ট্রেনে পাথর বা ইট ছোঁড়াতে যে ক্ষয়ক্ষতি হয় তার জন্যে রেলওয়ের বার্ষিক বাজেট ২ কোটি টাকা! অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫৫০০০ টাকা! কিন্ত তাতে কি বন্ধ করা যাচ্ছে পাথর ছোঁড়া?
ছোটবেলায় ঈশপের একটা গল্প পড়েছিলাম। সবাইই শুনেছেন হয়তো। একদল দুষ্টু কিশোর পুকুরে ইট ছুড়ে মজা পায়। এ অবস্থা চলতে থাকলে একদিন একটা বৃদ্ধ ব্যাঙ মাথা তুলে বলে, 'হে বালকের দল, এই নিষ্ঠুর খেলা বন্ধ করো! তোমাদের জন্য যা খেলা, আমাদের জন্য তা জীবন-মৃত্যুর ব্যাপার'।
আমি রংপুর আসার চারদিন পর তৃষা (আমার স্ত্রী) রংপুর আসে। নতুন এক জায়গায় সেটেল হওয়া, সব গুছিয়ে নেওয়ার হ্যাপা ওকে দিতে চাইনি বলে সাথে আনিনি। ট্রেনে অনলাইনে টিকেট পাওয়াই মুশকিল। ও একা একা কেটে উঠেছে। এসি পায়নি। তাও কেটেছে। সকালে ট্রেন ছাড়া কনফার্ম করেছে ফোনে। তার কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ফোন দিয়ে কান্না করতে করতে বললো, 'রনি, কেউ বাইরে থেকে ঢিল ছুঁড়ে মেরেছে। মাথার পিছন দিয়ে রক্ত পড়ে জামা ভিজে যাচ্ছে। বুঝতে পারতেছি না কী করবো। আনকনশাশ হয়ে যেতে পারি। তোমাকে ফোন করলাম। মা'কে ফোন দিবো। যদি আর না বাঁচি। আমার অপজিট সিটের এক লোককে আমার ফোন দিয়ে রাখতেছি। কিছু করার থাকলে উনাকে বইলো'।
আমি কিছুক্ষণ বুঝিনি কী বলবো। ওর ফোনে ব্যাক করলাম। অপরিচিত একজন ধরলো। বললাম তৃষাকে দিতে। বললাম, দ্রুত কেউকে দিয়ে চেন টানিয়ে ট্রেন থামিয়ে নেমে পড়ো। কাছাকাছি হাসপাতালে চলে যাও। নতুবা শকে চলে যাবা। কতখানি রক্ত পড়েছে আনুমানিক? বললো, 'নেমে গেলে হাসপাতালে কে নিয়ে যাবে? রাস্তায় আনকনশাশ হয়ে গেলে? তখন কোথায় পড়ে থাকবো জানতেও পারবা না। যা হয় ট্রেনেই থাকি। ট্রেনের কিছু কর্মরত লোক টিস্যু দিয়ে রক্ত মুছছে এখন। দেখি'।
আমি দ্রুত বাপিকে ফোন দিয়ে বললাম, যশোর নেমে গেলে স্টেশন থেকে কেউ নিয়ে হাসপাতালে যেতে পারবে কী না। বাপি বললো, দেখতেছে ফোন দিয়ে। তখন সকাল ৮ টাও বাজেনি। তৃষাকে ফোন দিলাম। অন্য কেউ ধরলো। তাকে বুঝিয়ে বললাম, চেপে ধরে রক্ত আটকানোর ট্রাই করতে। কী বুঝছে কে জানে। পরে ফোন দেই। আর কেউ ধরে না। দিগ্বিদিক শূন্য লাগতেছে তখন। প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ মিনিট এভাবে কেটেছে। বা বেশিও। ঠিক মনে নেই। পরের ফোন যখন পাই তখন বললো, 'যশোর তো পার হয়ে গেছি। রক্ত বন্ধ হয়েছে বললো ট্রেনের টিটি, সিকিউরিটি গার্ডেরা'। জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় নামতেছো? বললো, 'চলে আসি, রনি, যদি পারি। মাঝ রাস্তায় নেমে বাড়ি ফিরতেও সেই একই পরিমান জার্নি। আর এতদূর বাপির আসা যাওয়া সমানই হবে। লাভ হবে না।'
আমার ঠিক মনে নেই আর কী কী বলেছিলাম। এটুকু মনে আছে, বলেছিলাম ফ্রুট জুস, কোক, মিস্টি এরকম যা পাও, বিভিন্ন স্টেশনে থামলেই আশেপাশের কেউকে দিয়ে কিনিয়ে খেতে থাকো। কাছে যা আছে পারলেই খেয়ে নেও। ফ্লুইড রিপ্লেসমেন্ট সবচেয়ে জরুরি। আর পালস নিজে দেখে বোঝার চেষ্টা করো শকে যাবার অবস্থায় চলে যাচ্ছো কী না। অসুবিধা বুঝলেই কেউকে দিয়ে চেইন টানাও।
সারাদিন মাথায় কিছুই কাজ করেনি। ৯ ঘন্টার বিশাল জার্নি। ওইদিনই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা'র মত প্রথম অফিশিয়াল দায়িত্ব ছিলো। সেই দায়িত্বও কোর্সমেট বড় ভাইকে দিয়ে অনেক আগে থেকেই স্টেশনে বসে ছিলাম। যখন পৌছালো তখন যতটা অস্বাভাবিক ভেবেছিলাম, ততটা না। শুধু ঘাড় কাৎ করে হাঁটছিলো। জিজ্ঞাসা করলাম, ট্রেনে আর কী কী হয়েছে। বমি হয়েছে কী না। ভার্টিগো ছিলো কী না। বললো, 'ট্রেনে ফার্স্ট এইড বক্সে কিচ্ছু নেই, রনি। শুধু স্যাভলন, কটন আর ব্যান্ডেড ছাড়া আর কিছু নেই। ওসব দিয়েই মুছে বেঁধে দিয়েছে'। আমার কাছেও আপাতত কিছু নেই তখন। সরাসরি রংপুর মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে ঢুকলাম। বললো, স্টিচ দিয়ে দিতে। তৃষা কিছুতেই স্টিচ দিবে না। বলে, রক্ত যদি আবার আসে তো দিবো, নইলে না। কাটা জায়গার চুলও ফেলতে দিলো না! জাস্ট ড্রেসিং করিয়ে আনলাম। ইমার্জেন্সি হিমোগ্লোবিন লেভেল দেখতে পপুলারে ব্লাড দিলাম। পরে দেখেছি ৯.৭ গ্রাম/ডেসিলিটার। প্রতিবছর একবার টুকটাক চেক আপ করাই। কখনো ১২ এর কম পাইনি আমি। ওও পায়নি। দ্বিতীয়দিন সিটি স্ক্যান করলাম। সেটা স্বাভাবিক পেয়েই নিশ্চিত হয়েছি।
নিউজে দেখলাম গতকাল সুবর্ণ এক্সপ্রেসে পাথর ছুড়ে এসির গ্লাস চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে। হঠাৎ মনে হলো দেশে এসব নিয়ে আইন কানুন আছে কী-না চেক করে দেখি। দেখতে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। রেলওয়ে আইনের ১২৭ ধারায় ট্রেনে পাথর ছুড়লে যাবজ্জীবন জেলসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। পাথর নিক্ষেপের ফলে যদি কারও মৃত্যু হয়, তাহলে ৩০২ ধারামতে, দোষীদের মৃত্যুদণ্ডের বিধান পর্যন্ত রয়েছে। শুভঙ্করের ফাঁকি হলো- এদের ধরার কোনো ব্যবস্থা নেই। কেউ কখনো এই শাস্তির শিকার হয়েছে বলেও কোনো ডকুমেন্ট খুঁজে পাইনি নেটে। তবে বিভিন্ন সময়ে খবর হয়েছে এরকম কিছু পুরাতন নিউজ পেলাম নেটে। ২০১৩ তে ইঞ্জিনিয়ার প্রীতি দাস মারা যান বাইরে থেকে ছোড়া পাথরের আঘাতে। তার আগের বছর মারা যান শাহাদাত হোসেন নামে একজন রিকশাচালক। ২০১৮ তে বায়েজিদ নামে একজন ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মারা যান পাথরের আঘাতে। ২০০৪ এ সঞ্জিত নামের একজনের দুই চোখ অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। পরপর নামলে এরকম রিপোর্ট আসতেই থাকে। কেউ আইসিইউতে ছিলো, কারো কান বা নাক কেটে ফেলতে হয়েছে, এরকম।
আরো একটা জিনিস পড়ে অবাক হয়েছি খুব৷ ট্রেনে পাথর বা ইট ছোড়াতে যে ক্ষয়ক্ষতি হয় তার জন্যে বার্ষিক বাজেট ২ কোটি টাকা! সেটা ২০১৮ সালের। এখন হয়তো আরো বেশি। আর না বাড়লেও প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫৫০০০ টাকা! এসব দেখার কেউ নেই। আমিও এসব লিখতে চাইনি। পরে মনে হলো অন্তত পরিচিতজনেরা পড়লেও তারা সাবধান থাকবে। কার্যত এসিতেও জানালার পাশে বসবেন না। কারণ এত বড় ইটের টুকরা ছুঁড়ে মারে যে কিছু না হলেও কাঁচ ভেঙে দুই চোখ অন্ধ হয়ে যেতে পারে। তৃষাকে বলেছি, তুমি একদিক থেকে বেঁচে গেছো। সামনে থেকে পাথরটা লাগলে চোখ-কান-নাকের কিছু একটা যেত।
আমার একটা প্রস্তাবনা আছে। ট্রেনের দুই পাশে ক্যামেরা সেট করা একটা উত্তম ব্যবস্থা হতে পারে। যেখান থেকে ঢিল ছোড়া হবে সেখানকার পুলিশকে সিসিটিভি ফুটেজ পাঠিয়ে দিলেই হবে। খুব সহজে এসব কিশোর বা এডাল্ট অপরাধীদের আইডেন্টিফাই করা যাবে। এরা সাধারণত লোকালই হয়। ট্রেনে ইট বা পাথর মারার 'আনন্দ' নিতে কেউ আরেক এলাকা থেকে আসে না। দৈনিক ৫৫০০০ টাকা দিয়ে একেকটা ট্রেনে এ ব্যবস্থা অনায়াসেই করা যাবে।
রংপুরে ইমার্জেন্সিতে অপেক্ষা করার সময়ে হ্যান্ডব্যাগ থেকে মাথার ব্যান্ড আর দু'টো টিস্যু বের করে দিয়ে বললো, 'ছবি তুলে রাখো তো। বেঁচে যখন গেছি, মা কে দেখাতে পারবো'।
বেশ কয়েকদিন হয়ে গেছে। ঘুরছি, ফিরছি। ভালো আছি। এরপর থেকে তৃষা প্রতিদিনই বলছে, রনি, যত পারি কোক খেয়ে নেই। কবে মরে টরে যাই কে জানে!
বাই দ্যা ওয়ে, ঈশপ খ্রিষ্টপূর্ব ৫৬৪ সালে মারা গেছেন৷ তার গল্পগুলো কবে মারা গেছে জানি না।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন