ইউএনও'র ওপর হামলা: অপরাধীরা এতটা বেপরোয়া হয়ে ওঠে কীভাবে?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
একজন ইউএনও মানে উপজেলার সর্বোচ্চ কর্মকর্তা, এরকম ঘটনায় প্রচুর শোরগোল হবে, আজ হোক কিংবা কাল- অপরাধী ধরা পড়বেই। তবুও এমন প্ল্যানমাফিক, এতটা ডেসপারেট হয়ে ইউএনও'র ওপর হামলা করার সাহস কীভাবে হয়?
ডাক্তার বলছেন অবস্থা আশংকাজনক।কতটা আশংকাজনক সেটা নিশ্চিত করতে পারছেন না। পালস রেট বেড়ে গেছে, প্রেশার কমেছে। মাথার বাম পাশের খুলি ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেছে। সেখানে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। অপারেশন করানোটা গুরুত্বপূর্ণ হলেও অপারেশন করা যাচ্ছে না শুধু স্থিতিশীল অবস্থা নেই বলে, এই মুহূর্তে অপারেশন করতে গেলে আরও খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে- এমন আশংকা ডাক্তারদের। আরও খারাপ কি ঘটবে? মৃত্যু? সকালের পত্রিকায় বড় বড় হরফে ছাপা হবে, দুর্বৃত্তের হামলায় আহত সেই ইউএনও মারা গেছেন! পত্রিকায় আবেগী সব আর্টিকেল পড়ব, কত কষ্ট করে তিনি পড়াশোনা করেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধা বাবা কত যত্নে মেয়েকে মানুষ করেছিলেন- কিন্ত এসব গল্প শোনার চেয়ে মানুষটার নিরাপদে বেঁচে থাকাটা অনেক বেশি দরকারী ছিল না?
একজন ইউএনও মানে একটা উপজেলার রাজা। সেই ইউএনওর বাসায় ঢুকে নিরাপত্তারক্ষীকে বেঁধে ফেলা হয়েছে, বাথরুমের ভেন্টিলেটর ভেঙে ঘরে প্রবেশ করেছে আততায়ীরা, তারপর ইউএনওকে বেধড়ক মারধর করেছে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়েছে, মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হয়েছে মাথায়। ইউএনও'র বাবা যখন মেয়ের চিৎকার শুনে তাকে বাঁচাতে এসেছেন, তখন তাকেও মেরেছে দুর্বৃত্তরা। ভোররাতের কোন এক সময়ে ঘটনা ঘটেছে, আহত বাবা-মেয়েকে উদ্ধার করা হয়েছে সকালে।
দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার ঘটনাটা টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হলেও, এখনও জড়িত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। ঘটনার পর ষোলো ঘন্টার বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, যিনি একটা উপজেলার দায়িত্বে আছেন, তার বাসায় ঢুকে, তাকে এভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে আততায়ীরা পালিয়ে আছে এখনও, পুরো ব্যাপারটা ভাবতেই কেমন যেন অবাস্তব লাগে। পুলিশ আর প্রশাসন- এই দুটো ক্যাডারকে ধরা হয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু, মাঠ পর্যায়ে পাওয়ার প্র্যাকটিসের সুযোগ এই দুই ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি। একজন ইউএনওর ওপর এভাবে হামলা কে বা কারা করলো, এই প্রশ্নের জবাবটাই এখন খুঁজছে সবাই।
শুরুতেই প্রহরীকে বেঁধে ফেলা, ভেন্টিলেটর দিয়ে বাসায় প্রবেশ, ধারালো এবং ভোঁতা দুই ধরণের অস্ত্রই বহন করা, টাকা-পয়সা না নেয়া- এসব ঘটনাই প্রমাণ করে, ডাকাতির উদ্দেশ্যে ওই দুর্বৃত্তরা আসেনি, তাদের উদ্দেশ্য ছিল একটাই- ইউএনও ওয়াহিদা খানমকে খুন করা। গোটা ব্যাপারটাই পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে, প্ল্যানে খুঁত রাখেনি হামলাকারীরা। বাবা-মেয়ে দুজনই অচেতন হয়ে যাওয়ায় তারা মারা গেছেন ভেবেই চলে গেছে হামলাকারীরা।
যতবার ইউওনও'র ওপরে হামলার খবর বা আপডেট নিউজফিডে আসছে, ততবারই মাথায় প্রথম যে প্রশ্নটা এসে হানা দিচ্ছে, সেটা হচ্ছে একজন ইউএনওর ওপরে হামলার সাহস কীভাবে হয় কারো? ঘটনাটা নিয়ে যে দেশজুড়ে শোরগোল পড়ে যাবে, এটা তো বোকার হদ্দও জানে। হাই লেভেলের তদন্ত হবে, অপরাধীর পক্ষেও বেশিদিন পালিয়ে বাঁচা সম্ভব নয়। আজ হোক কিংবা কাল- ধরা সে পড়বেই। তবুও এমন প্ল্যানমাফিক, এতটা ডেসপারেট হয়ে ইউএনও'র ওপর কারো হামলা করার সাহস কি করে হয়?
এটার জবাব সম্ভবত আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে তাকালে বোঝা যাবে। সাবেক মেজর সিনহার হত্যাকান্ড বা আজকের ইউএনও'র ওপরে হামলা- এগুলো একটা দুটো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, কোনভাবেই নয়। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে দিনকে দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে, এটা হয়তো তারই প্রমাণ। অপরাধীরা এতই সাহসী আর বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, একজন ইউএনওর ওপর নৃশংস কায়দায় হামলা চালাতেও দ্বিধা করছে না একটুও।
একটা দেশের নিরাপত্তাবাহিনী যখন অপরাধীকে ধরতে পারে না, বিচারালয় যখন অপরাধীর বিচার করতে পারে না, তখন সেই দেশটা অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য হয়ে ওঠে। দুষ্ট লোকেরা নিজেদের সর্বেসর্বা ভাবে, কারণ তারা জানে, একে-তাকে ম্যানেজ করে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। বেশিদিন আগের কথা নয়, সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের কথা স্মরণ করুন। সেই রহস্যের সমাধান আজও হয়েছে? বরং গুগলে সাগর রুনি লিখে সার্চ দিলে জানতে পারবেন, কততম বারের মতো তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার তারিখ পেছানো হয়েছে। গণ্ডায় গণ্ডায় ব্লগার হত্যার কথা স্মরণ করুন, একটা ঘটনারও কি বিচার হয়েছে? তদন্তের অগ্রগতির কি অবস্থা, কেউ জানে?
সাগর-রুনির হত্যাকান্ডের পরে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তখন বলা হয়েছিল, কারো বেডরুমে গিয়ে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব না। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে খুনিরা গ্রেপ্তার হবে। কয়েক দফায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বদল হয়েছে এর পরে, কেটে গেছে আটটি বছর। তদন্তের অগ্রগতি নেই, আদৌ কোন বিচার হবে, নাকি অমীমাংসিত রহস্য হিসেবে থেকে যাবে এটা- কেউ জানেনা। আশা করি রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা আজ অন্তত সেরকম উদাসীন থাকবেন না। দিনাজপুরে ইউএনও'র ওপর হামলাকারীরা ধরা পড়ুক, তাদের বিচার হোক, এটা মনেপ্রাণে চাই। নইলে বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে আরও একটা কালো দাগ যুক্ত হবে, যেটা একজন নাগরিক হিসেবে মেনে নেয়াটা কষ্টের।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন