালিকই ফেসবুক। শুধু একটার মালিক ফেসবুক নয়। সেই এপের নাম টিকটক। ফেসবুক এটা সহ্য করবে না। আমি জাকারবার্গের জায়গায় থাকলে আমিও করতাম না। সুতরাং আমার ধারনা, সে এবার রীতিমতো কোমর বেধেঁ লাগবে টিকটককে কিনে নিতে। শুরুতে সে টিকটক কিনতে ব্যর্থ হয়েছিলো, সেই ক্ষোভ তো তার রয়েছেই!
গত বছর থেকেই সে জনমত তার দিকে নেবার চেষ্টা করছে - ”টিকটক গনতন্ত্রের জন্য হুমকিসরূপ” - ধরনের বক্তব্য দিয়ে। (গত বছর Georgetown University সে টিকটকের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছে!) অথচ লোকে তো জানে যে আসলে টিকটক গনতন্ত্রের জন্য নয়, তার ব্যবসার জন্য হুমকিসরূপ!
- টিকটিক নিয়ে তো তাইলে চীন-আমেরিকা মধ্যে ভয়াবহ জিওপলিটিক্যাল স্নায়ু-যুদ্ধ চলছে।
-অনেকটা সেরকমই। এখন আবার তারা ভারতের সমর্থনও পেলো। রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়েছে আবার কর্পোরেট দুরভিসন্ধি! ফেসবুকের সাথে সাথে এখন আবার মাইক্রোসফটও টিকটককে কেনার জন্য এক পায়ে খাড়াঁ। তারা অলরেডি টিকটকের US, Canada, Australia, and New Zealand অপারেশন কেনার প্রস্তাব দিয়েছে।
টিকটক যদি তারা কিনে নিতে পারে তবে কনটেন্ট আর ডেটা নিয়ে ফেসবুক আর ইউটিউবের সাথে সোশ্যাল মিডিয়া যুদ্ধে কমপিট করতে পারবে, এটাই মাইক্রোসফটের মূল উদ্দেশ্য। তারা ঘোষণা দিয়েছে, আগামী মাসের ১৫ তারিখের ভেতর টিকটকের ডিল ক্লোজ করবে। তার মানে the clock is TikTok-ing...
মাইক্রোসফট বা ফেসবুক যদি শেষ পর্যন্ত টিকটক না কিনতে পারে তবে প্ল্যান বি হিসেবে আমেরিকা হয়তো তার এলাইদের অনেকেই কনভিন্স করতে শুরু করবে যার যার দেশে টিকটক বন্ধ করতে। মানে এভাবে আমেরিকা টিকটককে মেসেজ দিবে - “আমাদের করায়েত্বে না যদি না আসো তবে আমরাও দেখে নিবো কি করে বিশ্বজুড়ে তোমরা ব্যবসা করো।”
দেখা যাক কি হয়। তবে টিকটক কে কিনবে সেটা নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু আমি চাই মাইক্রোসফট যেন না কিনে। স্কাইপ, নোকিয়া, লিংকডইন - শালারা যেখানেই হাত দিসে সেটাই ধ্বংস করেছে। ওরা টিকটককেও ধ্বংস করবে, আমি মুটামুটি কনফার্ম!
সূত্রঃ ব্লুমবার্গ, বিজনেস ইনসাইডার, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ফোর্বস, দ্য ভার্জ এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন