বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়েই সমালোচনার অন্ত নেই, সেখানে শান্ত খানের মতো অভিনয়ের 'অ' না জানা একজনকে কীভাবে সেলুলয়েডের বঙ্গবন্ধু হিসেবে মেনে নেয়া সম্ভব?
পঁচাত্তর থেকে ছিয়ানব্বই পর্যন্ত ভীষণ অস্থির একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে গেছে দেশ, বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করাটা তখন নিষিদ্ধ ছিল, জয় বাংলা শ্লোগানটা মিলিয়ে গিয়েছিল হাওয়ায়। সপরিবারে যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল নৃশংসভাবে, তারা মুক্তভাবে ঘুরে বেড়িয়েছে দেশে, অনেকে দূতাবাসের চাকরি নিয়ে নিরাপদে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে, কেউ কেউ আবার রাজনৈতিক দল খুলে এমপি-মন্ত্রীও হয়েছে। কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারী করে খুনীদের বিচার করা যাবে না- এই মর্মে আদেশ দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের চরম দুঃসময় ছিল সেই দিনগুলোতে।
সেই আওয়ামী লীগ গত বারো বছর ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায়। দেশে বিরোধী দল বলতে কিছু নেই, সরকারও আওয়ামী লীগ, বিরোধী দলও আওয়ামী লীগ। কাজেই বসন্তের কোকিলদের মেলা বসেছে দলটাতে। সবাই এখন নিজের আখের গোছাতে পাল তোলা নৌকায় উঠে বসেছে, 'জয় বাংলা' আর 'জয় বঙ্গবন্ধু' শ্লোগান দিয়ে যত রকমের অসাধু কার্যক্রম চালানো যায়, সবই করছে কিছু লোক। নিজেদের বিশাল বঙ্গবন্ধুপ্রেমী হিসেবে প্রমাণ করতে গিয়ে উল্টো বঙ্গবন্ধুকেই ঠাট্টার পাত্রে পরিণত করছে এরা।
'টুঙ্গিপাড়ার মিয়া ভাই' শিরোনামের একটা সিনেমার কাজ শুরু হয়েছে সম্প্রতি। প্রযোজক সেলিম খানের ছেলে শান্ত খান এবং শিশুশিল্পী থেকে নায়িকা হওয়া দিঘী সেই সিনেমায় অভিনয় করছেন। সেলিম খান নিজেই নাকি সিনেমাটা পরিচালনা করবেন। সিনেমা নিয়ে তার টনটনে জ্ঞানের প্রমাণ পেয়েছিলাম নকল সিনেমা নিয়ে তার বক্তব্যে। তামিল একটা সিনেমা থেকে ফ্রেম টু ফ্রেম কপি করে সেটার বাংলা ভার্সন বানানোর পরেও প্রযোজক সেলিম খান জোর গলায় বলছিলেন- "তামিল তো একটা ভাষা, বাংলা আরেকটা ভাষা। তাহলে তামিল সিনেমার গল্পে বাংলা সিনেমা বানালে এইটা কপি কিভাবে হয়? কপি মানে কি? আমি বাংলায় কথা বলতেসি, আপনি বাংলায় কথা বলতেসেন, এইটা হলো কপি।"
সিনেমায় বঙ্গবন্ধুর ভূমিকায় অভিনয় করবেন সেলিম খানের ছেলে শান্ত খান। বাবার টাকার জোরে নায়ক হওয়া এই তরুণের 'প্রেম চোর' নামে একটা মুক্তি পেয়েছিল কিছুদিন আগে। পুরো সিনেমা যারা দেখেছেন, তাদেরকে ধৈর্য্যের জন্য একটা অ্যাওয়ার্ড দেয়া উচিত। আমি তো ট্রেলারটাই অর্ধেকের বেশি সহ্য করতে পারিনি। সেই সিনেমার ট্রেলারে অভিনয় আর নাচ- দুটোরই সাড়ে সর্বনাশ করে ছেড়েছিলেন শান্ত খান, এক্সপ্রেশন দেখে রোবট সোফিয়ার সাথে তার মুখের আদলের খুব একটা তফাৎ পাওয়া যাচ্ছিল না।
অথচ মাছরাঙা টেলিভিশনে এসে এক সাক্ষাৎকারে শান্ত খান দাবী করেছিলেন, তিনি নাকি নায়ক হবার আগে অভিনয় আর নাচের তালিম নিয়েছিলেন। তারপরেই সিনেমায় নাম লিখিয়েছিলেন। তালিম নেয়ার পরেও যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে শান্ত খানের উদ্দেশ্যে গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর সিনেমার রামাধির সিংয়ের মতো করেই বলি- তুমসে না হো পায়েগা বেটা। সবাইকে দিয়ে সবকিছু হয় না। বাংলা সিনেমা এমনিতেই ধ্বংস হয়ে গেছে, সেটাকে ফুটবল বানিয়ে লাথি না মেরে শান্ত খানের উচিত অন্য কিছু করার চেষ্টা করা।
'টুঙ্গিপাড়ার মিয়াভাই' সিনেমার ফার্স্ট লুক পোস্টারেও শান্ত খানকে দেখে 'সহমত ভাই' গোত্রীয় কোন পাঁতি নেতার মতোই মনে হলো। ভারী ফ্রেমের চশমা পরে শার্টের হাতা গোটালেই যে বঙ্গবন্ধু সাজা যায় না- এটুকু তার বোঝা উচিত। বাবার টাকা থাকলে সিনেমার নায়ক হওয়াটা ওয়ান-টু'র ব্যাপার, কলকাতা থেকে নামীদামী আর্টিস্টকেও উড়িয়ে আনা যায়, সানি লিওনকে দিয়ে আইটেম সং করানো যায়, দেবকে দিয়ে নিজের সিনেমার প্রমোশন করানোটাও ডালভাত টাইপের ব্যাপার। কিন্ত টাকা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রকে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করা যায় না, সেটার জন্য কঠোর পরিশ্রম লাগে, মেধা লাগে, আত্মত্যাগের প্রয়োজন হয়।
বঙ্গবন্ধু কি হেলাফেলা করার মতো কোন চরিত্র? এই চরিত্রের গভীরতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আন্দাজ আছে সেলিম খান বা শান্ত খানদের? মন চাইলাম, আর নিজেকে হাজির করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটা সিনেমা বানিয়ে ফেললাম- ব্যাপারটা কি এতই খেলো? আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেছে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় খরচে বড় বাজেটের একটা সিনেমা বানানোর পরিকল্পনা নিয়েও অনেকগুলো বছর তারা সময় নিয়েছে। পরিচালক হিসেবে শ্যাম বেনেগালকে দায়িত্ব দেয়ার পরে তিনিও লম্বা সময় ধরে প্রতিটা চরিত্রের জন্য অভিনেতা-অভিনেত্রী বাছাই করেছেন, কারন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বানানো সিনেমায় কোন ভুল করা যাবে না- এটা ভিনদেশী বেনেগালও জানেন। কিন্ত সেটা কি সেলিম খান বোঝেন?
শিশুশিল্পী হিসেবে তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন দীঘি। গ্রামীনফোনের বিজ্ঞাপন দিয়ে যাত্রা শুরু করা দীঘি মাঝের অনেকটা সময় মিডিয়া থেকে দূরে ছিলেন, পড়াশোনার কারনেই এই দূরত্ব বলে জানিয়েছিলেন তিনি। নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছেন তিনি, শান্ত খানের সঙ্গেই ৫/৬টা সিনেমায় জুটি বেঁধে ফেলেছেন ইতিমধ্যেই। সেগুলোর একটা হচ্ছে 'টুঙ্গিপাড়ার মিয়া ভাই'। এই সিনেমায় দীঘি অভিনয় করবেন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের চরিত্রে। আমি জানতে চাই, অভিনয়ের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা লম্বা সময়ের অভিজ্ঞতা না থাকা দীঘি কীভাবে ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা চরিত্রে অভিনয় করবেন? বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে এই নারীর যে প্রত্যক্ষ্য অবদান, সেটাকে পর্দায় চিত্রায়িত করার সামর্থ্য কি সেলিম খানের আছে? আমার উত্তর হচ্ছে, নেই। কানাকড়িও নেই।
শ্যাম বেনেগাল যে সিনেমাটা বানাচ্ছেন, সেটায় বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করবেন আরিফিন শুভ, ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের ছোটবেলার চরিত্রে সেখানেও দীঘিই অভিনয় করবেন, আর প্রাপ্তবয়স্ক ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের চরিত্রে দেখা যাবে নুসরাত ইমরোজ তিশাকে। অল্প বয়সের চরিত্রে অভিনয় করা আর প্রাপ্তবয়স্ক চরিত্রে গাম্ভীর্যপূর্ণ আচরণ এবং ইমোশনগুলোকে ফুটিয়ে তোলার মধ্যে যে আকাশ-পাতাল তফাৎ আছে, সেটা পাগলেও জানে। বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকে আরিফিন শুভ'র উপস্থিতি নিয়েই সমালোচনার অন্ত নেই, সেখানে শান্ত খানের মতো অভিনয় না জানা একজনকে কীভাবে সেলুলয়েডের বঙ্গবন্ধু হিসেবে মেনে নেয়া সম্ভব?
পুরো ব্যাপারটা একটা পলিটিক্যাল শো অফ ছাড়া সম্ভবত আর কিছুই নয়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সিনেমা বানিয়ে সেলিম খান নিজেকে জাতির পিতার বিরাট ভক্ত হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছেন, হয়তো তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে সেটা বাড়তি তেল-ঘি যোগ করলেও করতে পারে। কিবত সেজন্য তিনি যেভাবে বঙ্গবন্ধুকে ব্যবহার করতে চাইছেন, সেটা প্রচণ্ড দৃষ্টিকটু। বঙ্গবন্ধু যে ঠাট্টা তামাশা বা ফাজলামি করার বস্তু না, সেটা প্রত্যেক বাঙালির জানা থাকা দরকার। ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে চাইলে অন্য কিছুকে ব্যবহার করুন, বঙ্গবন্ধুর নামটাকে সিঁড়ি বানাতে গিয়ে ইতিহাসের এই মহানায়ককে হাসির বস্তুতে পরিণত করার কোন দরকার দেখি না।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন