তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন? বঙ্কিমচন্দ্র বেঁচে থাকলে হয়তো পরিবর্তন করে লিখতেন- তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি আরও অধম হইব। এবং এই লাইনের ভাবসম্প্রসারণ? আমরা নিজেরাই।

অন্যের অন্যায়, অমানবিক ও অশুভ আচরণ কখনও মানুষের অনুকরণীয় আদর্শ হতে পারে না। কলুষময় পরিবেশের মধ্যে থাকলে প্রকৃত মানুষের সাধনা হওয়া উচিত সত্য, ন্যায় ও মানবিক আদর্শে জীবন গঠন। পরের সুকৃতিতে অনুপ্রাণিত হওয়া প্রশংসনীয় কিন্তু পরের স্বার্থপরতায় প্রভাবিত হওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত।

খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে কথাগুলো। আরেকটু সহজ করে বলার চেষ্টা করি। প্রসঙ্গ ভারতের বিতর্কিত নাগরিক আইনকে ঘিরে ধর্মীয় দাঙ্গা। সেখানে মুসলিমদের ওপর যে অত্যচার করা হচ্ছে, সেটা শুধু মুসলিম না, কোনও সভ্য মানুষের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে নাগরিকত্ব হুমকির মুখে, জীবন বিপন্ন। বলতে গেলে সরাসরি পুড়িয়েই মারা হচ্ছে। কিন্তু কেন? কারণ, ভারতে কোটি কোটি মুসলমান থাকলেও তারা সেখানে সংখ্যালঘু। বাংলাদেশের থেকে বেশি মুসলমান থাকে সেখানে, তবুও তারা অত্যাচারিত।

এই যে একটা দেশে আগুন জ্বলছে, সাথে পুড়ছে মানুষ, নিরীহ মানুষ। শুধুমাত্র ধর্মীয় ভিন্নতার কারণে। এই ধর্মীয় ভিন্নতার কারণে আমরা নিজেরা কি করি সেটা ভেবে দেখেছি কখনও? এই আমরা কিন্তু লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। যদি তারা হিন্দু হত, তবে কি পারতাম একই উদারতা দেখাতে? নাকি সরসারি বলে বসতাম এই বাংলায় মালোয়ানদের ঠাঁই নাই।

এখানে সোজা আলাপটা হচ্ছে, যতই অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বলি না কেন, আমরা একটি সাম্প্রদায়িক জাতি। সেটা আপনারা সবাই খুব ভালোমত জানেন। কিন্তু মানতে চাইবেন না কখনও। এটাই বাস্তবতা। ঠিক এ কারণেই, রোহিঙ্গারা মুসলিম বলেই তাদের আমরা আশ্রয় দেই, ওয়াজ মাহফিলে দেয়া ভুল বক্তব্যগুলোর প্রতিবাদ না করে আমরা সেটার পক্ষেই সাফাই গাইতে থাকি, সুযোগ পেলে আমরাও হিন্দুদের মন্দির-ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিই। কারণ, তারা এখানে সংখ্যালঘু। ভারতে যেমন মুসলমানেরা সংখ্যালঘু, বাংলাদেশে হিন্দুরা সংখ্যালঘু। একই মুদ্রার দুই পিঠ।   

তাবলিগ জামাত মসজিদ ভাঙলে আমরা কষ্ট পাই না

গতকালকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে তাবলিগ জামাত নিয়ে মতবিরোধকে কেন্দ্র করে সাদ ও জোবায়েরপন্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষে মারকাজ মসজিদের চারপাশের জানালার কাঁচ ও মসজিদের বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর করা হয়। এতে অবশ্য আমাদের কোনও বিকার নেই। কারণ, এটা তো আর হিন্দুরা করে নাই। করলে এতক্ষণে দাঙ্গা লেগে যেত। পালটা আমরাও মন্দির ভেঙে দিয়ে আসতাম। এখানেই আমাদের অসাম্প্রদায়িক মুখোশ খুলে পড়ে যায়।

আমরা ভাবছি আমাদের মুসলিম ভাইয়েরা না হয় একটু ভুল করেছে। ভুল তো মানুষেরই হয়। ভুল করে না হয় আল্লাহর ঘরেই আঘাত করে বসেছে। এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। অন্য ধর্মের কেউ জড়িত না থাকলে আমরা ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমাদের ধর্মীয় চেতনা জাগ্রতই হয় বিধর্মীদের কথা শুনে, আর তাদের বানানো সিনেমা দেখে।  

কথায় কথায় ‘ইসলামের শত্রু’ টার্মটা খুব ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে যদি কেউ ইসলামের শত্রু থেকে থাকে তবে সেটা আমরাই। কারণ, যখন কোনও ভন্ড পীর হুজুর ইসলামকে অবমাননা করে তখন আমরা চুপ থাকি। আমরা অপেক্ষা করি কখন কোন বিধর্মী কিছু বলবে আর ওমনি আমরা ঝাঁপিয়ে পড়বো। সমস্যাটা হচ্ছে, নিজেদের প্রাউড মুসলিম দাবী করার আগে আমরা ইসলাম প্র্যাক্টিস করা শিখি না। আমাদের ইসলাম প্র্যাক্টিস শুধুমাত্র কমেন্টে ‘আমিন, আলহামদুলিল্লাহ, সুবহানআল্লাহ্‌’ লিখে দেয়া আর ভুলভাল ইসলাম প্রচার করা মানুষদের কথা লাউড স্পিকারে শোনাতেই সীমাবদ্ধ। এই সীমানা পেরিয়ে শান্তির ধর্ম ইসলামের খোঁজ আমরা কখনই করব না। 

অধিকাংশ মানুষ নতুন করে কিছু বোঝার চেষ্টাই করে না। তাদেরকে ছোটবেলা থেকে রেডিমেড যে বুঝ দেয়া হয় সেটা আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকে। সংবাদ শিরোনাম পছন্দ না হলে মনের মাধুরী, ঐশ্বর্য মিশিয়ে খুব কিউট করে গালি দিয়ে যায়। এই যে গালি দেয়া কিউট মানুষগুলো, এরাই মূলত ঘৃণা ছড়ায়, এরাই দাঙ্গাবাদী মনোভাবের। সে যে ধর্মেরই হোক না কেন, এদের কারণেই ধর্মীয় দাঙ্গা হয়েছে, হবে, হতে থাকবে।


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা