দুটি বাস থেকে পঞ্চাশ হাজার কোটি রূপির সম্পদ: টিভিএসের সাফল্যগাঁথা!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
সুন্দরম আয়াঙ্গারের একার হাতে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানীটি এখন ষাট হাজারেরও বেশি মানুষের অন্নের যোগান দেয়, ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম মোটরবাইক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এখন টিভিএস। ভারতের বাইরেও অনেকগুলো দেশে টিভিএসের পন্য বিক্রি হয় এখন।
সাফল্যের জন্যে নাকি ঝুঁকি নিতে হয়। 'নো রিস্ক, নো গেইন' প্রবাদটার জন্ম তো এমনি এমনি হয়নি। ভালো চাকরি, মোটা অংকের বেতন, নিশ্চিন্তে থাকার মতো একটা জীবন- সবকিছুই ছিল থ্রিশুর ভেঙ্গারাম সুন্দরম আয়াঙ্গারের। তবুও ঝোঁকের মাথায় উদ্যোক্তা হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কারণ নয়টা-পাঁচটার চাকরিতে মন বসছিল না, স্বাধীনতাটা খুব বেশি মিস করছিলেন তিনি। নিজেই নিজের বস হবার মিশনে প্রায় কপর্দকশূন্য অবস্থায় আজ থেকে ১০৯ বছর আগে যে প্রতিষ্ঠানটা গড়ে তুলেছিলেন, তারা এখন ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম মোটরবাইক নির্মাতা, টিভিএস বাইক বিক্রি করেই সুন্দরমের গড়া প্রতিষ্ঠানটি বছরে আয় করে বিশ হাজার কোটি রূপিরও বেশি!
থ্রিশুর সুন্দরম আয়াঙ্গারের বাবা পেশায় ছিলেন উকিল, মাদ্রাজ হাইকোর্টে বেশ নামডাক ছিল তার। আঠারোশো শতকের শেষ প্রান্তে তাদের পরিবারটা যথেষ্ট স্বচ্ছল ছিল, খাওয়া-পরার কষ্ট ছিল না কোথাও। ছেলেকে বিলেতে পাঠিয়ে পড়াশোনা করানোর মতো সামর্থ্যও ছিল। কিন্ত সুন্দরম ভারত ছাড়তে চাইলেন না, মাদ্রাজেই ওকালতির ওপরে পড়াশোনা করেছিলেন, কারণ বাবা চেয়েছিলেন ছেলে তার মতোই ডাকসাইটে উকিল হবে। ওকালতির প্র্যাকটিসও করেছিলেন কয়ক বছর, কিন্ত ভালো লাগলো না, মন বসলো না আইন-আদালতের কারবারে।
রেলওয়ের চাকরির জন্যে পরীক্ষা দিলেন, পাশও করলেন। কিছুদিন পর সেই চাকরি ছেড়ে ঢুকলেন ব্যাংকে, কিন্ত মন বসাতে পারলেন না। ছেড়ে দিলেন ব্যাংকের চাকরিও। মুম্বাই গিয়ে দেখেছিলেন, সেখানে প্রাইভেট ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম চালু হয়েছে, লোকজন নিজেরাই গাড়ি কিনে রাস্তায় নামিয়েছে। আইডিয়াটা পছন্দ হলো সুন্দরমের, জমানো টাকার প্রায় পুরোটা দিয়ে দুটো বাস কিনে ট্রান্সপোর্ট সার্ভিস চালু করলেন তিনি। চেন্নাইয়ের প্রথম ব্যক্তি মালিকানাধীন ট্রান্সপোর্ট সার্ভিস চালু হয়েছিল তার হাত ধরেই। অথচ অটোমোবাইল নিয়ে তার তেমন কোন ধারণাই ছিল না এর আগে।
১৯১১ সালের ঘটনা সেটা। তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন টি ভি সুন্দরম আয়াঙ্গার এন্ড সন্স নামের প্রতিষ্ঠান। দুটি বাস থেকে সংখ্যাটা বাড়তে বাড়তে তিন অংক পেরিয়ে গেল, বহরে যুক্ত হলো ট্রাক, লরি সহ আরও নানা বাহন। সাউদার্ন রোডওয়েজের সবচেয়ে বড় পরিবহন কোম্পানী হয়ে উঠলো সুন্দরম আয়ঙ্গার এন্ড সন্স। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তেল এবং গ্যাসের সংকট দেখা দিলো ভারতে, এমন সংকট মোকাবেলার কথা ভেবে একটা গ্যাস প্ল্যান্টই বানিয়ে ফেললেন তিনি, শুরু করলেন রাবারের ব্যবসাও- যাতে নিজের কোম্পানীর গাড়িগুলোর জ্বালানি আর টায়ারের যোগানটা নিজেরাই করতে পারেন।
টি ভি সুন্দরম মারা গেছেন ১৯৫৫ সালে, এখনও ভারত তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেও অবদান ছিল তার, আজাদীর লড়াইয়ে যথাসাধ্য সাহায্য তিনি করেছিলেন মহাত্মা গান্ধীর কংগ্রেসকে। সুন্দরমের মৃত্যুর পরে কোম্পানী ডুবে যেতে পারতো, অনেক নামীদামী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই এমনটা দেখা গেছে। কর্ণধারের বিদায়ের পরে ধ্বসে পড়েছে প্রতিষ্ঠান- এরকম নজির শত শত আছে। কিন্ত সুন্দরম এন্ড সন্সের বেলায় সেটা হলো না, সুন্দরম আইয়ারের উত্তরসূরীরা ব্যবসাকে আরও ওপরের দিকেই তুলে নিলেন।
আশির দশকে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ক্লেন্টন গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি করলো সুন্দরম গ্রুপ, সেই চুক্তির আওতায় ক্লেন্টনের কারিগরি সাহায্য নিয়ে ভারতে দুই আসনের বাইক প্রস্তুত করা শুরু করলো তারা। জাপানি প্রতিষ্ঠান সুজুকির সঙ্গে চুক্তি হলো, ১৯৮০ সালে এলো টিভিএস-ফিফটি নামের টু সিটার বাইক। সাড়া ফেলে দিলো সেটা, বিক্রির রেকর্ড গড়ে ফেললো মডেলটা। ২০০১ সালে সুজুকির সঙ্গে চুক্তি বাতিলের আগ পর্যন্ত দুই প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে অসংখ্য নতুন মডেলের বাইক বাজারে এনেছে টিভিএস, এসেছে ট্রাক, ট্রাক্টর, থ্রি হুইলার সহ আরও নানা পণ্য।
সুন্দরম আয়াঙ্গারের একার হাতে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানীটি এখন ষাট হাজারেরও বেশি মানুষের অন্নের যোগান দেয়, ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম মোটরবাইক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এখন টিভিএস। ভারতের বাইরেও অনেকগুলো দেশে টিভিএসের পন্য বিক্রি হয় এখন। বিশ হাজার কোটি টাকার বেশি মূল্যমানের পন্য তারা বিক্রি করে প্রতি বছর। ১৯৫০ সাল থেকে ভারতে বিএমডাব্লিউ'র অফিসিয়াল ডিলার হিসেবে কাজ করছিল তারা, ২০১৬ সালে তো বিএমডাব্লিউ'র সঙ্গে যৌথভাবে ৩১০ সিসির একটা মোটরবাইকও ভারতের বাজারে এনেছে প্রতিষ্ঠানটি, সেটার নাম অ্যাপাচে-আর আর-৩১০। চেন্নাইতে ২০১৭ সালে লঞ্চ হওয়ার পরে এক ঘন্টায় বিশ হাজার ইউনিটের প্রি অর্ডার পড়েছিল সেই মডেলটির।
সুন্দরম আয়াঙ্গার পারতেন ওকালতি করে জীবনটা কাটিয়ে দিতে, কিংবা ব্যাংকে চাকরি করে ঝামেলা বিহীন একটা জীবন পার করতে। তিনি মারা যাওয়ার পরে তার উত্তরসূরিরাও পারতেন টাকা-পয়সা উড়িয়ে ভোগ-বিলাসে জীবন কাটাতে। সেই পথে তারা হাঁটেননি, কঠিনকে তারা বরব করেছেন, পরিশ্রমকে সাফল্যের হাতিয়ার মেনেছেন। যেখানে ব্যবসার সম্ভাবনা দেখেছেন, সেখানেই তারা লগ্নি করেছেন, নতুন কিছু করার চেষ্টা করেছেন। দুইটা বাস নিয়ে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটা যে আজ পাঁচ হাজার কোটি রুপি সম্পত্তির মালিক, সেটা এই হার না মানা মানসিকতারই ফসল...