ফেসবুক-ইউটিউবকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়া টিকটকের দিন কি ফুরিয়ে এলো?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
এক বছরের মাথায় একশো মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার আর বিলিয়ন বিলিয়ন ভিউ। চীন থেকে উঠে আসা এ্যাপটি অল্পসময়েই হয়ে উঠেছে ফেসবুক-ইউটিউবের চক্ষুশূল। আন্তর্জাতিক রাজনীতির খেলায় যদিও এখন দেখছে সে মুদ্রার উলটোপিঠ। সেসাথে আস্তে আস্তে বন্ধ হচ্ছে সম্ভাবনার সকল দুয়ার...
বাংলাদেশে ব্যবহৃত সবচেয়ে জনপ্রিয় এ্যাপগুলোর নামের যদি তালিকা করতে বসি, ফেসবুক আর টিকটকের মধ্যে বেশ একখানা ফাইট হয়ে যাবে। 'কেউ কারে নাহি ছাড়ে, সমানে সমান' রকমের একটি পরিস্থিতি তৈরী হয়েও যেতে পারে। ফেসবুক নিয়ে তো আমরা সবাই জানিই। কীভাবে হার্ভার্ড ড্রপআউট মার্ক জাকারবার্গ হয়ে গেলেন দুনিয়ার অন্যতম সেনসেশন তা সবারই মুখস্থ। সে তুলনায় টিকটক নিয়ে আলোচনা কম হলেও ২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করা একটি এ্যাপ ২০২০ সালে এসেই যে পরিমাণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তা আসলে ঈর্ষণীয়। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু পদক্ষেপে যদিও টিকটক চলে গিয়েছে ব্যাকফুটে এবং হয়ে দাঁড়িয়েছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স টেকনোলজি ব্যবহার করা কোম্পানি বাইট ড্যান্সের অধীনস্থ টিকটক নিয়ে ইদানীং আলোচনা হচ্ছে বেশ জোরেসোরেই।
ডুইয়িন থেকে টিকটক: গোড়ার কথা
প্রথমেই এ কনফিউশনটা পরিষ্কার করে ফেলা ভালো। অনেকেই ভাবেন, ডুইয়িন এবং টিকটক বোধহয় আলাদা। না, এরকম কিছু না। যেহেতু চীন থেকে এই এ্যাপটি যাত্রা শুরু করেছে, চীনে এই এ্যাপটির নাম ছিলো- ডুইয়িন, যার মানে- ছোট ছোট মিউজিক্যাল ভিডিও। এই ডুইয়িন যখন আস্তে আস্তে চীনের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে যায়, তখন এর নাম হয়ে যায়- টিকটক। মানে দাঁড়াচ্ছে, লোকালি একটা নাম এবং ইন্টারন্যাশনালি আরেকটা নাম।
প্রতিষ্ঠাতা ঝাং ইয়েমিং ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে লঞ্চ করেন এ ডট মি। এই 'এ ডট মি' পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে হয়ে যায় ডুইয়িন। প্রথমদিকে তারা কিউকিউ, উইবো এবং উইচ্যাটের মত জনপ্রিয় এ্যাপের সাথে কোলাবোরেট করে বাজারে আসে। কারণ ছিলো অবশ্য। এই এ্যাপগুলো আগে থেকেই বিখ্যাত ছিলো চীনে। ডুইয়িন এদের সাথে মিশে একটা স্পিডি রিকগিনশন পেতে চাচ্ছিলো। এবং তারা পেয়েও যায়। প্লেস্টোরেও বেশ ভালো রিভিউ আসছিলো। যদিও অনেকে ডুইয়িন কে 'মিউজিক-লি'র কপিক্যাট বলেও ধুনো তোলে সে সময়ে। তবে তা হালে অতটা পানি পায়নি। তাছাড়া এ্যাপটির টেকনিক্যাল দুয়েকটা সমস্যাও ছিলো, সেগুলোও ডুইয়িন কর্তৃপক্ষ খুব তাড়াতাড়িই ঠিক করে ফেলেন।
বাকিটা ইতিহাস। বিলিয়ন বিলিয়ন ভিউ হওয়া শুরু হয় টিকটক ভিডিও'র। দেশের গন্ডি পেরিয়ে থাইল্যান্ড, জাপান, ভারত, আমেরিকা তে আসা শুরু করে এ্যাপটি, গ্লোবাল নাম হয়ে যায় টিকটক। চীন থেকে প্রথমে এ্যাপটি আসে থাইল্যান্ডে। এবং থাইল্যান্ডের এক নাম্বার এ্যাপ হয়ে যায় খুব অল্প সময়ের মধ্যেই। ইন্টারন্যাশনালি বেশ ভালো একটা অবস্থান তৈরী হওয়ার পরে টিকটক কর্তৃপক্ষ এ্যাপটিকে নিয়ে আরো রিসার্চ শুরু করে এবং বেশ নতুন নতুন ফিচার আনাও শুরু হয়। ফিল্টার এবং ভিডিও এডিটিং এ বেশ কিছু চমক আসে। লাইভ স্ট্রিমিং এর অপশনও চালু হয়। এই চেঞ্জগুলো আনাতে মানুষ আরো লুফে নেয় টিকটককে। খুব অল্পসময়ের মধ্যেই একশো মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবারে পৌছে যায় টিকটক। এবং পৃথিবীর বহুদেশের প্লেস্টোর ও এ্যাপস্টোরের তালিকার এক নম্বর স্থান দখল করে নেয়। চাইনীজ এ্যাপের মধ্যে টিকটিকই অন্যতম, যারা গ্লোবালি এরকম শক্তপোক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে।
টিকটকের জনপ্রিয়তার কারন
টিকটকের মূল প্রানশক্তি ইয়াং জেনারেশন এবং বিশেষ করে ফিমেল জেনারেশন। বর্তমান প্রজন্ম চটকদার জিনিসপত্র পছন্দ করে। এবং অল্পসময়ে ইন্সটান্ট কিছু রেজাল্ট পেতে চায় তারা। এই জায়গাটিতে হিট করে টিকটক। টিকটকের চটকদার ইন্টারফেস, ভিডিও এডিট করার অজস্র সব ইজি টুলস, এবং মিউজিক লিপসিং এর বিষয়টা এ প্রজন্মের যে মনে ধরবে তা বলাই বাহুল্য। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- নেটওয়ার্কিং। টিকটকে ভাইরাল হওয়া, জনপ্রিয়তা পাওয়া খুব সহজ। যেহেতু অজস্র মানুষ এটিকে ব্যবহার করছে এবং কোয়ালিটি নিয়ে খুব বেশি ভাবতে হচ্ছেনা, তাই প্রচুর কন্টেন্ট আসছে। এবং মানুষও সেটিকে লুফে নিচ্ছে। জনপ্রিয়ও হচ্ছে রাতারাতি।
টিকটিকের ইউজারদের মধ্যে সমাজের প্রান্তিক স্তরের মানুষ বেশি। যাদের সারাদিনই বেশ কষ্টের মধ্য দিয়ে যায়, তারা সময় পেলেই টিকটক এ ঢুঁ মারেন। এবং তারা খুব বেশি উঁচুস্তরের কন্টেন্ট পছন্দও করেনা। লাইট এন্টারটেইনমেন্ট তাদের বেশ পছন্দ। এবং সেরকম লাইট এন্টারটেইনমেন্টের আঁতুরঘর এই টিকটিক। সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর টিকটক ব্যবহার করার কারণে এটা ভাবার কোনো সুযোগ নেই যে অন্য স্তরের মানুষ এই এ্যাপটিকে ব্যবহার করেন না। এই যেমন- অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ক্রিকেট দলের অলরাউন্ডার ডেভিড ওয়ার্নারের কথাই ধরুন না কেন। তিনি টিকটকে ভারতীয় স্টাইলে বিভিন্ন ভিডিও করে ভারতের মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশেও শিল্প-সংস্কৃতি জগতের অনেক মানুষ আছেন যারা টিকটক ব্যবহার করছেন নিয়মিত।
অবস্থাদৃষ্টে এমন দাঁড়িয়েছে, গ্লোবাল রেটিং এ মাঝেমধ্যে ফেসবুক, টুইটারকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে টিকটক। এছাড়া ইউটিউবের একচেটিয়া বাজারেও আক্রমণ করেছে এ্যাপটি। আগে মানুষজন ইউটিউবের পেছনে যে সময়টা ব্যয় করতো, সে সময়টা এখন দুইভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে, টিকটক আসার কারণে। এবং এভাবেই আস্তে আস্তে টিকটক হয়ে দাড়াচ্ছে নেক্সট বিগ থিং। তারই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় টিকটক খুব অল্পসময়েই বড় বড় অনেক টেক-জায়ান্টের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাম্প্রতিক যত বিতর্ক
টিকটকে অশ্লীল ও আপত্তিকর ভিডিও শেয়ার করায় কিছুদিন আগে মিশরের আদালত, ছয় নারীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছে। ইউজারদের কারণে টিকটকের কন্টেন্ট স্টান্ডার্ড বরাবরই লো কোয়ালিটির। এবং সেরকম সেন্সরশিপ বা মনিটরিং না থাকার কারণে সেগুলো ছড়িয়েও পড়ে দেদারসে। যে কারণে টিকটিকের সমালোচনা হচ্ছে বেশ অনেকদিন ধরেই। মিশরের এই ঘটনাটি যেন ভস্মেই আরেকটু ঘি ঢেলেছে।
অনেক বেশি এডিক্টিভ হওয়ার কারণে মানুষ প্রোডাক্টিভ কাজকর্ম বাদ দিয়ে এই এ্যাপ নিয়েই পড়ে থাকছে। এবং কোনোভাবেই এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা কেউ। যেটা আরেকটি চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সবার জন্যেই। অনেক ক্ষেত্রে, ফেসবুক ইউটিউবের চেয়েও বেশি এডিক্টিভ এই টিকটক।
ভারত সম্প্রতি টিকটক'কে সাময়িক ব্যান করেছে তাদের দেশ থেকে। সাইবার সিকিউরিটি সহ অন্যান্য নিরাপত্তার ঝুঁকির সম্ভাবনা তুলে টিকটককে ব্যান করা হয়েছে। যা টিকটকের ওপর বেশ বড়সড় এক ধাক্কা। কারণ ২০১৯ সালেই ভারতে টিকটক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিলো ৩২৩ মিলিয়ন। ২০২০ সালের প্রথম কয়েক মাসেই ভারতে টিকটক এ্যাপ ৬১১ মিলিয়নের বেশি ডাউনলোড করা হয়। যা সারাবিশ্বের ডাউনলোডের প্রায় ৩০.৩% এর কাছাকাছি। সেখান থেকে এই ব্যান তাদেরকে ধাক্কা দিয়েছে বেশ জোরেসোরেই। টাকার হিসেবে প্রায় ৬ বিলিয়নের কাছাকাছি লস হতে পারে এই ব্যানের ফলে। যদিও অনেকে বলেছেন, টিকটক ব্যানের পেছনে বড় কারন- ভারত ও চীনের রেষারেষি। সম্প্রতি লাদাখের গালওয়ান উপত্যকার ঘটনাটাই সম্ভবত ভারতকে এই অবস্থানে যেতে বাধ্য করেছেন, সে ধারণা অনেকের।
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পও সম্প্রতি বললেন, তারাও খুব তাড়াতাড়ি টিকটক নিষিদ্ধ করবেন। তাদের অভিযোগ, টিকটকের মাধ্যমে চীন অনেকদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নজরদারি চালাচ্ছে। যদিও টিকটক এর সিইও কেভিন মায়ের বরাবরই বলছেন, টিকটকের এরকম কোনো নজরদারির অপশন নেই। তাও এটি প্রায় নিশ্চিত, আমেরিকাতেও ব্যান হতে যাচ্ছে টিকটক। সে দেশে বর্তমানে টিকটকের সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা আট কোটি। এবং আমেরিকাতে ব্যান হলে সেটি টিকটককে আরেকটু ব্যাকফুটে ঠেলে দেবে সেটা বলাই বাহুল্য।
শেষের কথা
বাইট ড্যান্স কোম্পানির নিয়ন্ত্রণাধীন 'টিকটক' গত বছরে প্লেস্টোরের টপ-ফাইভ মোস্ট ডাউনলোডেড এ্যাপস এর তালিকার একমাত্র এ্যাপ ছিলো যেটা ফেসবুকের মালিকাধীন নয়। তাছাড়া ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে জার্নি শুরু করে ২০১৮ সালেই এ্যাপটির ১৫০ মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার হয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে অসাধারণের চেয়েও বেশি। যেকোনো এ্যাপেরই প্রথম সময়টা বেশ ঝক্কির হয়। কিন্তু সেই ধারণাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে টিকটক খুব অল্পসময়েই উঠে এসেছে এমন উচ্চতায়, যেটাকে সমীহ করতে বাধ্য হচ্ছে দুঁদে টেক জায়ান্টরাও। যদিও চীনের রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে ভুগতে হচ্ছে এই এ্যাপটিকে, তবে আশা করাই যায়- টিকটক আবার তার আগের অবস্থানে ফিরবে। তবে সে সাথে একটাই ইচ্ছে সবার, টিকটক যাতে সুস্থ কন্টেন্ট প্রমোট করে। অসুস্থ কন্টেন্ট ও ইউজারদের যে মিছিল এ এ্যাপটিকে কেন্দ্র করে, সেই জায়গাটিতেও আরেকটু কঠোর হওয়া উচিত এই টেক প্রডিজির। তাহলেই কোয়ালিটি ও কোয়ান্টিটির একটি ভালো ব্যালেন্স আসবে। তৈরী হবে বিনোদনের একটি সুস্থ মাধ্যম।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন