এই হোটেলের বিশেষ ধরনের বৈশিষ্ট্যের কারণে দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ আসতো নিয়মিত। কিন্তু সেই বৈশিষ্ট্যই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে সম্প্রতি!
একটা সময় ছিলো, যখন খাবারের রেস্টুরেন্ট আর চায়ের দোকানকে কেন্দ্র করেই শিল্প, সাহিত্য আর গল্পের আসর বসতো। মান্না দে তো বিখ্যাত 'কফি হাউজ' গানে গেয়েছেনও- 'একটা টেবিলে সেই তিন চার ঘন্টা, চারমিনার ঠোঁটে জ্বলতো।'
তবে এখন ভিন্ন সময়, ভিন্ন স্রোত। মানুষজন প্রযুক্তির হাতেই নিজেদের ন্যস্ত করেছে। আড্ডার স্থান পরিবর্তিত হয়েছে। মানুষ ক্রমশই ঘরকুনো হচ্ছে। সে সাথে করোনাভাইরাস এসে মানুষের ঘরকুনো হওয়ার বিষয়টিকে নিয়ে গেছে অন্য এক পর্যায়ে। তবু প্রেক্ষাপট যাই হোক না কেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আপনি এমন সব রেস্তোরাঁ দেখবেন, যেগুলো বহু স্মৃতিবিজড়িত। স্মৃতির আড়ত যেন একেকটি জায়গা। কালের সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে যারা, একান্ত নিভৃতে। এরকমই এক জায়গা ছিলো পাবনার ঈশ্বরদীর তৃপ্তি হোটেল।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করার ২ দিন পর ১৯ ডিসেম্বর এই হোটেলটি চালু হয়। আবদুর রহিম নামের এক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে হোটেলটি। ঐতিহাসিক ঈশ্বরদী মুক্ত দিবসের দিনই (১৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১) এই হোটেলটির যাত্রা শুরু হয়। যদিও ঘটনাটি কাকতালীয়। তবুও এলাকাবাসী মনে রেখেছে বিষয়টিকে৷
এই ৪৯ বছরের সময়কালে অনেক মানুষই এসেছেন এখানে। দেশের খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী অনেকেরই পদচারণা পড়েছে এই হোটেলে। সাহিত্যিক আনিসুজ্জামান, কলামিষ্ট রণেশ মৈত্র, শাহরিয়ার কবির, লেখক-সাংবাদিক কামাল লোহানীসহ অনেক মানুষই এসেছেন এখানে। বিদেশ থেকে মানুষ এলেও খুঁজে নিতেন এই তৃপ্তি হোটেলকে৷ বিবিসি থেকে শুরু করে ইত্যাদি, অনেকেই তুলে ধরেছে এই হোটেলকে।
তৃপ্তি হোটেলের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, যেটা এই হোটেলকে দিয়েছে অন্যরকম এক খ্যাতি, সেটাই বলা হয়নি এতক্ষণ। এই হোটেলের নেই কোনো দরজা! চমকে যাওয়ার মতোই তথ্য এটি। এ বিষয়ে হোটেলের বক্তব্যও বেশ সুন্দর। কোনো দরজা তারা রাখেননি কারণ তারা চান না, খদ্দের আর তাদের মধ্যে কোনো প্রাচীর থাকুক। এছাড়াও হোটেল খোলা থাকে দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টাই। মানে যখনই আপনি আসেন না কেন, তৃপ্তি হোটেল আপনার জন্যে সবসময়েই উন্মুক্ত।
এই বৈশিষ্ট্যই তৃপ্তি হোটেলকে করেছিলো স্বকীয়। কিন্তু এই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যটিই আর নেই। কিছুদিন আগে তৃপ্তি হোটেলে যুক্ত হয়েছে দরজা আর শাটার। যেটা চমকে দিয়েছে স্থানীয় মানুষজনকে। মানুষজন বিমর্ষও হয়েছে, উনপঞ্চাশ বছর ধরে চলে আসা এই ট্রেডিশন বন্ধ হয়ে যাওয়াতে। কিন্তু তৃপ্তি হোটেলের মালিকপক্ষ জানালেন, আর কিছু করারও ছিল না। স্থানীয় নেশাখোর যুবকেরা এখানে এসে রাতে উৎপাত করতো। বাধ্য হয়েই তাই দোকানে লাগাতে হয়েছে দরজা। বন্ধ করতে হয়েছে উচ্ছৃঙ্খলদের অনুপ্রবেশ।
সে সাথে চিরতরে বন্ধ হয়েছে এক অন্যরকম সংস্কৃতিও!
(তথ্য কৃতজ্ঞতা- সমকাল)
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন