সারিম আখতার: দ্য আনটোল্ড স্টোরি অফ 'ডিজাপয়েন্টেড' পাকিস্তানী ফ্যান!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
কয়েক সেকেন্ডের একটা এক্সপ্রেশন, হতাশ মুখশ্রী তাকে রাতারাতি সেলিব্রেটি বানিয়ে দিলো, অন্তর্জালে ভাইরাল হয়ে গেলেন সারিম আখতার নামের মানুষটা, জীবনটা গেল বদলে! দুনিয়ার এমন কোন বিষয় নেই, যেটা নিয়ে এই ভদ্রলোকের চেহারা জুড়ে দিয়ে মিম বানানো হয়নি...
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কিভাবে একটা মানুষের জীবন বদলে যেতে পারে, সেটা সারিম আখতারের চেয়ে ভালো কেউ জানে না। বেচারা কিছুই করেননি, স্টেডিয়ামে গিয়েছিলেন নিজের দল পাকিস্তানের খেলা দেখতে। গ্যালারিতে বসে ছিলেন, সহজ একটা ক্যাচ মিস হওয়ায় রাজ্যের হতাশা এসে জমেছিল মুখে। কীভাবে যেন ক্যামেরাম্যান সেই দৃশ্যটা বন্দী করলেন ক্যামেরায়, তারপর কয়েক মিনিটের মধ্যে ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়ে গেল সারিমের সেই লুক! স্টেডিয়ামেই তার সাক্ষাৎকার নেয়া হলো, খেলা শেষ হবার আগেই তিনি জেনে গেলেন, স্টেডিয়ামে যে মানুষ হয়ে তিনি ঢুকেছিলেন, সেই মানুষটা তিনি আর নেই এখন, তিনি পরিণত হয়েছেন ইন্টারনেট সেনসেশনে!
মুহাম্মদ সারিম আখতার। জাতীয়তায় পাকিস্তানী, থাকেন ইংল্যান্ডে। গত চৌদ্দ মাসে দুনিয়ার যেখানেই যে ঘটনা হয়েছে, সেটার সাথে কোন না কোনভাবে সারিমকে জুড়ে দিয়ে মিম বানানো হয়েছে ফেসবুক-টুইটার-ইন্সটাগ্রামে। গত ১৪ মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্প বা ভ্লাদিমির পুতিন নন, সবচেয়ে বেশি যে মানুষটার চেহারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা দেখেছেন, তার নাম সারিম আখতার। নয়টা-পাঁচটার চাকরি করা ছাপোষা একজন মানুষ আচমকাই পরিণত হয়েছেন সেলিব্রেটিতে, সেই জনপ্রিয়তার ভারটাও দারুণভাবে সামলাচ্ছেন তিনি।
সারিমের জন্ম পাকিস্তানের করাচীতে। দেশ থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর চাকরি করতে কুয়েত গিয়েছিলেন তিনি, সেখান থেকে এসেছেন ইংল্যান্ডে। লন্ডনের একটা অডিট ফার্মে রেগুলার এমপ্লয়ি হিসেবে কাজ করেন তিনি, স্ত্রী আর দুই ছেলেকে নিয়ে সুখের সংসার, নির্ঝঞ্ঝাট একটা জীবন। অবসর সময়ে ক্রিকেট নইলে ফুটবল দেখতেন টিভিতে। পাকিস্তানে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বেশি, সারিমেরও তাই এই খেলাটাই প্রিয়। তবে ক্রিকেট দেখতে গিয়েই যে জীবন বদলে যাবে তার, সেটা তিনি কখনও ভাবেননি।
গত বিশ্বকাপের ঘটনা, জুনের ১২ তারিখ। সারিম তখন নতুন বাসায় শিফট হয়েছেন, মালপত্র গোছানোর কাজও শেষ হয়নি পুরোপুরি। সেদিন আবার পাকিস্তান-অস্ট্রেলিয়া হাইভোল্টেজ ম্যাচ। নামে হাইভোল্টেজ, শক্তিতে তো পাকিস্তান এখন অনেকটাই পিছিয়ে। তবু আনপ্রেডিক্টেবল এই দলটার তো কোন ভরসা নেই, তাছাড়া নিজের দেশ বলে কথা, সেজন্যেই ম্যাচের টিকেট সংগ্রহ করেছিলেন সারিম। কিন্ত বাসার কাজের চাপে ভাবলেন, আজ আর মাঠে গিয়ে কাজ নেই, টিভিতেই দেখে নেবেন খেলা। সারিম এর আগে কখনও মাঠে গিয়ে ক্রিকেট ম্যাচ দেখেননি, সেদিনই প্রথম যাওয়ার কথা।
এদিকে তার এক বন্ধু দুবাই থেকে ইংল্যান্ডে এসেছে শুধু বিশ্বকাপে পাকিস্তানের দুটো ম্যাচ দেখবে বলে। উঠেছে সারিমেএ বাসাতেই। এখন সারিম খেলা দেখতে না গেলে তারও যাওয়া হবে না, কারণ বাসা থেকে টন্টনের মাঠটায় গাড়িতে করে যেতেই তিন ঘন্টা লাগে। কি আর করা, বন্ধুর খাতিরে সারিম রাজি হলেন ম্যাচ দেখতে যেতে, টানা তিন ঘন্টা ড্রাইভ করে পৌঁছালেন স্টেডিয়ামে। ঢোকার সময় সারিমের কল্পনাতেও ছিল না, কয়েক ঘন্টা পরে তার দুনিয়াটা বদলে যাবে।
টসে জিতে আগে ব্যাটিং করছিল অস্ট্রেলিয়া। ৩৭ তম ওভারের ঘটনা, কাঁধ সমান উচ্চতার একটা বলে আপার কাট করলেন ডেভিড ওয়ার্নার, বল উড়ে গেল থার্ডম্যান অঞ্চলের দিকে। সেখানে ফিল্ডার ছিলেন আসিফ আলি, সহজ একটা ক্যাচ ছিল তার জন্য। কিন্ত সেটাই মিস করলেন তিনি! আসিফ আলি যে।জায়গায় ফিল্ডিং করছিলেন, গ্যালারিতে ঠিক সেই বরাবর বাউন্ডারির কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন সারিম আখতার। ক্যাচটা আসিফের হাত ফসকাতেই তার চোখেমুখে ভেসে উঠলো রাজ্যের হতাশা। মুখে কিছু বলেননি, শুধু এক্সপ্রেশনেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, কতটা বিরক্তি বাসা বেঁধেছে তার মনে।
মিনিটখানেকের মধ্যে সারিমের মোবাইলে একের পর এক ফোন আসা শুরু হলো। আত্মীয়-বন্ধু-পরিচিত সবার একই কথা, আমরা তোমাকে টিভিতে দেখেছি। সারিম শুনে বেশ কৌতুহলী হয়ে উঠলেন, বললেন, ছবি থাকলে আমাকে পাঠাও। তবে ছবি দেখে তার খুশি হওয়া উচিত নাকি বিরক্ত হওয়া উচিত, সেটা বুঝতে পারলেন না। সারিম তখনও জানেন না, ইন্টারনেট দুনিয়ায় তাকে নিয়ে চর্চা শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে, তিনি পরিণত হয়েছেন ভাইরাল টপিকে। এরইমধ্যে গ্যালারিতে তাকে খুঁজে বের করলেন পাকিস্তানের বিখ্যাত ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার জয়নব আব্বাস, তিনি সারিমের ইন্টারভিউ নিলেন, ম্যাচ চলাকালেই সেটা প্রচার করা হলো টিভিতে!
পরের গল্পটা ইতিহাস। দুনিয়ার এমন কোন বিষয় নেই, যেটাতে সারিমকে নিয়ে মিম বানানো হয়নি। তার সেই বিখ্যাত 'ডিজাপয়েন্ট লুক' নিয়ে লাখ লাখ মিম তৈরি হয়েছে গত ১৪ মাসে। উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু, আলাস্কা থেকে সাইবেরিয়া সব জায়গায় ছড়িয়ে গেল সারিমের চেহারা। বাজি ধরে বলতে পারি, এই ভদ্রলোকের নাম যে সারিম আখতার, সেটা না জানলেও তার চেহারাওয়ালা মিম আপনি অবশ্যই দেখেছেন, না দেখে থাকলে এখনই ফেসবুক-টুইটার ডিঅ্যাক্টিভেট করে দিন, সারিমকে যে চেনে না, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের অধিকারও তার নেই!
সারিমের চারপাশের দুনিয়াটা বদলে গেছে এখন। লোকে তাকে দেখলেই এগিয়ে আসে, জিজ্ঞেস করে, আপনি কি বিখ্যাত 'ডিজাপয়েন্টেড পাকিস্তানী ফ্যান'? তারা সেলফি তুলতে চায়, কেউ তো বলে, সেদিনের মতো একটু গোমড়া মুখ করে তাকান না প্লিজ! সারিম এই জনপ্রিয়তা বেশ উপভোগ করেন। ছোটবেলা থেক্ব নোবডি হিসেবে বড় হয়েছেন, আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন না কখনও, আজ তাকে নিয়ে লোকের এমন আগ্রহ তার বেশ লাগে। গুগলে ডিজাপয়েন্ট লিখতে গেলে সাজেশানে আসে, ডিজাপয়েন্টেড পাকিস্তানী ফ্যান- সারিমের জনপ্রিয়তা কোথায় পৌঁছে গেছে এটাই তার প্রমাণ!
তবে এই জনপ্রিয়তা আবার তার পরিবার খুব একটা আনন্দের সাথে গ্রহণ করতে পারছে না। বাচ্চারা বাবার সাথে বাইরে যেতে পারে না, লোকে দেখলেই ছবি তুলতে ছুটে আসে বলে। অনেকদিন হয়ে গেল, গোটা পরিবার একসঙ্গে কোথাও ঘুরতে যায় না। সারিমের স্ত্রী একবার শপিংয়ে গিয়ে দেখেছেন, এক লোক সারিমের ছবি দিয়ে বানানো টিশার্ট পরে ঘুরছেন! বড় ছেলের বন্ধুরা তাকে হোয়াটসঅ্যাপে বাবার ছবি দিয়ে বানানো মিম পাঠায়, সেটা তার ভালো লাগে না। এজন্য খানিকটা ঘরকুনো হয়ে গেছে সে।
তবে সারিম তার বাচ্চাদের বুঝিয়েছেন। বলেছেন, জীবনের সব ঘটনার ওপর তোমার হাত নাও থাকরে পারে। যেটা তুমি জেনে-বুঝে করেছো, সেটা নিয়ে চিন্তা করো, যদি ভুল করে থাকো, তাহলে চেষ্টা করো শুধরে নেয়ার, একই ভুল যাতে আবার না হয়। আর যেটা তুমি করোইনি, যেখানে তোমার কোন ভূমিকা ছিল না- সেটা নিয়ে ভেবে কোন লাভ নেই। এই ঘটনার আগে সারিম আখতার ফেসবুক-টুইটার কিছুই ব্যবহার করতেন না। তবে এখন প্রায় সব সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মেই তার অ্যাকাউন্ট আছে। নিজেকে নিয়ে হওয়া ট্রল বা মিম নিয়ে তার কোন আপত্তি নেই, শুধু অনুরোধ, সেটা যাতে মাত্রা না ছাড়ায়, মজাটা যেন নোংরামিতে না গড়ায়।
জীবন সারিম আখতারকে অসম্ভব বিস্ময় উপহার দিয়েছে, পাকিস্তান দলের ইংল্যান্ড সফরের আগে এখন তিনি ক্রিকেট বোর্ডের অনুরোধে তাদের জন্য শুভেচ্ছা ভিডিও বানান, মাঠে গিয়ে ওয়াসিম-ওয়াকারদের মতো কিংবদন্তীদের পাশে দাঁড়িয়ে একজন দর্শকের পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে ক্রিকেট নিয়ে কথা বলেন। তবে ১৪ মাসের জার্নিতে এটা স্বীকার করতেই হবে যে, জনপ্রিয়তার বোঝা সারিমের মাথার ওপর চেপে বসেনি, পপুলারিটি তাকে অন্য মানুষে রূপান্তরিত করতে পারেনি, অহংকারী বানাতে পারেনি- এই সার্টিফিকেট তার কাছের মানুষেরাই দেন। সারিমের জন্যে ভালোবাসা, কুড়িয়ে পাওয়া জনপ্রিয়তাকে সবাই এভাবে সামলাতে পারে না...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন