কেউ শখ করে কি রাস্তায় রাস্তায় কাটিয়ে দিতে চায় একজনম? কোথাও আশ্রয় না পেয়ে যে পথে তারা মাথাটা রাখে, সেখানেও শান্তি নেই। পুলিশ এসে মাঝে মধ্যে মারধোর করে...
ঢাকা শহর অদ্ভুত এক জায়গা। যে ফুটপাত দিয়ে দিনের বেলা মানুষ হাঁটে রাতে সে জায়গায় কত লোকে ঘুমায়! অথচ, এদের সবার জীবন এমন হওয়ার কথা ছিল না। জন্ম থেকেই যে এরা এই জীবন বেছে নিয়েছে এমন নয়৷ পরিস্থিতির কারণে অনেকের অবস্থান হয়েছে আজ ফুটপাতে। এদের দিকে লোকে ঘৃণাভরে তাকায়, কখনো এদেরকে গালাগাল দেয়। এরা জীবনের প্রতি হতাশ, প্রবল বিতৃষ্ণায় কাটে একেকটা দিন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই নেশাগ্রস্ত হয়ে দিন কাটিয়ে দেয়। ফুটপাতের এসব মানুষকে টোকাই বলে অনেকে।
টোকাই শব্দটি প্রচলিত করেন রফিকুন নবী। এই চরিত্রের পেছনে একটি গল্প আছে। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে মুখর রাজপথে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে মিছিলগুলির প্রথম সারিতে থাকত পথের শিশুরা। তাদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন রফিকুন নবী। একই সময়ে তাঁর বাসার পাশেই দেখেন এরকম আরেকটি শিশু। পাড়ার লোকদের তামাশার প্রশ্নগুলিতে নির্ভেজাল, বুদ্ধিদীপ্ত ও মজার উত্তর দিত সে। তখনই রফিকুন নবী প্রথম ভাবেন টোকাইয়ের কথা।
এরপর যুদ্ধ হলো। দেশ স্বাধীন হলো। ১৯৭৮ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় রফিকুন নবীর টোকাই চরিত্রের কার্টুন প্রথম প্রকাশিত হয়। টোকাই চরিত্রটি বাস্তবের এমন কিছু পথশিশুর প্রতিনিধিত্ব করে, যারা, মানুষের ফেলে দেয়া আবর্জনা, কুড়িয়ে নিয়ে যায় বা টুকিয়ে নিয়ে যায়। বাস্তবের সেসব পথশিশুকে প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে টোকাই'র বাসস্থান হলো আস্তাকুঁড়ে বা ডাস্টবিনের কাছাকাছি, ফুটপাত, কিংবা পতিত বড় পাইপ। টোকাইয়ের পরণে থাকে লুঙ্গি।
তবে টোকাইয়ের মুখ দিয়ে রফিকুন নবী বিদ্রুপাত্মক ডায়ালগ দিয়েছেন, বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপে টোকাই সমাজের বাস্তবতার কথা বলেছে কার্টুন চরিত্রের মধ্যে দিয়ে। আজকের দিনে অবশ্য টোকাইদের কথা ভাবার মতো তেমন কেউ নেই। কারণ, এরা নেশা করে, রাস্তাঘাটের ময়লা থেকে বোতল ফতল কুড়ায়, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে। মাঝে মধ্যে এরা মার খায় পুলিশের হাতে। কখনো ঝাড়ি খায় ভদ্রলোকদের হাতে। দিনে একবেলা খাবারও জুটাতে কষ্ট হয়ে যায়। ভদ্রলোকদের কাছে খাবারের টাকা চেয়ে বসলে তারা বিরক্ত হয়, খাবার চাইলেও ত্যক্ত হয়। সব মিলিয়ে এদের জীবন খুব একটা সুখকর না।
সম্প্রতি একটি ভিডিও অনেক ছড়িয়েছে দেখলাম। একজন টোকাই কাঁদতে কাঁদতে নিজের দুঃখের কথা বলছে। তার কথা একেবারে অমূলক নয়। মায়ের গর্ভ থেকে বেরিয়েই তো সে টোকাই হয়নি। কেউ শখ করে কি রাস্তায় রাস্তায় কাটিয়ে দিতে চায় একজনম? এর পেছনে গল্প আছে, গল্প থাকে। সেই গল্প না জেনেই সবাই টোকাইদের ঘৃণাই করে বেড়ায়। কোথাও আশ্রয় না পেয়ে যে পথে তারা মাথাটা রাখে, সেখানেও শান্তি নেই। পুলিশ এসে মাঝে মধ্যে মারধোর করে।
এত কিছুর পরেও তারা হাসি মুখে থাকে। অন্তরজ্বালা কাউকে দেখায় না। একদিন নিশ্চয়ই ভাল দিন আসবে এই স্বপ্ন দেখে তারাও। সরকার একদিন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিবে, এমন আশা করে তারাও। কমলাপুরের রাস্তা দিয়ে দীর্ঘদিন আমি যাতায়াত করেছি। এখানে অনেক ভাসমান মানুষ থাকে। তাদেরকে দেখেছি৷ অনেক ছোট ছোট পথশিশুদের দেখেছি পলিথিনে করে জুতার আঠা দিয়ে নেশা করে। একটু যারা বড় বয়সে তারাও কেমন নির্বিকার হয়ে যায়। একটু রুক্ষ, কঠিন আচরণ। কিন্তু তারা এমন কেন হয়ে যায় সেটা কখনো তলিয়ে দেখতে যাইনি। অথচ, এই প্রত্যেকটা মানুষের পেছনে একটা গল্প আছে৷ সেই গল্প নিদারুণ, ভীষণ করুণ এবং দুঃসহ৷
সুজন নামের একজন টোকাইয়ের কথা বলা যেতে পারে। তার বাবা মার প্রতিদিন ঝগড়া হতো। একদিন তার বাবা রাগের মাথায় তার মাকে তালাক দিয়ে দিল। তারপর সেই লোক বিয়ে করলো নতুন করে, যাকে বিয়ে করলো সেই মেয়েটি সুজনের বড় বোনের সমান। সুজনের মা আত্মহত্যা করলো। সুজন রাগে দুঃখে সেই যে বাড়ি ছাড়লো, আর বাড়ি ফেরা হলো না তার। পথই হলো তার ঠিকানা।
সুজনের মতো সবারই আলাদা একটা যন্ত্রণাদায়ক অধ্যায় আছে। এরা এই দেশেরই মানুষ, অন্য দেশ থেকে তো তারা আসেননি। তাদের জন্য আসলে কোনো ব্যবস্থা কি কেউ নিয়েছে কখনো? এদের ভোটের বাজারে হয়ত দাম নেই, কিন্তু এরাও মানুষ৷ তবে তাদের মানুষ হিসেবে ট্রিট হতে দেখি না। সরকার বদলায়, এমপি বদলায়, নেতা বদলায়, এদের জীবন আর বদলায় না। জন্ম বড়ই রহস্য, মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে কেউ নেতা হয় না যেমন, কেউ হয় না এলিট শ্রেণীর মানুষ, তেমনি টোকাই হওয়াও কারো চয়েজ ছিল না...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন