উড়ে যায় বকপক্ষী: শুধু নাটক নয়, হাসি-কান্নায় জীবন গল্পের অনন্য উপস্থাপন
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
কোথাও কেউ নেই, অয়োময়, বহুব্রীহি বা এইসব দিনরাত্রির চেয়ে মানের দিক থেকে উড়ে যায় বকপক্ষীকে কি পিছিয়ে রাখা যাবে? নাটকটা দেখার পরে তৈয়ব আলী, দোতারা চাচা, পুষ্প কিংবা ওস্তাদ জালাল খাঁঁ- এই চরিত্রগুলোকেও কি ভোলা সম্ভব?
'হুমায়ূন আহমেদের নাটক' শুনলেই সবাই 'কোথাও কেউ নেই' এর বাকের ভাইকে স্মরণ করবে সবার আগে। নাটকের একটা চরিত্রের ফাঁসি ঠেকাতে মিছিল-মিটিং তো বাংলাদেশ দেখেছে ওই একবারই। সেই নাটকটা কিন্ত পুরোপুরি হুমায়ূন আহমেদের ছিল না। কোথাও কেউ নেই এর পরিচালক ছিলেন বরকতউল্লাহ খান। অয়োময়, বহুব্রীহি এবং এইসব দিনরাত্রিতেও হুমায়ূন আহমেদ চিত্রনাট্যকার হিসেবেই ছিলেন, পরিচালক হিসেবে নয়। কাজেই হুমায়ূন আহমেদের পরিচালিত সেরা নাটকের নাম নিতে গেলে তর্কাতীতভাবেই 'উড়ে যায় বকপক্ষী'কে সবার ওপরে রাখা যায়।
আচ্ছা, কোথাও কেউ নেই, অয়োময়, বহুব্রীহি বা এইসব দিনরাত্রির চেয়ে মানের দিক থেকে উড়ে যায় বকপক্ষীকে কি কোথাও পিছিয়ে রাখা যাবে? অসাধারণ হিউমার, স্ক্রিপ্ট আর ডায়লগের সঙ্গে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অসাধারণ অভিনয় ছাব্বিশ পর্বের পুরো নাটকটাকে টেনে নিয়ে গেছে শেষ অবদি। হাস্যরসের ভঙ্গিমায় হুমায়ূন যাপিত জীবনের গল্প বলেছেন, সেই গল্পে অভাব আছে, ভালোবাসা আছে, বিচ্ছেদ আছে, মর্মান্তিক করুণ পরিণতি আছে, আছে হৃদয়ভাঙার গল্প, আছে লোকগানের আসর; হাসি-আনন্দ-কান্নার এমন দুর্দান্ত সম্মিলন তো বাংলা নাটক খুব বেশি দেখেনি।
উড়ে যায় বকপক্ষী নাটকের গল্পটা আবর্তিত হয়েছে মজিদ মিয়ার গানের দলকে কেন্দ্র করে। দলের সদস্যদের মধ্যে মজিদ মিয়া এবং তার মেয়ে পুষ্প আছেন, আরও উল্লেখযোগ্য দুই সদস্য হচ্ছেন তৈয়ব আলী সরকার এবং ফজলু মিয়া। তাদের সঙ্গে উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো করেই যুক্ত হয় লন্ডনে বসবাসরত এক বাংলাদেশী তরুণ হাসান, কিছু রিসার্চের কাজে যাকে বাংলাদেশের একটা গ্রাম্য গানের দলের সঙ্গে থাকতে হবে, তাদের পর্যবেক্ষণ করতে হবে। গল্পের পটপরিবর্তনে ধীরে ধীরে উল্লেখযোগ্য চরিত্র হয়ে ওঠেন গ্রামের চেয়ারম্যান, যিনি কিনা অতি সজ্জন এবং ভদ্রলোক। ক্ষমতার লোভে অন্ধ এক রাজনীতিবিদের আগমন ঘটে, আরও আগমন হয় ওস্তাদ জালাল খাঁ-এর, যার করুণ পরিণতি নাটকের শেষটাকে বদলে দেয় আচমকাই।
উড়ে যায় বকপক্ষী মানেই আমার কাছে ফারুক আহমেদের দুর্দান্ত অভিনয়। তৈয়ব আলীর চরিত্রে পুরোটা নাটক জুড়ে তিনি যেন অভিনয়ের জাদু দেখিয়ে গেলেন, তার সামনে মাসুম আজীজের মতো মেথড অ্যাক্টরকেও ফিকে মনে হলো কখনও কখনও, আবার চিত্রনায়ক রিয়াজের গ্ল্যামারও ফারুক আহমেদের ওপর থেকে নজর সরিয়ে নিতে পারলো না, তিনি যেন শো-স্টেলার হয়ে ছাব্বিশ পর্ব জুড়ে সবটুকু আলো নিজের দিকে কেড়ে নিলেন।
'ধুর ছাতা দল ই করব না', 'আমি বিখ্যাত ঢোল বাদক তৈয়ব আলী, আমরার সরকার বংশ, অতি উচ্চবংশ!' 'তোমারে তো আইজ অত্যাধিক সুন্দর লাগতেছে, কাহিনী কি? সিনান (স্নান) করেছো?- তৈয়ব আলীর একেকটা ডায়লগের পরে হাসি আটকে রাখাটা ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজগুলোর একটা। কুটিল একটা চরিত্রের মনস্তত্বকে নিখুঁতভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তোলার কাজে দারুণভাবে সফল হয়েছিলেন ফারুক আহমেদ। সেই চরিত্রটাই আবার যখন ভোট দিয়ে এসে বললেন, ২০০ টাকা ঘুষ পেয়েও তিনি ভোটটা ভালো প্রার্থীকেই দিয়ে এসেছেন, কারন তিনি নিজে একজন দুষ্টু লোক হয়ে আরেকজন দুষ্টু লোককে ভোট দিতে পারবেন না- তখন সেই চরিত্রটার প্রতি অদ্ভুত একটা মায়ায় মন আচ্ছন্ন হয় অযথাই।
তবে মায়ার কথা যদি বলি, এই নাটকে সেটা সবচেয়ে বেশি পাবেন চ্যালেঞ্জার। ফজলু চাচা বা দোতারা চাচার যে চরিত্রটায় তিনি অভিনয় করেছেন, সেটা মানসিকভাবে অসুস্থ একজন মানুষের চরিত্র, যে কিনা জ্বিনের বাদশা নামের এক কাল্পনিক অবয়বের দেখা পায়, তাকে নিজের দোতারা বাজানো শোনাতে রাত-বিরাতে জঙ্গলে গিয়ে বসে থাকে, পাগলামির কারনে যার স্ত্রীকে বাবার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই মানুষটা ঢাকায় চিকিৎসা করে সুস্থ হয়ে ফিরে আসার পর স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে যখন জানতে পারলেন যে, তার স্ত্রীর অন্য এক জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে- তখন তার কষ্টটা তেরো বছরের এক কিশোর হয়েও স্পষ্ট অনুভব করতে পারছিলাম। দোতারা চাচার জন্য এত মন খারাপ হয়েছিল, সেটা লিখে বা বলে বোঝানো যাবে না।
সেই মন খারাপটা ফিরে এসেছিল ওস্তাদ জালাল খাঁ'র শেষ পরিণতি দেখেও। চিত্রনায়ক রিয়াজ অভিনয় করেছিলেন এই চরিত্রে, সিনেমার জনপ্রিয় তারকা হয়েও তিনি উড়ে যায় বকপক্ষীতে নাম লিখিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদের কারনেই। অচেনা, অজানা একজন মানুষকে মৃত্যুশয্যায় রেখে মজিদ মিয়া কোথাও যেতে পারবেন না, তাই গানের দল নিয়ে লন্ডন যাওয়ার মতো দারুণ একটা সুযোগ তিনি পায়ে ঠেলে দেন- হুমায়ূন যেন মজিদ মিয়া আর পুষ্পের মাধ্যমে মানবতার এক অমোঘ বার্তাই দিতে চেয়েছিলেন এই নাটকে।
উড়ে যায় বকপক্ষী দেখা শুরু করেছিলাম দমফাটানো হাসির নাটক হিসেবে, কিন্ত মাঝে মাঝেই হুটহাট এমন সব মোড় নিচ্ছিল গল্পটা, আবেগে ভেসে না গিয়ে উপায় ছিল না। একই মায়ের পেটে জন্ম দুই বোনের, পুষ্পের জায়গা হয় মজিদ মিয়ার কোলে, কিন্ত ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ফুলেশ্বরীর জীবন কাটে পতিতালয়ে। বোন ফুলেশ্বরীর কবরে একটা গাছ লাগিয়ে পুষ্প যখন বলছিল- ‘বইন গো, জীবনে কোনোদিন ছায়া পাও নাই। তাই তোমার কবরে এই ছায়ার ব্যবস্থা করলাম...’ তখন চোখের পানি আটকে রাখাটা পাষাণের পক্ষেও দুঃসাধ্য ছিল। একইভাবে স্ত্রীকে হারানোর পর দোতারা চাচার মাথার সমস্যাটা ফিরে আসা দেখেও মনে প্রশ্ন জেগেছে, জীবনটা এত কষ্টের কেন?
পরিচালক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ ভীষণ খুঁতখুঁতে ছিলেন, একসঙ্গে চার-পাঁচটি পর্বের শুটিং করতেন। যদি কারও অভিনয় তাঁর পছন্দ না হতো, পরে পুরো নাটকটি আবার ধারণ করতেন। এতে করে আর্থিক ক্ষতির মুখেও পড়তে হতো। উড়ে যায় বকপক্ষী নাটকটির প্রথম পাঁচ পর্ব দুবার ধারণ করতে হয়েছিল, কারন প্রথমবার শুটিংয়ের পর সেটা হুমায়ূন আহমেদের মনোঃপুত হয়নি। নাটকের গল্পটা যেহেতু গানের দল নিয়ে, তাই অনেকগুলো লোকগান ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন পর্বে। শাওন, মাসুম আজীজ, রিয়াজ, স্বাধীন খসরু, দিহান- সবাই দারুণ অভিনয় করেছিলেন, কিন্ত উড়ে যায় বকপক্ষী নাটকের কথা মনে পড়লে সবার আগে চোখে ভেসে ওঠে ফারুক আহমেদ এবং চ্যালেঞ্জারের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সই।
আজ হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন। তাই উড়ে যায় বকপক্ষীর কথা স্মরণ করলাম, লিখতে গিয়ে মনটা হতাশায় আচ্ছন্ন হলো। এখনকার নাটকে জোর করে হাসানোর জন্য যে ভাঁড়ামির আশ্রয় নেয়া, আর সুড়সুড়ি দিয়ে সংলাপ সাজানো- সেসবের কিছুই ছিল না এই নাটকে। ছিল না তারকাদের গ্ল্যামারাস উপস্থিতি, রিয়াজের মতো নায়ক পাঞ্জাবী আর লুঙ্গি পরে অভিনয় করেছেন চরিত্রের প্রয়োজনে! ছিল না প্রেম-ভালোবাসার নামে পুতুপুতু আচরণ- কিন্ত ছিল অসাধারণ গল্প, দুর্দান্ত নির্মাণ, একদল মেধাবী অভিনেতা-অভিনেত্রীর সর্বস্ব উজাড় করে দেয়া পারফরম্যান্স, ছিল হুমায়ূন আহমেদ নামের এক জাদুকরের ছোঁয়া। আর তাতেই উড়ে যায় বকপক্ষী অনন্যতা পেয়েছে, অমর হয়েছে।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন