নায়ক অনেক ছিলেন, আছেন, আসবেনও। কিন্ত মহানায়ক তো একজনই। অসময়ে উত্তমের চলে যাওয়ার পর সুচিত্রা সেন তার কাছের কয়েকজনকে বলেছিলেন- “ও গ্রেট, তবু যেন মনে হয় ওকে ঠিক মতো আবিষ্কার করা গেল না..."

১৯২৬ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর কলকাতায় জন্মগ্রহন করেছিলেন অরুণ কুমার। বাবা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় আর মা চপলা দেবী। নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর অভাব-অনটনের সংসার তাদের। তখন অরুন কুমার বাবা-মায়ের সাথে গিরিশ মুখোপাধ্যায় রোডের তাদের ছোট্ট বাড়িতেই থাকেন। বাবার সামান্য বেতনে সংসার চলছে না। উপায় না দেখে উপার্জনের জন্য কোমড় বেধে নেমে পড়লেন বাড়ির বড় ছেলে অরুণ। পড়াশোনার পাশাপাশি গানের শিক্ষকতা শুরু করলেন। তখনও কেউ ভাবতেও পারেননি কিছুদিন পরেই এই পরিশ্রমী যুবক বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মহানায়ক’ খেতাব পেতে যাচ্ছেন। হ্যা ঠিক ধরেছেন অরুন কুমার নামের সেই ছেলেটি সিনেমায় এসে হয়ে গেলেন উত্তম কুমার। এরই ধারাবাহিকতায় বাঙালির চলচ্চিত্র ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং আলোচিত একজন কিংবদন্তী হিসেবে উত্তম কুমার অমর হয়ে রয়ে গেলেন আমাদের হৃদয়ে। 

পরিবারে সচ্ছলতা আনার জন্য শিক্ষকতা করার সময়েই গান শেখাতেন তিনি। এমনভাবেই বিখ্যাত গাঙ্গুলী বাড়ির মেয়ে গৌরী দেবীকে গান শেখানোর দায়িত্ব পেলেন। বেতনও বেশ ভালো, সেই সময়ে মাসে ৭৫ টাকা। আগেই কিছুটা চেনাজানা থাকলেও গানের শিক্ষকতা করতে গিয়ে কাছে এলেন অরুন-গৌরী। বিত্তশালী গৌরির পরিবার বাধা দিয়েছিলেন, নানা প্রতিকুলতা সত্ত্বেও মেয়ের কঠিন পণ দেখে একটা সময় নরম হলেন তারা এবং ১৯৫০ সালের ১লা জুন সাত পাকে বাধা পড়েই অরুণের ঘরে এলেন গৌরী দেবী। 

বিয়ের আগেই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে পা রেখেছেন অরুন। ছোটবেলা থেকেই অরুণ প্রচন্ড থিয়েটার অনুরাগী ছিলেন। সাথে যাত্রার ভক্তও ছিলেন তিনি। এভাবেই রুপালি পর্দায় অভিনয়ের ঝোঁকটা ক্রমেই বেড়ে চলেছিলো। ১৯৪৭ সালে হিন্দি সিনেমা 'মায়াডোর'এ অভিনয়ের সুযোগ মিললো ৷ মাত্র পাঁচ সিকিতে দৈনিক বেতন চুক্তিতে ওই সিনেমাতে অভিনয় করলেন অরুণ। কিন্তু 'মায়াডোর' মুক্তি পেল না। ৪৮ সালে পেলেন আরেকটি সুযোগ, 'দৃষ্টিদান' সিনেমাতে সেই সময়ের জনপ্রিয় নায়ক অসিতবরণের অল্প বয়সের চরিত্রে। কিন্তু দর্শকমনে তেমন দাগ কাটতে পারলেন না অরুণ। পরের সিনেমা 'কামনা'। ১৯৪৯ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমাটাও সুপার ফ্লপ। পরের দুই সিনেমা 'মর্যাদা' ও 'ওরে যাত্রী' বক্সঅফিসে ফ্লপ হিসেবে নাম লেখালো।

তারপর মুক্তি পেলো 'সহযাত্রী' এবং কিছুদিন পরে 'নষ্টনীড়'। এবার তার অভিনয় কিছুটা নজর কাড়লেও সিনেমা ফ্লপ তাই ভাগ্যদেবী মুখ তুলে তাকালেন না। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে একের পর এক সিনেমা ফ্লপ করছে কিন্তু অরুন কুমার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন ৷ বিষয়টি সেই সময় ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই ভালভাবে নিল না। আড়ালে-আবডালে তাঁকে ডাকা শুরু হল 'ফ্লপ মাস্টার জেনারেল' বা 'এফএমজি' বলে। এই নামটা বেশ ভালোভাবেই রটে গেলে সিনেমাপাড়ায়। খবরের পাতায় এফএমজি ঘিরে খবরও ছাপা হল। কিন্তু দমে যাননি অরুন কুমার। তিনি বাজি ধরেছিলেন নিজের উপর যে, তাকে সফল হতেই হবে। 

তবে অসফলতার ধারাবাহিকতা তখনো চলছিল। প্রখ্যাত নির্মাতা সরোজ মুখোপাধ্যায়ের 'মর্যাদা' সিনেমাতে নায়ক হিসেবে তার নাম পাল্টে দেয়া হলো অরূপ কুমার। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না কিছুই। তবে এই ‘সহযাত্রী’ সিনেমাতে অভিনয় করছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা পাহাড়ি সান্যালের সঙ্গে। শুটিংয়ের ফাঁকে এক আড্ডায় পাহাড়ি সান্যাল হঠাৎ বলে বসলেন-’তুমি অরুণ নও হে, তুমি যে উত্তম, উত্তম কুমার।' তার পরামর্শে নাম পাল্টে হয়ে গেলেন উত্তম কুমার। এই নাম নিয়েও ১৯৫১ সালে 'সঞ্জীবনী' সিনেমা ফ্লপ হল। 'বসু পরিবার' সিনেমাতে ঠিক নায়কের ভূমিকায় নয়, ছিলেন পার্শ্বচরিত্রে। এই সিনেমাটি বেশ ভাল ব্যবসা করার পাশাপাশি নিজের অভিনয়ের জন্য প্রথমবার প্রশংসিত হলেন উত্তম কুমার।

১৯৫৩ সালে মুক্তি পেল নির্মলদের প্রেম এবং কমেডি ঘরনার সিনেমা 'সাড়ে ৭৪'। মুক্তির পর চারদিকে একটাই কথা যে, এক নতুন জুটি এসেছে সিনেমার পর্দায়। তবে বয়স্করা মজেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী আর মলিনা দেবীতে। তাদের দাবি, হিরো-হিরোইন তো তুলসী-মলিনা। নতুন জুটি তো সাইড রোলে। এই নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সিনেমাটি বক্স অফিস চমকে দেয়া ব্যবসা করলো ৷ টানা আট সপ্তাহ প্রেক্ষাগৃহে চললো এই সিনেমা ৷ সাদা-কালো 'সাড়ে ৭৪' এর মাধ্যমে যে নতুন জুটির ইনিংস শুরু হয়েছিল তাতেই রঙিন ইতিহাস লেখা হলো। প্রথমবারের মতো উত্তম কুমার পেলেন কালজয়ী সাফল্য। এই সাফল্যের উপর ভর দিয়ে যে যুগের শুরু হয়েছিলো টানা তিন দশক ধরে সেই যুগের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছিলো। সাফল্যের এই যাত্রায় উপমহাদেশের দর্শকদের মোহাবিষ্ট করে পৌঁছে গেলেন এক অনন্য উচ্চতায়। এখনো সেই অনাবিল হাসি, অকৃত্রিম চাহনি আর অভিনয় গুণে কয়েক প্রজন্ম পেরিয়ে এসে আজও বাঙালির চেতনায় উত্তম কুমার যেনো খুব জীবন্ত।

সুচিত্রা সেনের সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয়ের আগে উত্তম কুমার তার ক্যারিয়ারের ছয় বছরে নয়টি সিনেমাতে অভিনয় করেন। এই সিনেমাগুলোর ৯ নায়িকার মধ্যে আটজনই ছিলেন বয়সে উত্তমের বড়। ছোট ছিলেন একমাত্র সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। মায়া মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে ছবি রায়, মনীষা দেবী, করবী গুপ্ত, ভারতী দেবী, সনিন্দা দেবী, সন্ধ্যা রানী ও মঞ্জু দে- আটজনকেই উত্তম ‘দিদি’বলে ডাকতেন। চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের অনেকেই মনে করেন, বয়সে বড় নায়িকাদের সঙ্গে অভিনয় করায় উত্তমের শুরুর কেরিয়ারে প্রভাব ফেলে। দর্শকেরা অল্প বয়সী নায়কের সাথে একটু বেশি বয়সী নায়িকাদের গ্রহন করেন নি। 

তবে ‘সাড়ে ৭৪' সিনেমার সাফল্যের আসল চমক বোঝা গেলো পরের বছর। ১৯৫৪ সালে মুক্তি পেল উত্তম অভিনীত ১৪টি সিনেমা, তার মধ্যে সাতটিই সুচিত্রার সঙ্গে জুটি বেঁধে। ইন্ডাস্ট্রিতে তখন উত্তম-সুচিত্রা সিনেমা হিট করার মূলমন্ত্র। জুটি হিসেবে তাদের যাত্রা যে এক স্বর্নজ্জ্বল ইতিহাস রচনা করতে যাচ্ছে তা মনে হয় তারা নিজেরাও ভাবেননি। প্রথম সিনেমা 'দৃষ্টিদান' দিয়ে শুরু করে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ৩৩ বছরে বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে প্রায় আড়াইশ' সিনেমাতে অভিনয় করেছেন উত্তম কুমার। প্রথম সিনেমাতে মায়া মুখোপাধ্যায় থেকে সর্বশেষ 'ওগো বধূ সুন্দরী'তে মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় নিজের ক্যারিয়ারে সবমিলিয়ে ৪৬ জন নায়িকার সাথে জুটি বেধেছেন তিনি।

১৯৫৪ সালে 'ওরা থাকে ওধারে' সিনেমা দিয়ে উত্তম-সুচিত্রা জুটি পাকাপাকিভাবে দর্শক হৃদয়ে স্থান করে নেয়। তবে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ সিনেমার অভাবনীয় সাফল্য তাদের সর্বকালের সেরা জুটির স্বীকৃতি এনে দেয়। ১৯৫৩ সালে যে সাফল্যমণ্ডিত যাত্রা শুরু হয়েছিলো ১৯৭৫ সালে 'প্রিয় বান্ধবী' সিনেমা দিয়ে সেই যাত্রা শেষ হয়। এই ২২ বছরে মুক্তি পেয়েছে উত্তম-সুচিত্রা জুটির সর্বমোট ৩১টি সিনেমা মুক্তি পায়। প্রতিটা সিনেমাই তাদের জুটির মুকুটে একেকটি সোনার পালক জুড়ে দিয়েছিলো। বাঙালির চোখে আজও তারাই একমাত্র জুটি যাদের আবেদন এখনো ফুরায়নি, আর ফুরাবে বলে মনেও হয়না। 

তবে এই সাফল্য তাদের মধ্যে দুরত্বও এনে দিয়েছিলো। এমনিতেই বিবাহিত এই দুই তারকাকে নিয়ে গুঞ্জনের কোনো কমতি ছিলোনা। তবে পেশাগত সফলতা তাদের মধ্যে এক ধরনের দ্বন্দ্ব নিয়ে আসে। কে বেশি জনপ্রিয় তা নিয়ে বিভক্তি তৈরী হয়। দুজনে একসাথে কাজ করা কমিয়ে দেন। তবে এই দুরত্ব আদতে তাদের দুজনের ক্যারিয়ারকে আরো সাফল্যমণ্ডিত করে তোলে। উত্তম ছাড়া সুচিত্রা বা সুচিত্রা ছাড়া উত্তম উপহার দিতে থাকেন একের পর এক সুপারহিট নান্দনিক সিনেমা। 

তবে নিজের প্রযোজনায় কালজয়ী ‘সপ্তপদী’ সিনেমার সেই বিখ্যাত রিনা ব্রাউনের চরিত্রে সুচিত্রা ছাড়া কাউকেই মনে ধরেনি উত্তমের। বন্ধু সুচিত্রাকে অনুরোধ করেন এই সিনেমায় আবার জুটি বাধার জন্য। সুচিত্রাও মান অভিমান ভুলে রাজি হলেন। আর এই সিনেমার বদৌলতে আমরা পেলাম রোমান্টিক গানের ইতিহাসে সেই অমর গান ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’। আবারো রুপালি পর্দায় জয়জয়কার সুচিত্রা আর উত্তমের। এরপর আর কোনদিন তাদের বন্ধুত্বে দুরত্ব আসেনি। উত্তমের জীবনে স্ত্রী হিসেবে গৌরি দেবী বা পরবর্তীতে সুপ্রিয়া দেবী পাকাপোক্ত আসনে বসলেও সুচিত্রা সেন সবচেয়ে কাছের বন্ধু হিসেবে রয়ে গেলেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। 

সপ্তপদী সিনেমায় উত্তম-সুচিত্রা

উত্তম কুমারের পেশাগত জীবনে একের পর এক সফলতা আসতে ছিলো কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রীর সাথে মনোমালিন্য বাড়তে থাকে। এরই মাঝে সুপ্রিয়া দেবীর সাথে তাকে জড়িয়ে গুঞ্জন সেই আগুনে ঘি ঢালছিলো। একটা সময় বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বের হয়ে যান উত্তম। নিজের বাড়ি ছেড়ে ময়রা স্ট্রিটে সুপ্রিয়া দেবীর বাড়িতে উঠেন। স্ত্রী গৌরী দেবীকে ছেড়ে ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৮০ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গেই ছিলেন তিনি। তবে সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে থাকাকালীনও প্রায়ই চলে আসতেন ভবানীপুরের বাড়িতে। শুধুমাত্র মায়ের হাতের রান্না খাওয়ার জন্য। মা চপলাদেবীর হাতের ভেটকি মাছের কাঁটাচচ্চড়ির টানে ভোজনরসিক মহানায়ক শনি-রবিবার হলেই হাজির হতেন পৈত্রিক বাড়িতে।

‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘একটি রাত’, ‘হারানো সুর’, ‘সপ্তপদী’, ‘জতুগৃহ’, ‘চিড়িয়াখানা’, ‘নায়ক’, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘গৃহদাহ’, ‘কমললতা’, ‘অগ্নিশ্বর', ‘বিপাশা’, ‘জীবনতৃষা’, সাগরিকা’, 'যদুবংশ', 'ছদ্মবেশী', 'থানা থেকে আসছি', 'ভ্রান্তিবিলাস', 'খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন', 'মরুতীর্থ হিংলাজ', 'রাইকমল', 'সাহেব বিবি গোলাম', 'ঝিন্দের বন্দী', 'শেষ অঙ্ক', ‘শাপমোচন’, ‘স্ত্রী’, ‘মৌচাক’,'ধন্যি মেয়ে', 'কায়াহীনের কাহিনী', ‘সন্নাসীরাজা’, 'রাতের রজনীগন্ধা'র মতো নান্দনিক সিনেমার মধ্য দিয়ে উত্তমকুমার বেচে রইবেন আমাদের মাঝে আরো অনন্তকাল একথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। 

তবে সমালোচকরা বলেন, উত্তম কুমারের জীবনের সেরা অভিনয় হলো সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা 'নায়ক’ এ। অবশ্য সেটা হবে নাই বা কেন। মহা-পরিচালকের সঙ্গে মহানায়কের যুগলবন্দি। সেখানে উত্তম দেখিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর অভিনয়ের ক্ষমতা কতখানি। তবে সত্যজিতের সঙ্গে মাত্র দুইটি সিনেমা করেছিলেন উত্তম। নায়ক এবং চিড়িয়াখানা। তারপর তো অকালে চলে গেলেন। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে। না হলে আমরা হয়তো আরও কিছু মাস্টারপিস উপহার পেতাম।

উত্তম কুমার বাংলা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি কয়েকটি হিন্দি সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত হিন্দি চলচ্চিত্রের মধ্যে ছোটি সি মুলাকাত, দেশপ্রেমী ও মেরা করম মেরা ধরম অন্যতম। উত্তম কুমার পরিচালক হিসেবেও সফল ছিলেন। কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী, বনপলাশীর পদাবলী, এবং শুধু একটি বছর সিনেমার সাফল্য প্রমাণ করেছিলো পরিচালক হিসেবেও তিনি অসাধারন। ১৯৬৭ সালে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ও চিড়িয়াখানা সিনেমার জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন উত্তম কুমার (তখন এই পুরস্কারের নাম ছিল 'ভরত')। 

উত্তম কুমার

অবশ্য এর আগে ১৯৫৭ সালে অজয় কর পরিচালিত ‘হারানো সুর’ সিনেমাতে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছিলেন সমগ্র ভারতজুড়ে। সেই বছর ‘হারানো সুর’ পেয়েছিল রাষ্ট্রপতির সার্টিফিকেট অফ মেরিট। ইংরেজি উপন্যাস 'রানডম হারভেস্ট' অবলম্বনে সিনেমাটি নির্মাণ করা হয়। প্রযোজক ছিলেন উত্তম কুমার নিজেই। 

ফ্যামিলি গেট-টুগেদারের একটা আলাদা গুরুত্ব চিরকালই ছিল তাঁর কাছে। তাঁর জীবদ্দশায় ছেলে বা নাতি-নাতনির জন্মদিন, কিছুই মিস করতেন না তিনি। তবে পারিবারিক অনুষ্ঠান থেকে কখনওই বাদ দিতেন না কাছের বন্ধু-বান্ধবদের। প্রতি বছর দোলের আসরে ভবানীপুরের বাড়িতে আসতেন টালিগঞ্জের একাধিক সেলেব্রিটি। জনপ্রিয়তার কারণেই সে সময়ে পার্টি করতে বাইরে খুব একটা যেতেন না উত্তমকুমার। ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতেই বসত আসর। বিশাল হলজুড়ে কার্পেট বিছানো থাকত আর মাটিতেই গদি-তাকিয়া সহযোগে করা হত বসার বন্দোবস্ত। অফুরন্ত খানাপিনার সঙ্গেই বিদেশি মিউজিকের তালে তালে কোমর দোলাতেন মহানায়ক। 

প্রখ্যাত সাংবাদিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য তার একটি আর্টিকেলে লিখেছিলেন, ‘দেশভাগ থেকে নকশাল আন্দোলনের সময়কাল অবধি ধরলে সব বাঙালি চরিত্রেই উত্তম কুমার তার ছাপ রেখে গেছেন। ধনী, দরিদ্র, সরল, জটিল, ভাল, মন্দ, দূরের, কাছের, জয়ী, পরাস্ত, নায়ক, ভিলেন কোন চরিত্র তিনি করেননি। একজন অভিনেতার এতোটা শক্তিশালী অভিনয় দক্ষতা বাংলা সিনেমায় আর আসবেনা। পুরুষত্ব জাহির করা সেই কণ্ঠস্বর এবং আশ্চর্য লিপিং দক্ষতা মুগ্ধ করে রেখেছে আমাদের আজ অব্দি। হেমন্ত, মান্না, শ্যামল বা কিশোর যারই গান হোক উত্তম যেনো সবার কন্ঠকেই ধারন করেছেন অবলীলায়।

উত্তম কুমারই বাংলা সিনেমার প্রথম নায়ক যিনি সিনেমার ভয়েসটা বুঝতে পারতেন। অর্থাৎ এখানে যে মেলো ভয়েসের প্রয়োজন আছে, আর সেটাই যথাযথ সেটি উত্তম কুমারই প্রবর্তন করেন। থিয়েটার বা নাটকের মতো যে উচ্চস্বরে কথা বলার প্রয়োজন নেই তা বুঝিয়েছিলেন তিনি। উত্তম কুমার হচ্ছেন গড়পড়তা অবদমিত বাঙালির প্রতিনিধি। তিনি নিজের চারপাশে একটা রশ্মি তৈরি করতে পেরেছিলেন। তখনকার দিনে পেজ থ্রি ছিল না। 

মিডিয়া সাপোর্ট ছিল না আজকের দিনের মতো। তা সত্ত্বেও উত্তম কুমার কী খাচ্ছেন, কার সঙ্গে প্রেম করছেন বা করছেন না তা নিয়ে চর্চা ছিল আপামর বাঙালির মধ্যে। উত্তম কুমারের জনপ্রিয়তার আরেকটি বড় কারণ ছিল মানুষ হিসেবে তার সুনাম। অভিনেতা হিসেবে দম্ভ-দর্প নয়, উত্তম কুমার ভালোবাসতেন মানুষের কাছাকাছি থাকতে, আর তাই সাধারন মানুষও তাকে ভালোবাসতেন। সহকর্মীদের আর্থিক বিপদের দিনে তাদের পাশে দাঁড়াতেন নিঃস্বার্থভাবে। 

১৯৮০ সালের জুলাই মাসে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে দুনিয়া থেকে বিদায় নেন ‘মহানায়ক’। ক্ষণজন্মা এই কিংবদন্তি চলচ্চিত্র শিল্পর সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন ৩২ বছর। তবুও যেনো আমাদের অতৃপ্তি মেটে না। উত্তমের এভাবে চলে যাওয়ায় শোকবিহ্বল সুচিত্রা সেন র কাছের কয়েকজনকে বলেছিলেন, “ও গ্রেট...তবু যেন মনে হয়, ওকে ঠিক মতো আবিষ্কার করা গেল না।” 

আড়াইশোর বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন উত্তম কুমার। বহুমুখী চরিত্রে নিজেকে ভেঙেছেন, গড়েছেন। নায়ক হিসাবে যখন তাঁর গ্রহণযোগ্যতা চূড়ায়, তখন খলনায়ক কিংবা বাবার চরিত্রে অভিনয় করতে পিছুপা হননি। তাতেও তিনি দারুণভাবে সফল। তবে, কোথাও যেন এক ধারায় বয়েছে তাঁর সেলুলয়েডের জীবন। দেশ, কালের বেড়া ছাড়িয়ে 'বিশ্বনায়ক' হয়ে ওঠার খিদেয় একটা ভাল চরিত্র খুঁজে বেরিয়েছেন বার বার। পরবর্তীকালে সুচিত্রার মতো সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, “উত্তমের মতো কোনও নায়ক নেই। কেউ হবেও না। আশ্চর্য অভিনয়ের ক্ষমতা। ওর ক্ষমতা আছে দর্শক টেনে রাখার...” যে দেশে সৎ অভিনেতার সদ্ব্যবহার করতে জানা লোকের এত অভাব, সেখানে এটাই স্বাভাবিক! তাই বলাই যায়, বাঙালির জীবনে ‘মহানায়ক’ হয়েও আজও অনাবিষ্কৃতই থেকে গেলেন উত্তম!

তথ্যসূত্র- আনন্দলোক, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, জি নিউজ বাংলা

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা