ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে আমেরিকা-ইসরায়েলের সম্পর্কে আবারও সেই চিরাচরিত উষ্ণতা ফিরে এসেছে। একে তো ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেনই, সেই সাথে ওবামার আমলে নেয়া ইসরায়েলের স্বার্থবিরোধী সকল সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিয়েছেন তিনি।

সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতির ব্যাপারে ন্যূনতম ধারণাও যাদের রয়েছে, তারা একটি বিষয় নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই চেষ্টা করে ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষার। এত ছোট একটি দেশ ইসরাইল, যার জনসংখ্যা দশ মিলিয়নেরও কম, সেই দেশটির প্রতি আমেরিকার মত বিশ্বের সর্বোচ্চ পরাশক্তির এতটা ভালোবাসার কারণ কী? প্রতি বছরই ইসরাইলকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সাহায্য করছে আমেরিকা। সেই সাথে রয়েছে যেকোন জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ডিপ্লোম্যাটিং ব্যাকিংও।

এর পেছনে প্রকৃত কারণ কী হতে পারে? কী করেই বা এই দুই দেশের মধ্যে এমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সৃষ্টি হলো? সবসময়ই যে এই দুই দেশের মধ্যে এতটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, তা মনে করলে কিন্তু খুব বড় ভুল করবেন। ইসরায়েল জন্মের পর থেকে প্রথম কয়েক দশক পর্যন্ত এই ঘনিষ্ঠতার লেশমাত্রও ছিল না। প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের সময়ে ইসরায়েলের প্রতি আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি তো ছিল খুবই শত্রুভাবাপন্ন। বিশেষত ১৯৫৬ সালে যখন সুয়েজ যুদ্ধ হয়, যেখানে মিশরের বিপক্ষে লড়াই করে ইসরায়েল, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স।

কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধ যতই ঘনীভূত হতে থাকে, ইসরায়েলের সাথে আমেরিকার ঘনিষ্ঠতা ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যকে সোভিয়েত প্রভাবমুক্ত করতে আমেরিকার একটি বড় কোন রাষ্ট্রের সহায়তা দরকার ছিল। তাই বাস্তবে ইসরায়েল বড় কোন রাষ্ট্র না হলেও, সেটিকেই ‘বড়’ করে তোলার দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নেয় আমেরিকা। অবশ্য আমেরিকা-ইসরায়েল জুটি সত্যিকারের চূড়ান্ত রূপ ধারণ করতে সময় নেয় ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত, যখন ইসরায়েলকে আকস্মিক আরব আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে ত্রাণকর্তার ভূমিকায় আবির্ভূত হয় আমেরিকা। 

স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকা-ইসরায়েলের সম্পর্ক খুবই গভীর ও শক্তিশালী, এবং অনেকের মতেই এখন তা অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি। অনেকের কাছেই এর প্রধান কারণ মনে হয় জিহাদিদের বিপক্ষে লড়াইয়ে দুই দেশের অভিন্ন স্বার্থ। তবে অনেকের ধারণা একেবারেই ব্যতিক্রম। আমেরিকান নেতৃস্থানীয়দের গণতন্ত্রের প্রতি দুর্বলতাই নাকি ইসরায়েলের সাথে আমেরিকার সম্পর্ককে উত্তরোত্তর শক্তিশালী করে তুলছে। তবে সবচেয়ে সহজ ব্যাখ্যা যেটি হতে পারে তা হলো, আমেরিকার মানুষের ইসলাম ধর্মের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব, যার ফলে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে দেশটির অধিকাংশ মানুষের সমর্থনই যায় ইসরায়েলের দিকে।

ট্রাম্প-নেতানিয়াহু 

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক জন মেয়ারশিমার ও স্টিফেন ওয়াল্টের প্রণীত একটি জনপ্রিয় তত্ত্ব রয়েছে, যেটি বলছে যে দুই দেশের মধ্যে এত গভীর সম্পর্কের পেছনে প্রধান প্রভাবক হলো প্রো-ইসরায়েল লবির শক্তি, বিশেষত আইপ্যাকের (আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি)। তবে এ তত্ত্বের সমালোচকরা বলেন যে আইপ্যাক অতটাও শক্তিশালী নয়, যতটা ওয়াল্ট ও মেয়ারশিমার মনে করেন। ওবামার শাসনামলে আইপ্যাক কর্তৃক ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি ব্যর্থ হওয়ার দিকেই সমালোচকরা আঙ্গুল তুলে থাকেন।

তবে আমেরিকা-ইসরায়েলের মধ্যকার এই ‘বিশেষ সম্পর্ক’- এর পেছনে কারণ যা’ই থাকুক না কেন, ইসরায়েলের প্রতি আমেরিকার অর্থনৈতিক সমর্থন ক্রমশই বেড়ে চলেছে। এখন পর্যন্ত ইসরায়েলকে ১১৮ বিলিয়ন ডলার সাহায্য করেছে আমেরিকা, এবং ইদানিং প্রতি বছর ইসরায়েলের জন্য ৩ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রেখেছে তারা। এছাড়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইসরায়েলের স্বার্থবিরোধী যেকোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথেই নিজেদের ভেটো ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটাচ্ছে তারা। সম্প্রতি জেরুজালেমকে ইসরায়েলের প্রকৃত রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আমেরিকান দূতাবাস তেল আভিভ থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। 

অবশ্য এত ঘনিষ্ঠতার পরও প্রায়সই ইসরায়েল ও আমেরিকান অফিসিয়ালদের মধ্যে টেনশন বিরাজ করতে দেখা যায়। এই প্রবণতা আরও বেশি বেড়ে গিয়েছিল ওবামার শাসনামলে, যখন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নেতানিয়াহু। এই দুই নেতা বেশ কয়েকবারই সেটলমেন্ট ও ইরান ইস্যুতে পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তুলেছিলেন। এ সম্পর্ক আরও খারাপের দিকে মোড় নেয় যখন ২০১৫ সালের মার্চে কংগ্রেসের এক যৌথ সম্মেলনে ইরান ইস্যুতে ওবামার অবস্থানের সমালোচনায় মুখর হন নেতানিয়াহু। এরপর ওবামার পক্ষ থেকেও নেতানিয়াহুর দিকে সমালোচনার তীর ছোঁড়া হতে থাকে, এবং এক পর্যায়ে মনে হতে শুরু করে আমেরিকা-ইসরায়েলের এতদিনের সম্পর্কে এবার বুঝি ছেদ ঘটবে। 

তবে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে আমেরিকা-ইসরায়েলের সম্পর্কে আবারও সেই চিরাচরিত উষ্ণতা ফিরে এসেছে। একে তো ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেনই, সেই সাথে ওবামার আমলে নেয়া ইসরায়েলের স্বার্থবিরোধী সকল সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিয়েছেন তিনি। আইসিস ও আল কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে এখন আরও বেশি একাট্টা আমেরিকা ও ইসরায়েল। এবং আমেরিকার সাধারণ মানুষের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন বাড়ছে, যা এক অর্থে ট্রাম্প সরকারের প্রতিও তাদের নীরব সমর্থনকেই নির্দেশ করে। সবমিলিয়ে আমেরিকা-ইসরায়েলের সম্পর্ক এখন স্মরণকালের শ্রেষ্ঠ সময় পার করছে। তাই বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষের কাছে তাদের এই সম্পর্ক যতই দৃষ্টিকটু কিংবা বাড়াবাড়ি মনে হোক না কেন, অদূর ভবিষ্যতে এ সম্পর্কের ছন্দপতনের কোন সম্ভাবনাই নেই।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা