বেওয়ারিশ কুকুর না সরিয়ে বরং শহর থেকে দুর্নীতিবাজ-ধর্ষক-লুটেরাদের সরিয়ে দিন
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
জনগনের টাকায় বানানো রাস্তা দিয়ে খুনী, ধর্ষক, লুটেরা বা দুর্নীতিবাজরা যদি দামী গাড়ি হাঁকিয়ে চলতে পারে, অবলা কিছু প্রাণীর চলাফেরায় কি সমস্যা?
মাথার ব্যথা সারাতে গোটা মাথাই কেটে ফেলার একটা অভ্যাস আছে আমাদের। ঢাকা শহরে বেওয়ারিশ কুকুরের উৎপাত কমানোর জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে সেই প্রবাদের কথাটাই মনে পড়ে গেল। প্রায় ত্রিশ হাজার বেওয়ারিশ কুকুরকে ঢাকা থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, এদেরকে ঢাকার বাইরে কোথাও রেখে আসা হবে- এরকমটাই পরিকল্পনা।
জলাতঙ্ক টিকা বা বন্ধ্যাত্বকরণ প্রকল্প ঠিকমতো না চালিয়ে কেন কুকুর সরানোর প্রতি তাদের এত আগ্রহ, সেটার কোন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা সিটি কর্পোরেশনের কর্তারা দিতে পারেননি। কুকুর বন্ধ্যাত্বকরণ প্রকল্পের ফান্ড নাকি তাদের কাছে নেই, একারণে কুকুরগুলোকেই সরিয়ে ফেলার আত্মঘাতী এই পরিকল্পনা হাতে নিতে একটুও বিবেকে বাঁধেনি এই লোকগুলোর। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য অসহায় কিছু প্রাণীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে একটুও মায়া হচ্ছে না তাদের।
তহবিলের অভাবে গত কয়েক বছর ধরে বন্ধ্যাত্বকরণ কর্মসূচী বন্ধ রয়েছে। যার কারণে ঢাকা শহরের কুকুরের পরিমাণ বেড়ে গেছে আচমকা। সেকারণে মানুষের অসুবিধাও হচ্ছে, তাতে বিন্দুমাত্র অসহমত পোষণ করছি না। কুকুরের উৎপাতে ঢাকার অনেক এলাকার মানুষই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন, তারা অভিযোগ করেছেন সিটি কর্পোরেশনের কাছে, সবকিছুই সত্যি। কিন্ত তারচেয়ে বড় সত্যি হচ্ছে, এই সমস্যার সমাধান কুকুরদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়া বা পিটিয়ে মেরে ফেলা নয়।
দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের হিসেব অনুযায়ী, এই এলাকায় বেওয়ারিশ কুকুরের (যেগুলোকে আমরা দেশী কুকুর বা রাস্তার কুকুর নামে চিনি) সংখ্যা প্রায় ষাট হাজার। তবে পশু অধিকার নিয়ে কাজ করে, এমন কয়েকটি সংস্থার মতে এই সংখ্যাটা সাঁইত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজারের মধ্যে। কুকুরের সংখ্যা সাঁইত্রিশ হাজার হোক আর ষাট হাজার, সেগুলোর দেখভাল করাটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, তারা যাতে মানুষকে উৎপাত না করে, জনগনের অসুবিধার কারণ না হয়, সেটা নিশ্চিত করবে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো। সেটার জন্য বিজ্ঞানসম্মত উপায় আছে, একটা পরিকল্পনামাফিক রাস্তায় কাজ করতে হবে, দুম করে কুকুর সরিয়ে দেব বললেই তো হয়ে গেল না।
ত্রিশ হাজার কুকুর কোথায় স্থানান্তরিত করা হবে? সিটি কর্পোরেশন প্রথমে মাতুয়াইলে এদেরকে সরিয়ে নিতে চেয়েছিল, কিন্ত সেখানে পর্যাপ্ত খাবার নেই বিধায় বাতিল করা হয়েছে মাতুয়াইলকে। দেশের এমন একটা জায়গা কেউ দেখাতে পারবে না, যেখানে এই বিপুল সংখ্যক কুকুরের ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব। মফস্বল বা গ্রাম্য এলাকায় যদি কুকুরগুলোকে ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে অবশ্যই খাবারের সংকট হবে। কারণ শহরের মানুষদের মতো সেখানকার বাসিন্দারা কুকুরের প্রতি এতোটা সংবেদনশীল নয়। না খেতে পেয়ে মারা যাবে হাজার হাজার কুকুর, খাবারের জন্য মানুষকে আক্রমণ করায় পিটিয়েও মারা হবে অনেক কুকুরকে। ঢাকা থেকে কুকুর সরানোর বুদ্ধি যাদের মাথায় এসেছে, তারা কি এসব ঘটনার কথা ভেবে দেখেছেন একবারও?
গতকাল দেখলাম নগর ভবনের সামনে মানুষের চেহারার একদল প্রাণী প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছে, তারা বেওয়ারিশ কুকুর সরিয়ে দেয়ার পক্ষপাতী। সেসব প্ল্যাকার্ডে বাহারী সব লাইন লেখা- জনগনের টাকায় বানানো রাস্তা কেন কুকুরের দখলে থাকবে, সব বেওয়ারিশ কুকুর ধরে প্রাণীপ্রেমীদের বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হোক, ইত্যাদি ইত্যাদি। একজন তো প্ল্যাকার্ডে লিখে এনেছে, সে নালি কুকুরের যন্ত্রণায় রাস্তায় ঠিকমতো বাইক চালাতে পারে না!
অথচ আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে, ঢাকা শহরে বেওয়ারিশ কুকুরের উৎপাত যতটা, তারচেয়ে কয়েকশো গুণ বেশি উৎপাত তৈরি করে অসভ্য কিছু বাইকার, এরা বাইক চালানোর সময় নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করে না, নিজেদের নবাবের বংশধর ভেবে ফুটপাতে বাইক তুলে দেয়- সেই অসভ্যদের কণ্ঠে কুকুরদের নিয়ে এমন অদ্ভুত অভিযোগ শুনে মাথা চক্কর দিয়ে উঠতে বাধ্য!
জনগনের টাকায় বানানো রাস্তা দিয়ে একজন খুনী, একজন ধর্ষক, একজন লুটেরা, একজন দুর্নীতিবাজ যদি দামী গাড়ি হাঁকিয়ে চলতে পারে, অবলা কিছু প্রাণীর চলাফেরায় কি সমস্যা? এই শহরের বেওয়ারিশ কুকুরগুলো খিদ্বে জ্বালায় অস্থির না হলে কারো পিছু নেয় না, কারো ওপর আক্রমণ করে না। অথচ এই শহরে লাখ লাখ অমানুষ আছে, যারা শুধু লোভের বশবর্তী হয়েই অন্যের ক্ষতি করে, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের জন্যে নয়। এই অমানুষগুলোকে শহর থেকে সরানো দরকার, দেশ থেকে দূর করা দরকার, বেওয়ারিশ কুকুররা চাইলেও পরিমল হতে পারবে না, প্রদীপের মতো এনকাউন্টারে মানুষ মারতে পারবে না, রিজেন্ট সাহেদের মতো দেশের টাকা লুটেপুটে খেতে পারবে না।
কিছু মানুষ বলছেন, দুনিয়ার কোন সভ্য দেশে নাকি রাস্তাঘাটে কুকুর দেখা যায় না। সত্যবচন। তা কোন সভ্য দেশটায় আপনি বাস করছেন? দুনিয়ার আর কোন দেশে করোনার ভুয়া টেস্টের নাম করে জালিয়াতি করা হয়? আর কোন দেশে প্রতিটা সরকারী দপ্তর দুর্নীতিতে ছেয়ে থাকে? কোন সভ্য দেশটায় সরকারী কর্মকর্তারা সৎ থেকে জনগনের জন্য কাজ করলে তাকে ওএসডি করে রাখা হয়? কোন সভ্য দেশটার রাজধানীতে গণপরিবহনে প্রতিদিনই নারীরা নিপীড়নের শিকার হন? আর কোন দেশে রাজনীতি বা সরকারী চাকরি করেই কারো সম্পদ কয়েক বছরের ব্যবধানে কয়েকশো গুণ বেড়ে যায়? লোকজন চুরি-চামারি করবে বাংলাদেশ স্টাইলে, আর লাইফস্টাইল চাইবে নিউইয়র্ক-লন্ডনের মতো- এই হিপোক্রেসিটা দেখে গা গুলিয়ে আসে বারবার।
কুকুরের কারণে সাধারণ মানুষ অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন, আতঙ্কে আছেন- এটা মেনে নিয়েই বলছি, কুকুরের পুনর্বাসন করা হোক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে। ভ্যাক্সিনেশন বা বন্ধ্যাত্বকরণের বাজেট দেয়া হোক সিটি কর্পোরেশনকে। বাজেট নেই এই অজুহাতে হাজার হাজার অবলা প্রাণীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এই শহরে মানুষের অধিকার যতটুকু, কুকুরদের অধিকার তারচেয়ে এক বিন্দু কম নয়, কারণ দুজনেই একই স্রষ্টার সৃষ্টি। আর বাস্তবতা তো এটাই, কুকুরেরা হাজার চেষ্টা করলেও কখনও মানুষের মতো খারাপ হতে পারবে না। কাজেই শহর থেকে কাউকে সরাতে হলে বরং তুলনামূলক খারাপ প্রাণী মানুষই সরে যাক।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন